ডিফেন্স

নারী রুপী শেরনি, পরম শিব ভক্ত মহারানী অহিল্যাবাই ১০০ এর বেশী মন্দির তৈরি করেন। কে ছিলেন এই মহারানি?

রাজেশ রায়:— ভারতের ইতিহাসে অনেক রানীর কথা শুনে থাকবেন তা সে কাশ্মীরের রানী দিদা হোক, দিল্লির মহিলা সুলতান রাজিয়া সুলতানা কিংবা ঝাঁসির রানী লক্ষীবাই। ভারতের ইতিহাস এমন অসাধারন রানী, মহারানী ও তাদের কাহিনীতে ভরপুর। কিন্তু ভারতের ইতিহাসে এমন এক রানী আছে যার কাহিনী হয়ত সবাই জানেন না, ওনার কথা যেন ইতিহাসে চাপা পড়ে গেছে। ওনার সম্মানে বিখ্যাত কবি জুয়ানা বেলি ১৮৪৯ সালে লিখেছিলেন :— 

“In latter days from Brahma came,

To rule our land, a noble dame

Kind was her heart and bright her fame,

Ahilya was her honoured name”.

আজ এই মহান রানী সম্পর্কেই আলোচনা করব যিনি ইতিহাসে মহারানী অহিল্যাবাই হোলকার নামে বিখ্যাত। একজন গ্রাম্য বালিকা থেকে মহারানী হয়ে ওঠার অসাধারন কাহিনী। 

অহিল্যাবাইয়ের জন্ম ১৭২৫ সালে জামখেড়ের চুন্ডি নামক গ্রামে হয়েছিল, যা আজ মহারাষ্ট্রের বীর জেলায় অবস্থিত। ওনার পিতার মানকোজি রাও সিন্দে গ্রামের প্রধান বা মুখিয়া ছিলেন। সেসময় মেয়েদের পড়াশোনার চল ছিল না তাও ওনার পিতা ওনাকে ঘরেতেই শিক্ষা দেন। বুঝতেই পারছেন ওনার জন্ম হয় সাধারন এক গ্রামে এখান থেকে কী করে মহারানী হলেন সেই ঘটনাও বড় আশ্চর্যের। সময়টা আঠারো শতকের ঔরাঙ্গজেবের মৃত্যুর পর মুঘলদের শক্তি কমতে থাকে। এসময় ডেকান প্রদেশে মারাঠা শক্তি বাড়তে থাকে। মারাঠাদের রাজা থাকলেও আসল ক্ষমতা ছিল পেশোয়া বাজিরাও এর কাছে। এই সময় দক্ষিন থেকে উত্তর পর্যন্ত জায়গা নিজেদের আয়ত্তে আনতে শুরু করে মারাঠারা।  রাজস্থানের মালওয়া সহ অনেক জায়গা মারাঠারা অধিকারে আনে নিজেদের। পেশোয়া বাজিরাও এমন অনেক জায়গা তার দলের লোকেদের জায়গির হিসাবে দিয়ে দেন। এমনই একজন হলেন মালহার রাও হোলকার যিনি ১৭৩০ সালে মালওয়ার জায়গির পান। তিনি ইন্দোরকে রাজধানী ঘোষনা করে স্বাধীন হোলকার রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন। ওনার একটাই পুত্র ছিল খান্ডেরাও কিন্তু খান্ডেরাও বাবার মত শক্তিশালী ছিলেন না এবং রাজকার্যে তেমন মন ছিল না। সেজন্য মালহার রাও হোলকার এমন একজন পুত্রবধূ চাইছিলেন যে তার পর হোলকার রাজ্য পরিচালনা করতে পারবে। 

একবার কোনও এক জায়গা থেকে ফেরার সময় মহারাজ মালহার রাও হোলকার চুন্ডি গ্রামে রাতে থাকেন। সেসময় গ্রামের এক শিব মন্দরে সন্ধ্যা আরতি হচ্ছিল। বাকী সবার মতন মালহার রাও হোলকারও সেখানে উপস্থিত থাকেন। তিনি দেখেন একটও সাত, আট বছরের বাচ্ছা মেয়ে অপূর্ব সুন্দর সন্ধ্যা আরতি করছে, এই টুকু বয়সে তার মুখে চোখে কী তেজ ও শান্তি রয়েছে। মালহার রাও সেই মেয়েটির পরিচয় সম্বন্ধে আশেপাশের লোকের কাছে জানতে চান। তিনি জানতে পারেন সেই মেয়টি পেশোয়া বাজিরাও এর ডান হাত মানকোজি রাও শিন্দের মেয়ে অহিল্যাবাই। তিনি ততক্ষনাৎ মানকোজি রাওয়ের সাথে দেখা করে নিজের পরিচয় দেন। মানকোজি রাও ওনাকে রাতে ওনার বাড়িতে আশ্রয়ের জন্য নিমন্ত্রন করেন। মালহার রাওয়ের অহিল্যাবাইকে এতটাই পচ্ছন্দ হয়েছিল যে তিনি মানকোজি শিন্দে কে অহিল্যাবাইকে নিজের পুত্রবধূ করবার জন্য বলেন যা খুশি মনে মেনে নেন মানকোজি শিন্দে। এভাবে আট বছর বয়সে হোলকারের মহারানী হয়ে ওঠেন অহিল্যাবাই। কিন্তু মহারানী হয়েও ওনার পথ এতটা সুগম ছিল না, এর পরে ওনার জীবনে অনেক বিপদ আসতে চলেছিল। 

পিতার ঘরে সঠিক শিক্ষা পাওয়ার জন্য শশ্বুড় বাড়িতে গিয়ে তিনি সবার সেবা যতটা সম্ভব করেন। ওনার দুই ছেলে মেয়ে হলেন মালেরাও হোলকার ও মুক্তাবাই হোলকার। অহিল্যাবাইয়ের সংস্পর্শে খান্ডেরাও রাজকার্যে মন দেন ও সুশাসক হয়ে ওঠেন, প্রজাও খুশি থাকেন কিন্তু ১৭৫৪ সালে ভরতপুরের মহারাজ সুরাজামাল জাঠের সাথে কুমহেরের যুদ্ধে খান্ডেরাও বীরগতি প্রাপ্ত হন। স্বামীর মৃত্যুর পর মাত্র ২৯ বছরে বয়সে বিধবা হওয়া অহিল্যাবাই সতী হতে চেয়েছিলেন কিন্তু ওনার শ্বশুর মালহার রাও ওনাকে বারন করে হোলকার রাজ্যের দায়িত্ব তার হাতে তুলে দেন। প্রজার কথা ভেবে তিনিও রাজপাঠ শুরু করেন। ১৭৬৬ সালে মালহার রাও হোলকার মারা যান এরপর অহিল্যাবাই তার একমাত্র পুত্র মালেরাও হোলকার কে রাজা করেন কিন্তু ভাগ্যের এমনই পরিহাস যে মাত্র একবছর পর ১৭৬৭ সালে কঠিন অসুখে ভুগে মারা যান মালেরাও হোলকার। এরপর আবারও রাজ্যের দায়িত্ব নেন অহিল্যাবাই। এইসময় হোলকার রাজ্যের এক পুরোনো আধিকারিক চন্দ্রচূড় পেশোয়ার বিশ্বস্ত লোক রাঘোবাকে এক চিঠি লিখে জানান হোলকার রাজ্যে এখন কোনও রাজা নেই, এটাই সঠিক সময় হোলকার দখল করার। অহিল্যাবাই এই ষড়যন্ত্রের খবর পেয়ে ঘোষনা করেন পুরো হোলকার রাজ্যের ক্ষমতা তিনি নিজের হাতে নিয়ে নিয়েছেন।

অহিল্যাবাই এর এই সিদ্ধান্তকে পূর্ন সমর্থন করেন হোলকার রাজ্যের সমস্ত সেনা ও সেনাপতি তুকোজি হোলকার। তুকোজি হোলকার ছিলেন মালহার হোলকারের দত্তক পুত্র কিন্তু তা সত্বেও তিনি সিংহাসনে না বসে রাজমাতা অহিল্যাবাইয়ের শাসন মেনে নেন। অহিল্যাবাইয়ের যু্দ্ধে অভিজ্ঞতা ছিল। ১৭৬৫ সালে গোয়ালিয়রের কাছে গোহাড দুর্গ দখল করেন। রাঘোবা তার সেনা নিয়ে হোলকার রাজ্য আক্রমনের পরিকল্পনা করে। মহারানী অহিল্যাবাই নিজের সেনাবাহিনী গঠন করেন এবং আশেপাশের রাজ্য থেকে সাহায্য চান। সবাই ওনাকে সাহায্য করেন এমনকী পেশোয়া মাধবরাও ওনাকে সমর্থন করেন। অহিল্যাবাই রাজ্যের মহিলাদের নিয়েও একটি সেনা গঠন করেন। তখন মহারানী অহিল্যাবাই রাঘোবা কে একটি চিঠি লিখে জানান যদি শিপ্রা নদী অতিক্রম করে রাঘোবার সেনা আসে তাহলে তাকে অহিল্যাবাই এর সেনার সম্মুখীন হতে হতে হবে, তিনি ও তার নারী সেনা রাঘোবার বিরুদ্ধে লড়বেন। তাকে অবলা নারী বলে যেন ভুল না করা হয়। যুদ্ধে তিনি হেরে গেলেও ক্ষতি নেই বরং নারী হারানোর কলঙ্ক সারাজীবন বয়ে বেড়াবে রাঘোবা। অন্যদিকে যদি তিনি জিতে যান তাহলে নারীর কাছে পরাস্ত হবার গ্লানিতে সারাজীবন তাকে কথা শুনতে হবে। এই চিঠি পেয়ে রাঘোবা ভাবনায় পড়ে যান, যদিও তার সমর্থকেরা তাকে যুদ্ধ করতে বলেন কিন্তু রাঘোবা বুঝতে পেরেছিলেন চিঠিটা নারী রুপী এক শেরনি লিখেছেন ফলে তিনি বাধ্য হয়ে চিঠ লিখে অহিল্যাবাইকে জানান যুদ্ধ করবার কোন ইচ্ছে তার নেই তিনি অহিল্যাবাইয়ের ছেলের মৃত্যুতে শোকপ্রকাশ করতে এসেছিলেন। এভাবে এক ফোঁটাও রক্তপাত না করে মহারানী অহিল্যাবাই তার রাজ্য রক্ষা করেছিলেন।

একজন সুশাসক ছিলেন তিনি। হোলকার রাজ্যে ডাকাত ও পিন্ডারিদের দমন করেছিলেন তিনি। আসলে জঙ্গলে থাকা ভিল ও গন্ডা উপজাতির লোকেদের, যারা লুঠপাত করত, তিনি আশ্রয় দেন এবং তাদের জঙ্গল রক্ষার কাজে নিয়োগ করেন। অহিল্যাবাই ইন্দেরের রাজপ্রাসাদ ছেড়ে তীর্থস্থান মহেশ্বরের এক ছোট সাধারন ঘরে থাকতে শুরু করেন। তার ঘরের দরজা সবার জন্য উন্মুক্ত থাকত। তিনি সকলের মা ছিলেন। মারাঠি পন্ডিত মোরোপান্ট ত্রিম্বক পিঙ্গেল, শাহির অনন্তপাহান্ডি, সংস্কৃত পন্ডিত খুশালী রামের মত ব্যাক্তি তার রাজসভার শোভা বর্ধন করতেন। সেসময় পুরো মধ্য ভারত জুড়ে ক্ষমতার লড়াই চলছিল কিন্তু রাজমাতা অহিল্যাবাইয়ের সময়ে মালওয়াতে কোন আক্রমন ঘটে নি। সেসময় চারিদিকে সংঘর্ষের মধ্যে যেন মরুভূমির মাঝে এক টুকরো মরুদ্দানের মত ছিল। তিনি ইন্দোরে টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রি তৈরি করেন, যা আজ মহেশ্বরী শাড়ির জন্য বিখ্যাত। পরম শিব ভক্ত অহিল্যাবাই হিমালয় থেকে শুরু করে দক্ষিন ভারত পর্যন্ত সর্বত্র তিনি বিশ্রামাগার, কুয়ো নির্মান করেছেন। বদ্রীনাথ থেকে শুরু করে ওমকারেশ্বর, দ্বারকা, পুরী, গয়া, বেনারস, রামেশ্বরম সব তীর্থে তার কোন না কোনও অবদান আছে। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কাশীর বিশ্বনাথ মন্দির। ১৭৮০ সালে তিনি এটি পুননির্মান করান। ১৬৬৯ সালে এই মন্দির ঔরাঙ্গজেব ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। ১৭৯৫ সালের ১৩ আগস্ট ৭০ বছর বয়সে রাজামাতা অহিল্যাবাই দেহত্যাগ করেন। তখন মালওয়ার প্রত্যেক মানুষকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন তাদের নিজেদের মা মারা গেছে। রাজমাতা অহিল্যাবাই ১০০ এর বেশী মন্দির, ৩০ টি ধর্মশালা, অসংখ্য কুয়ো তৈরি করান। অহিল্যাবাইয়ের খ্যাতি বিদেশেও পৌঁছেছিল, এইজন্য ওনাকে রাশিয়ার রানী ক্যাথরিন দি গ্রেট, ইংল্যান্ডের রানি এলিজাবেথ, ডেনমার্কের রানি মার্গারেট ১ এর সাথে তুলনা করা হয়। মহারানী অহিল্যাবাই হোলকারের নাম ভারতের ইতিহাসে সোনালী হরফে লেখা থাকবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *