সেনার সম্মান বৃদ্ধি প্রধান লক্ষ্য। ভারতীয় সেনাবাহিনীর নতুন অগ্নিপথ যোজনা আসলে কি?
রাজেশ রায়:— ভারতীয় সেনাবাহিনীতে নিয়োগের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ স্কীম এনেছে কেন্দ্রীয় সরকার যাকে অগ্নিপথ স্কীম বলা হচ্ছে। ইতিমধ্যে ক্যাবিনেট কমিটি এই স্কিম অ্যাপ্রুভ করেছে। আজ এই স্কিম সম্পর্কে যতটা সম্ভব বিস্তারিত আলোচনা করা হবে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিং এই স্কীমের সূচনা করেন যার লক্ষ সেনাবাহিনীর মধ্যে আপগ্রেডেশন আনা। ভারতের অনেক যুবক ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে চায়, রাজনাথ সিং জানান এই স্কিম তাদের জন্য বিশেষ ভাবে দরকারী। এই স্কিমে যারা পাশ করে সেনাবাহিনীতে যোগদান করবে তাদের অগ্নিবীর বলা হবে। রাজনাথ সিং এপ্রসঙ্গে জানান এবং আরও বলেন দেশে নতুন করে দশ লাখ চাকরি দেওয়া হবে। এই স্কীমে একজন সেনাকে ভাল মাইনে দেবার পাশাপাশি চারবছর পর অবসরের পর ভাল পয়সা দেওয়া হবে।
ভারতীয় সেনাবাহিনীতে কাজ করা গর্বের ব্যাপার, এখান থেকে অবসরের পরও একজন সেনার সম্মান অনেক বেড়ে যায়। আসলে এই স্কিমের প্রধান লক্ষ যে ভাবে দ্রুত মাইনে ও পেনশন বাড়ছে সেটা কম করা। তবে এই স্কিমে একটি সমস্যা আছে যেহেতু চার বছরের জন্য নিয়োগ করা হচ্ছে সেনাতে, তাই বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা সেনার মধ্যে দেশভক্তি কমে যেতে পারে। পাশাপাশি লড়াকু মানসিকতা, মিলিটারি আইন মানার বাধ্যবাধকতা কমে যেতে পারে। যার প্রভাব পড়বে ভারতের ১৪ লাখ বিশাল সেনাবাহিনীর মধ্যে। কিন্তু লেফটেন্যান্ট অনিল পুরী জানিয়েছেন এই স্কীমের লক্ষ ভবিষ্যতের জন্য সেনাবাহিনী তৈরি করা। তিনি বলেন এভাবে চার বছর পর যারা চাকরি ছেড়ে যাবে তারা সেনাবাহিনীর ট্রেনিং নিয়েই থাকবে, এভাবে ভবিষ্যতে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে দরকার পড়লে তাদের আবার ডাকা যাবে। অর্থাৎ চার বছর অন্তর অন্তর ভারতের একটি বড় সংখ্যক যুবক সেনা ট্রেনিং পাবে। তিনি আরও বলেন যে ব্যক্তি অগ্নিবীর হবে, চাকরি থেকে অবসরের পর তার বয়োডাটা অনেক বেশী আপগ্রেডেড হয়ে যাবে। ভবিষ্যত জীবনের জন্য চাকরি পাওয়া আরও সহজ হবে।
অগ্নিপথ একটি প্যান ইন্ডিয়া বেসড নিয়োগ পদ্ধতি হবে যাতে কেন্দ্রীয় সরকার নিয়োগ করেবে এবং এই অগ্নিবীররা ভারতীয় সেনাবাহিনী, বায়ুসেনা, নেভি তিন জায়গাতেই সার্ভিস করতে পারবে। এই স্কীমে বলা হয়েছে একজন অগ্নিবীর চার বছর ভারতীয় সেনাতে সার্ভিস করবে। এরপর দক্ষতার ভিত্তিতে ২৫ শতাংশকে পুনরায় ১৫ বছরের জন্য সেনাতে রাখা হবে। অর্থাৎ যদি ১০০০ জন অগ্নিবীর যোগদান করে তাহলে চার বছর পর ২৫ শতাংশ বা ২৫০ জনকে পরবর্তী ১৫ বছরের জন্য রাখা হবে। প্রথম চার বছর সবাইকে একটি চুক্তি ভিত্তিতে রাখা হবে, এদের কোন পেনশন দেওয়া হবে না। এই চার বছরের মধ্যে ট্রেনিং, সার্ভিস সবকীছুই যুক্ত আছে। ২৫ শতাংশ সেনাকে রাখার পর বাকী ৭৫ শতাংশ অগ্নিবীরকে অবসরে পাঠানো হবে যাদের ১২ লাখ টাকা দেওয়া হবে সেবা নিধি প্যাকেজ অনুযায়ী, স্কিল সার্টিফিকেট দেওয়া হবে এবং ব্যাঙ্ক লোনে বিশেষ সুবিধা দেওয়া হবে যাতে তারা তাদের দ্বিতীয় জীবন খুব ভাল ভাবে শুরু করতে পারে। অগ্নিবীর নিয়োগে বয়স হতে হবে সাড়ে সতেরো থেকে একুশ বছরের মধ্যে। তবে সরকার জানিয়েছে চার বছর পর কেউ যদি চায় স্বেচ্ছাসেবক হয়ে সেনাতে থাকতে পারে তবে তার জন্য তাকে বেতন দেওয়া হবে না। আগামী ৯০ দিনের মধ্যে প্রথম ব্যাচে অগ্নিবীর নিয়োগ করা হবে। একজন অগ্নিবীরের স্যালরি প্যাকেজ প্রতি মাসে ৩০,০০০ করে এবং সব মিলিয়ে বছরে ৪.৭৬ লাখ। তবে চতুর্থ বছরে এটা বেড়ে ৬.৯২ লাখ হয়ে যাবে। এই বেতনের উপর কোনও ইনকাম ট্যাক্স থাকবে না। ঈশ্বর না করুক যদি কোনও অগ্নিবীর বীরগতি প্রাপ্ত হন তাহলে তার বাকী সমস্ত স্যালারি প্যাকেজ তার পরিবারকে দিয়ে দেওয়া হবে। একজন রেগুলার সেনার মতই একজন অগ্নিবীর মেডেল, পুরস্কার সবই পাবে, পাশাপাশি ৪৮ লাখের জীবন বীমা সহ যদি বীরগতি প্রাপ্ত হয় তাহলে আরও ৪৪ লাখ অতিরিক্ত পাবে। সরকারের দাবি এই অগ্নিপথ স্কীমে আরি বেশী সংখ্যক ভারতীয় যুবক ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যুক্ত হতে পারবে কারন প্রতি চার বছর অন্তর অন্তর সেনাতে নিয়োগ হতেই থাকবে। এতে কী হবে ভবিষ্যতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর গড় বয়স ৩২ বছর থেকে কমে ২৬ বছর হয়ে যাবে। ৫০ বছর পর দেশের জনসংখ্যার বড় অংশ যখন বুড়ো হয়ে যাবে তখন সেনাবাহিনী তরুন ও মজবুত থাকবে। দেখুন এই স্কীমের প্রধান লক্ষ আধুনিক মিলিটারি ফোর্স গঠন এবং খরচ কম।
২০২০ তে ভারতের প্রতিরক্ষা বাজেট ছিল ৭২.৯ বিলিয়ন ডলার যেখানে চীনের ছিল ১৭৮ বিলিয়ন ডলার। এই ৭২.৯ বিলিয়ন ডলারের ৫৬ শতাংশ শুধু সেনাবাহিনী পেয়েছে যার মধ্যে ৩৮ বিলিয়ন ডলার শুধু পেনশন ও মাইনে দিতে খরচ হয়ে গেছে সুতরাং সেনাবাহিনীর উন্নতিতে মাত্র ৭ বিলিয়ন ডলার খরচ করা হয়েছে। এই জিনিসটা বন্ধ করার জন্যই অগ্নিপথ স্কীম চালু করা হয়েছে। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের এই স্কীমের সমালোচনা হচ্ছে চারিদিকে। লোক রীতিমতো রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করছে। অনেক প্রাক্তন সেনাসদস্য সরাসরি এর বিরোধীতা করেছেন। তাদের দাবি একজন সেনাকে ট্রেনিং দিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে নিয়োগে অন্তত ৭-৮ বছর লাগে। সেক্ষেত্রে চার বছরে কী করে সম্ভব?? এক্ষেত্রে সেই সেনাটি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ নাও করতে পারে কারন সে জানে চার বছর পর তাকে নতুন জীবন শুরু করতে হবে। আরও একজন জানিয়েছেন ভারতীয় সেনাবাহিনীতে একটি অলিখিত নিয়ম আছে নাম, নমক ও নিশান যার অর্থ একজন সেনা তার পল্টনের নাম, সম্মান বাঁচাতে নিজের জীবন বলিদান দিতেও প্রস্তত থাকে। কারগিল যুদ্ধে এভাবেই মরনপন লড়াই হয়েছে কিন্তু এই স্কীম সেনাবাহিনীর মধ্যে সেই লড়াকু মানসিকতা কমিয়ে দেবে। তবে আরও একটি সমস্যা আছে করোনা মহামারীর কারনে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে নিয়োগ পক্রিয়া দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল। যার জন্য ১১.৭৮ লাখের বিশাল সেনাবাহিনীতে সেনা সদস্য আরও দরকার। করোনার আগে অবধি প্রতি বছর গড়ে ৮১,০০০ সেনা নিয়োগ হয়েছে কিন্তু গত দুই বছর নিয়োগ না হওয়ায় ঘাটতি রয়েছে সেনাবাহিনীতে। যার জন্য অগ্নিপথ স্কীম তাড়াতাড়ি চালু করা হয়েছে। তবে এই স্কীম কতটা কার্যকারী হবে তা ভবিষ্যতই বলে দেবে। তবে একটা কথা ভেবে দেখুন দেশে বিভিন্ন জায়গায় এই স্কীম নিয়ে যে বিক্ষোভ চলছে তা কতটা প্রয়োজনীয়!!
দেখুন একজন অগ্নিবীর যখন ২২-২৪ বছর বয়সে অবসরে যাবে তখন তার কাছে মোটামুটি ৩০ লাখের কাছাকাছি পয়সা থাকবে যা দিয়ে সে ব্যাবসা করতে পারবে বর্তমানে দেশে ২২-২৪ বছর বয়সে কটা যুবকের কাছে এত টাকা আছে???? এছাড়াও বিভিন্ন রাজ্যের পুলিশ ডিপার্টমেন্ট, সিকিউরিটি গার্ডে অগ্নিবীরদের অগ্রাধিকার থাকবে। ২০১৩ এর এক সার্ভে অনুযায়ী দেশের মাত্র ২ শতাংশ যুবক ২৫ বছর বয়সে ১২ লাখ টাকার মতো সেভিংস করতে পারে। মাত্র ২ শতাংশ তাহলে ভেবে দেখুন একবার!! আসাম রাইফেলসে ভর্তির ক্ষেত্রেও অগ্নিবীরদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে, পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থায়ও এদের নিয়োগ করা হবে। সরকার এটাও জানিয়েছে যারা মাধ্যমিকের পর সেনাতে ভর্তি হবে তাদের উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষার জন্য বিশেষ কোর্সও থাকবে। আমেরিকাতেও এ ধরনের সিস্টেম আছে সেখানে ৮ বছর কাজ করবার পর ৮০ শতাংশ সেনা অবসরে যায়। তবে আজ যারা বিরোধীতা করছে অগ্নিপথ স্কীমের। তাদের কথাও শোনা দরকার। দেখুন ২০১৯ এ সেনাতে ভর্তি শুরু হয় কিন্তু পাশ করার পরও নিয়োগ হয়নি কারন করোনা মহামারীর কারনে। তাহলে ধরুন যে ছেলেটি ২০১৯ এ বয়স ছিল ২০ বছর তাহলে সে এখন ২০২২ এ কী করে সেনাতে যোগ দেবে? কারন অগ্নিবীরের বয়স লিমিট ২১ বছর!! সরকার জানিয়েছে আগে যারা পাশ করো চাকরি পায় নি মানে ২০১৯ এর কথা, সেসব পরীক্ষাকে বাতিল করা হয়েছে। তাহলে সেই সব ছাত্রদের কী হবে? অনেকে ২২ বছর বয়সেও প্রস্ততি নিচ্ছে পরীক্ষার তাদের কী হবে? এরকম সংখ্যাটা প্রচুর সুতরাং কেন্দ্রীয় সরকারকে ভাল ভাবে এই স্কীম পুনর্বিবেচনা করা দরকার। তবে অগ্নিপথ স্কীমে সবচেয়ে বড় আপডেট ভর্তি হবার বয়স বাড়িয়ে ২১ থেকে ২৩ করা হয়েছে যাতে বিক্ষোভ কীছুটা হলেও কমতে পারে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা।