পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন ধর্ম হিন্দুইজমের উৎপত্তি ও তার সামাজিক সিস্টেম
রাজেশ রায়:– সময়ের অগ্রগতির সাথে সাথে পৃথিবীতে বিভিন্ন ধর্ম বিস্তার লাভ করেছে। কাল খন্ডে অনেক মহাপুরুষ এই পৃথিবীর বুকে তাদের নানান মতবাদ প্রচার করে গেছেন। এদের মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন ধর্ম হচ্ছে এই হিন্দু ধর্ম। হিন্দু ধর্মকে কেও ধর্ম বলে তো কেউ জীবনের পথ। আজ এসম্পর্কেই বিস্তারিত আলোচনা করা হবে। যদি বলা হয় হিন্দু ধর্মের উৎপত্তি কবে তাহলে এর কোন সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না, এতটাই প্রাচীন এই ধর্ম। ঐতিহাসিকদের মতে আনুমানিক ৯০,০০০ বছরেরও পুরোনো তবে বেদ, উপনিষদ অনুযায়ী হিন্দু ধর্ম কয়েক লক্ষ বছরের পুরোনো, সুতরাং হিন্দু ধর্ম এতটাই প্রাচীন ধর্ম যার আদি খুঁজে পাওয়াই মুশকিল। গোটা বিশ্ব জুড়ে পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম ধর্ম হিন্দু ধর্মের অনুসারী সংখ্যা প্রায় ১০০ কোটি যার ৯০ শতাংশই ভারতে বসবাস করে। প্রাচীন হিন্দু ধর্মের মূল ভাষা ছিল সংস্কৃত যাকে দেবতাদের ভাষাও বলা হয়। প্রোটো ইন্দো আরিয়ান এবং প্রোটো ইন্দো ইউরোপীয়ান ভাষার উৎপত্তিও সংস্কৃত ভাষা থেকেই বলে মনে করা হয়। ইংরেজি ভাষায় হিন্দু ধর্ম কথাটি প্রথম চালু হয় উনবিংশ শতকে।
আচ্ছা সেই থেকে যে এতক্ষন হিন্দু ধর্ম বলছি আসলে হিন্দু ধর্ম নামকরন অনেক পরে হয়েছে এই ধর্মের আসল নাম সনাতন ধর্ম। এবার জানা যাক হিন্দু নামের কারন। উত্তর পশ্চিম ভারতে একটি বিখ্যাত নদী হচ্ছে সিন্ধু। যখন পারস্য জাতির লোকেরা ভারতে প্রবেশ করে তারা এই স উচ্চারন করতে পারত না, তারা স কে হ বলত। সেই হিসাবে এই নদীকে হিন্দু বলত এবং এখানকার ভূমিকে হিন্দুস্তান বলত এবং এর আশেপাশের মানুষদের হিন্দু বলত। এভাবে ছয় শতকে প্রথম হিন্দু শব্দের উৎপত্তি ঘটে পার্সিয়ানদের দ্বারা এবং মোটামুটি ১৩ শতকে ভারতের নাম হিন্দুস্তান হয়ে যায়। প্রথমে হিন্দু বলতে কোন বিশেষ ধর্মের লোকেদের বলা হতনা বরং ভারতী ভূমির সকল মানুষকে বোঝানো হত। পরে সপ্তম শতকে সর্বপ্রথম হিন্দুইজমের উল্লেখ পাওয়া যায় (যদিও একাধিক মতান্তর রয়েছে একাধিক ঐতিহাসিকবিদের মতে) একটি চাইনিজ বই রেকর্ড অফ দি ওয়েস্টার্ন রিজিয়নে। অনেকে আবার এটাও বলেন ১৮১৬ -১৭ সালে রাজা রামমোহন রায় সর্বপ্রথম এর উল্লেখ করেন। ১৮৩০ সাল থেকেই ব্রিটিশ কলোনীর মধ্যেই একদল ভারতী নিজেদের আলাদা প্রমান করবার জন্যই হিন্দু বলে নিজেদের পরিচয় দিতে শুরু করে। গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্ম গ্রন্থ শ্রী চৈতন্য ভাগবত ও চৈতন্য চরনামিত তে হিন্দু ধর্মের উল্লেখ করা হয়েছে, মূলত অন্য ধর্মের মানুষদের থেকে আলাদা বোঝাতেই সনাতন ধর্মের লোকেদের হিন্দু বলা হত। এটা তো গেল হিন্দু ও হিন্দুইজমের উৎপত্তির কারন। এবার যেটা প্রধান জিজ্ঞাসা থাকে, হিন্দু ধর্মের উৎপত্তি কীভাবে হল? হিন্দু ধর্ম কারও একজনের দ্বারা তৈরি হয়নি। সিন্ধু সভ্যতায় ভগবান শিবের পশুপতি রুপ, পৃথিবী মায়ের মুর্তি, স্বস্তিকা চিহ্ন পাওয়া গেছে সুতরাং তখনও হিন্দু ধর্ম ছিল। সাধারণ ভাবে হিন্দু ধর্মের উৎপত্তি বলতে বৈদিক কাল থেকেই মনে করা হয়। কিন্তু হিন্দু বা সনাতন ধর্মের সবচেয়ে প্রাচীন গ্রন্থ বেদ যেখানে সময়কে চার ভাগে ভাগ করা হয়েছে সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর ও কলি।
কাল হিসাবে একেকটি যুগ কয়েক লক্ষ বছর অবধি স্থায়ী থাকে। এখন কলি যুগ চলছে, এই হিসাবে সত্য যুগ থেকে এখন অন্তত ২৮-৩০ লাখ সাল অতিক্রম হয়েছে। আবার গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণই বলেছেন গীতার জ্ঞান তিনি সর্বপ্রথম সূর্যদেব বিবস্বানকে দিয়েছিলেন বারো কোটি বছর আগে। সুতরাং হিন্দু ধর্মের উৎপত্তি কবে এবং কে করেছিল সেটা খুঁজতে গেলে সারা জীবন লেগে যাবে তবুও হয়ত জানা যাবে না। হিন্দুইজমের চারটি মূল মতবাদ হচ্ছে কর্ম, আত্মা, পুনর্জন্ম ও মুক্তি। হিন্দু ধর্মে বিশ্বাস করা হয় প্রত্যেক জীবিত প্রানীর মধ্যেই আত্মা আছে যা মৃত্যুর সময় শরীর থেকে বেরিয়ে যায়। কর্মকে হিন্দু ধর্মে সবচেয়ে উচ্চ মানা হয়েছে, কারন মানুষ এজীবনে যা কর্ম করে তার ফল ভোগের জন্য তাকে নতুন শরীর ধারন করতে হয়, এখান থেকেই পুনর্জন্মের কথা এসেছে অর্থাৎ আত্মা শরীর ছেড়ে দেওয়ার পর আবারও নতুন শরীর ধারন করে এভাবে চক্রাকারে চলতেই থাকে। এভাবে কোনও এক জন্মে কর্ম বন্ধন ছিন্ন হয়ে গিয়ে আত্মা পরমাত্মায় মিশে যায় একেই মুক্তি বলা হয়েছে। হিন্দু ধর্মের সবচেয়ে প্রাচীন গ্রন্থ বেদ অনুযায়ী ইশ্বর নিরাকার, যার কোনও আকার নেই কিন্ত ইশ্বর বা পরম শক্তি যাকে নিরাকার ব্রহ্মা বলা হয়, মানুষের কল্যানে বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন রূপে আসেন পৃথিবীতে। হিন্দু ধর্মে প্রধানত তিনজন প্রধান ভগবানের কথা বলা হয়েছে, ব্রহ্মা সৃষ্টিকর্তা, বিষ্ণু পালন কর্তা এবং মহাদেব ধ্বংস কর্তা। হিন্দু ধর্মে নারীদের দেবী রুপে পূজা করা হয় প্রাচীন কাল থেকেই। যেমন দেবী দুর্গা, কালী, লক্ষী, সরস্বতী। শুধু তাই নয় হিন্দু ধর্মে প্রকৃতি ও জীবকেও পূজা করা হয় কারন বিশ্বাস করা হয় সমস্ত জীবের মধ্যেই ঈশ্বর আছেন। হিন্দু ধর্মে কোন নিদিষ্ট ধর্মগ্রন্থ নেই। আসলে এই ধর্ম এতটাই প্রাচীন যে বিশ্বাস করা হয় বেদই হিন্দুদের প্রাচীন ধর্ম গ্রন্থ যা দেবতারা মানুষদের দিয়েছিল। বেদের চারটি ভাগ ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ ও অথর্ববেদ। এই প্রতিটি বেদ আবার চার ভাগে বিভক্ত সংহিতা, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক ও উপনিষদ। এছাড়া রামায়ন, মহাভারত, ভগবত গীতা ও পুরান কে হিন্দু ধর্মের প্রধান গ্রন্থ হিসাবে মানা হয়। হিন্দু ধর্মে তিনটি প্রধান ভাগ আছে। বৈষ্ণব যারা ভগবান বিষ্ণু ও তার তার দশ অবতারের পুজো করে, শৈব যারা শিবের উপাসনা কর, শাক্ত যারা দেবী শক্তি বা মা কালীর উপাসনা করে। কিন্তু হিন্দু ধর্মের এই সমস্ত ভাগের মানুষদের মধ্যে কোন ঝামেলা নেই কারন সহ্যশক্তি হচ্ছে হিন্দু ধর্মের প্রধান ভিত্তি।
এতো গেল হিন্দু ধর্মের উৎপত্তি এবং ধর্মীয় বিশ্বাসের কথা এবার জানা যাক হিন্দু ধর্মের সামাজিক জীবন সম্পর্কে। ঋগ্বেদের পুরুষোক্ত থেকে জানা যায় সমাজের বনাশ্রম প্রথার কথা। বেদে সমাজকে চারটি শ্রেণীতে ভাগ করা হয়েছিল ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র। সত, ধার্মিক ব্যাক্তিকেই ব্রাহ্মন বলা হয়, যারা মানুষকে বিপদ থেকে রক্ষা করে তাদের ক্ষত্রিয়, ব্যাবসায়ী ও শিক্ষিত ব্যাক্তিদের বৈশ্য এবং বাকী মানুষদের শূদ্র বলা হত। এই ভাগ হয়েছিল কর্মের ভিত্তিতে।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন মানুষের কর্মই সমাজে তার শ্রেণী নির্বাচন করে। কিন্তু ধীরে ধীরে সময়ের সাথে কিছু অসাধু মানুষ জন্মের ভিত্তিতেই এই শ্রেনী নির্বাচন শুরু করে। একটা সময় ভারতে বৌদ্ধ ধর্ম ও জৈন ধর্মের ব্যাপক বিস্তার ঘটেছিল। ঠিক এমন সময়ে অষ্টম শতকে হিন্দু ধর্মের পুনর্জাগরনের কাজ শুরু করে আদি শঙ্করাচার্য। বলা হয় তিনি ভগবান শিবের অবতার। আদি শঙ্করাচার্য ভারত ভ্রমন করে বিভিন্ন প্রান্তে চারটি গুরুত্বপূর্ণ মঠ তৈরি করেন যেমন দক্ষিনে শ্রীঙ্গিরে সারদা মঠ, পশ্চিমে দ্বারকায় কালিকা মঠ, উত্তরে বদ্রীনাথের কাছে যোশীমঠ এবং পূর্বে পুরীতে গোবর্ধন মঠ। একে হিন্দু ধর্মের চার ধাম বলা হয়। এভাবে যুগে যুগে বিভিন্ন মহাত্মা দ্বারা হিন্দু ধর্মের পুনর্জাগরণ চলতেই থাকে, বারো শতক থেকে ১৮ শতক পর্যন্ত। হিন্দু ধর্মে এটা বলা হয়েছে যখনই ধর্ম সংকট উপস্থিত হয়েছে তখনই ইশ্বর কোনও না কোনও রুপ নিয়ে আবির্ভূত হয়েছেন।