ডিফেন্স

২০২৫ এর মধ্যে আবারও চাঁদের মাটিতে পা রাখবে মানুষ। ভবিষ্যতে চাঁদে হতে চলা কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্পেশ পোগ্রাম

রাজেশ রায়:– সময়ের সাথে মনুষ্য সভ্যতা যত উন্নত হয়েছে তত অজানা কে জানার আগ্রহ বেড়েছে মানুষের। উনবিংশ শতকে বিজ্ঞান ও টেকনোলজির অভূতপূর্ব উন্নতির ফলে মানুষের জ্ঞানের পরিধি পৃথিবী ছাড়িয়ে মহাকাশ পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে তো মহাকাশ বিজ্ঞান নিয়ে রীতিমতো প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছিল। সে যাই হোক মহাকাশ বিজ্ঞান নিয়ে না হয় অন্য কোনোওদিন আলোচনা করা যাবে, আজ বরং আমর আলোচনা করব পৃথিবীর একমাত্র উপগ্রহ চাঁদ নিয়ে। চাঁদ নিয়ে মানুষের জিজ্ঞেসা কিছু নতুন না, সেই সুপ্রাচীন কাল থেকে মানুষ চাঁদ কে পুজো করে আসছে। চাঁদ নিয়ে মানুষের আগ্রহ এতটাই যে বর্তমানে তো রীতিমতো চাঁদে জমি কেনার প্রতিযোগিতা চলছে। আজ আমরা আলোচনা করব পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মহাকাশ সংস্থার চাঁদের বুকে অবতরনের জন্য বিভিন্ন মিশনের ব্যাপারে। এখনও পর্যন্ত মাত্র তিনটি দেশ চাঁদের বুকে তাদের মহাকাশযান নামাতে পেরেছে আমেরিকা, সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং চীন। বিশ্বজুড়ে অনেক মহাকাশ সংস্থা নিরন্তর চেষ্টা করে চলেছে চাঁদে পৌঁছানোর। আজ মূলত তিনটি দেশের চাঁদে ল্যান্ডিং এর মিশনের ব্যাপারে আলোচনা করব। ভারতের মহাকাশ সংস্থা ইসরোর চন্দ্রায়ন – ৩, আমেরিকার নাসার ভাইপার ও ইসরায়েলের বিয়ারসিট- ২।

প্রথমেই আলোচনা করব ভারতের চন্দ্রায়ন -৩-  আগস্ট, ২০২২ এ এই মিশন লঞ্চ হওয়ার কথা, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ডঃ জিতেন্দ্র সিং এই ব্যাপারে জানান। চন্দ্রযান -৩ এই সিরিজের তৃতীয় লুনার মিশন, এর আগে ইতিমধ্যে ইসরো চন্দ্রযান- ১, চন্দ্রযান- ২ মিশন করেছে। ২০১৯ সালে ইসরো চন্দ্রযান-২ মিশন লঞ্চ করে কিন্তু একদম শেষ মহূর্তে চন্দ্রযান -২ চাঁদের বুকে সফট ল্যান্ডিং করতে পারে নি কারন এর গাইডেন্স সফটওয়্যারের সমস্যার কারনে এটি চাঁদে ক্রাশ ল্যান্ডিং করে। যার জন্য চন্দ্রায়ান-২ এর একটি অংশ সফল হয় নি। এই ব্যার্থতা থেকে নতুন করে শুরু করে ইসরো চন্দ্রায়ন -৩ লঞ্চ করতে চলেছে। চন্দ্রায়ন সিরিজের সূচনা হয় ২০০৮ সালে চন্দ্রায়ন -১ লঞ্চের মাধ্যমে। চন্দ্রয়ান -১ এর সবচেয়ে বড় সাফল্য এটা যে চাঁদের বুকে জলের অস্তিত্বের প্রমান দেওয়া। আগস্ট ২৯, ২০০৯ এ চন্দ্রায়ন -১ এর সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তবে এর আগে চন্দ্রায়ন -১ চাঁদকে অন্তত ৩৪০০ বার প্রদক্ষিন করে প্রচুর তথ্য পাঠিয়েছিল ইসরো কে। এই মিশনকে যথেষ্ট সফল মানা হয়। চন্দ্রযান -১ মিশনের সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে ইসরো চন্দ্রায়ন -২ মিশন লন্চ করে। এই মিশনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল চাঁদের বুকে অবতরন। চন্দ্রায়ন-২ এর তিনটি প্রধান অংশ ছিল অরবিটার, ভিক্রম ল্যান্ডার ও প্রোগ্যান রোভার। জিএসএলভি রকেটে লঞ্চ করার পর চন্দ্রায়ন -২ চাঁদের কাছে পৌঁছানোর পর এর অরবিটার অংশ আলাদা হয়ে গিয়ে চাঁদের কক্ষপথে উপগ্রহের মত চাঁদের চারপাশে প্রদক্ষিণ করতে থাকে ও তথ্য পাঠাতে থাকে। চন্দ্রায়ন -২ এর ল্যান্ডার অংশ যার নাম ছিল বিক্রম, যা ভারতের মহাকাশ মিশনের জনক বিক্রম সারাভাইয়ের নাম অনুসারে রাখা হয়েছিল। অরবিটার চাঁদের কক্ষপথে স্থাপনের পর এই ল্যান্ডারের দায়িত্ব ছিল চাঁদের বুকে সফট ল্যান্ডিং করার এবং ল্যান্ডিং এর পর এর ভিতর থেকে একটি ছোট গাড়ি বেরিয়ে চাঁদের বুকে বিভিন্ন নমুনা সংগ্রহ করবার কথা ছিল যাকে প্রগ্যান রোভার বলা হয়। কিন্তু ল্যান্ড করবার কয়েক সেকেন্ড আগে সফটওয়্যার এর সমস্যার কারনে ক্রাশ ল্যান্ড হয়ে যায় সোজা ভাষায়। বিক্রম ল্যান্ডার চাদের বুকে ধীরে ধীরে ল্যান্ডিং করবার দরকার ছিল কিন্তু এটি পূর্ন গতিতে আছড়ে পড়ে যার জন্য এটি নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু চন্দ্রায়ন -২ এর অরবিটার অংশ আজও চাঁদের প্রদক্ষিণ করে ইসরো কে তথ্য পাঠিয়ে যাচ্ছে যার জন্য চন্দ্রায়ন-২ মিশনকে পুরোপুরি ব্যার্থ মিশন বলা যায় না, অর্ধেক সফল মিশন বলা হয়। সেপ্টেম্বর, ২০১৯ এই এটা ঘোষনা করা হয়েছিল চন্দ্রায়ন -৩ হবে। চন্দ্রযান -৩ তেও চন্দ্রযান ২ এর মতন ল্যান্ডার, রোভার থাকবে। তবে এই ল্যান্ডার আরও অত্যাধুনিক হবে। চন্দ্রযান -২ তে তিনটি প্রধান অংশ ছিল অরবিটার, ল্যান্ডার ও রোভার। কিন্তু চন্দ্রযান -৩ তে দুটি অংশ থাকবে ল্যান্ডার ও রোভার। এতে অরবিটার থাকবে না, কারন চন্দ্রযান -২ এর অরবিটার ইতিমধ্যে রয়েছে চাদের কক্ষপথে। অরবিটার মূলত একটি কমিউনিকেশন ডিভাইস। চাঁদের বুকে থাকা ল্যান্ডার ও রোভার থেকে সিগন্যাল নিয়ে পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ করাই অরবিটারের কাজ। জিসএলভি মার্ক ৩ রকেটে চন্দ্রায়ন ৩ লঞ্চ করা হবে যা চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে ল্যান্ড করবে। চন্দ্রায়ন ৩ এর মোট খরচ প্রায় ৮১ মিলিয়ন ডলার বা ৬১৫ কোটি টাকা।

এবার আসা যাক আমেরিকার মহাকাশ সংস্থা নাসার ভাইপার মিশনের ব্যাপারে। ভাইপার যার পুরো অর্থ ভোলাটাইলস ইনভেস্টিগেটিং পোলার এক্সপ্লোরেশন রোভার। আসলে ভাইপার নাসার আর্টিমিস লুনার মিশনের অংশ। ভারতের চন্দ্রযান-২ এ যেমন প্রগ্যান রোভার ছিল তেমনি নাসার এই রোভারের নাম ভাইপার। একটি ছোট গাড়ির মত এই রোভারে সোলার প্যানেল রয়েছে যা সূর্যের আলো থেকে ইলেকট্রিসিটি উৎপন্ন করতে সক্ষম।  এতে একটি লাইট রয়েছে যা চাদের মাটি থেকে স্যাম্পেল সংগ্রহ করার কাজে ব্যবহৃত হবে। চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে এটি ল্যান্ড করবে। চাঁদের দক্ষিণ মেরু হচ্ছে সবচেয়ে জটিল জায়গা, এখানে সূর্যের আলো তেমন পৌঁছায় না। সুতরাং এখানে মিশন পরিচালনা খুবই জটিল। নাসা আর্টিমিস হিউম্যান স্পেস মিশন করতে চলেছে যার উদ্দেশ্য ২০২৫ এর মধ্যে চাঁদের মাটিতে আবারও মানুষকে পৌঁছানো। ১৯৭২ সালে নাসার অ্যাপোলো ১৭ মিশনে প্রথম মানুষ নীল আর্মস্ট্রং চাঁদের মাটিতে পা রেখেছিল, তারপর ৫৩ বছর পর আবার হিউ্যান লুনার মিশন করতে চলেছে নাসা। ২০১৭ সাল থেকে শুরু হওয়া এই মিশনের শুধু ২০২০ থেকে ২০২৪ এর মধ্যে এই আর্টিমিস মিশনের টোটাল খরচ প্রায় ৩৫ বিলিয়ন ডলার। নাসার আংশিক রিইউসেবল(পুনরায় ব্যবহার যোগ্য) মহাকাশযান ওরিয়ন এই আর্টিমিস মিশনকে লঞ্চ করবে। আমেরিকার অ্যাভিয়েশন জায়ান্ট লকহিড মার্টিনের তৈরি এই ওরিয়ন মহাকাশযান তৈরি করে এয়ারবাস।

আর্টিমিস মিশন তিনভাগে বিভক্ত আর্টিমিস ১, আর্টিমিস ২ ও আর্টিমিস ৩. আর্টিমিস ১ হবে রবোটিক মিশন মানে এটা যাস্ট টেস্টিং, এতে কোনও মানুষ যাবে না। ২০২২ এর মে মাসে এটি লঞ্চ হবে। ২০২৪ এ আর্টিমিস ২ লঞ্চ হবে, এতে মানুষ থাকবে। তবে এটি চাদে ল্যান্ড করবে না বরং চাঁদের চারদিকে প্রদক্ষিণ করে পৃথিবীতে ফিরে আসবে। এরপর ২০২৫ এ আর্টিমিস ৩ লঞ্চ হবে যাতে অভিযাত্রীরা চাদের মাটিতে নামবে। আর্টিমিস মিশনের মাধ্যমে নাসা চাঁদের মাটিতে বিশ্বের প্রথম কোন মহিলাকে নামাতে চলেছে।

চন্দ্রযান ৩, আর্টিমিস এর মতই বিয়ারসিট ২ একটি লুনার মিশন। এটি ইসরায়েলের একটি প্রাইভেট মিশন যা স্পেশআইএল নামক সংস্থা এবং ইসরায়েল এরোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিজ যৌথ ভাবে করতে চলেছে। ফেব্রুয়ারী, ২০১৯ এ আমেরিকার কেপ ক্যানাভেরাল থেকে স্পেশ এক্স এর ফ্যালকন ৯ রকেটে করে এটা লঞ্চ করা হয়। এপ্রিল মাসের মধ্যে এটি চাঁদের কক্ষপথে পৌঁছেও যায় কিন্তু এটিও সেই চন্দ্রযান ২ এর মত শেষ মুহুর্তে ধ্বংস হয়ে যায়। বিয়ারসিট ১ চাঁদে নামার কিছু মহূর্ত আগে ইন্জিন সমস্যার কারনে ক্রাশ ল্যান্ডিং করে। তাই এবার আরও অত্যুয়াধুনিক বিয়ারসিট-২ পাঠাবে ইসরায়েল যাতে দুটো ল্যান্ডাট থাকবে যাতে একটা ধ্বংস হলেও আরেকটা থাকে। ইসরায়েল এই বিয়ারসিট মিশনের একটি বড় উদ্দেশ্য তরুন ইসরায়েলি প্রজন্মকে ম্যাথ, স্পেশ, সায়েন্স, টেকনোলজি ও রকেট সায়েন্স ফিল্ডে আগ্রহী করে তোলা। ২০২৪ এ এই বিয়ারসিট ২ মিশন লন্চ হবে। ২০২০ এর ৯ ডিসেম্বর ইসরায়েল এই মিশনের ব্যাপারে ঘোষনা করে। এই মিশনের টোটাল খরচ ১০০ মিলিয়ন ডলার। 

এছাড়াও সংযুক্ত আরব আমিরশাহি ২০২৪ এ একটি লুনার স্পেস মিশন করতে চলেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *