ভারতবর্ষের হাতে থাকা রাশিয়ান এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম নাকি ইসরায়েলের সাথে যৌথ উদ্যোগে তৈরি এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম। চীনের বিরুদ্ধে কোনটি বেশি কার্যকারী?
রাজেশ রায়:– বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম সেরা কয়েকটি এয়ারডিফেন্স সিস্টেম গুলি হচ্ছে রাশিয়ান এস-৪০০, আমেরিকার থাড, ভারত ও ইজরায়েলের যৌথ তৈরি এমআরএসএম বা বারাক-৮ এবং ইজরায়েলের আয়রন ডোম। এদের মধ্যে এস ৪০০ ও এমআরএসএম ইতিমধ্যে ভারতের কাছে রয়েছে। আজ এই দুটি সিস্টেম সম্পর্কেই বিস্তারিত আলোচনা করব সাথো এই দুটি সিস্টেমের মধ্যে মূল পার্থক্য বলা হবে।
প্রথমেই জানা যাক রাশিয়ার তৈরি সুপার অ্যাডভান্সড এয়ারডিফেন্স সিস্টেম এস-৪০০ সম্পর্কে। এস -৪০০ ট্রাম্ফ, যার ন্যাটো নাম এসএ-২১ গ্রাউলার, কে এই মহূর্তে বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম বলা হয়, তবে রাশিয়া এস-৪০০ এর থেকেও অ্যাডভান্সড এস-৫০০ তৈরি করে ফেলেছে। রাশিয়ান সংস্থা আলমেজ এন্টির তৈরি এই সিস্টেম সর্বপ্রথম সার্ভিসে আসে ২০০৭ সালের ২৮ এপ্রিল। ১৯৮০ সালেই এই সিস্টেম তৈরির কাজ শুরু হয়। ১৯৯৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারী রাশিয়ার কাপুস্তিন ইয়ারে এটির সফল পরীক্ষা করা হয়। এস-৪০০, এস -৩০০ এর আপগ্রেডেড ভার্সন যা ক্রুজ মিসাইল, ব্যালেস্টিক মিসাইল, যুদ্ধবিমান, ড্রোন ধ্বংস করতে সক্ষম। এস-৪০০ এ চার ধরনের মিসাইল রয়েছে।
১) ৯ এম ৯৬ ই , এর রেঞ্জ ৪০ কিলোমিটার।
২) ৯ এম ৯৬ ই ২, এর রেঞ্জ ১২০ কিলোমিটার।
৩) ৪৮ এন ৬, এর রেঞ্জ ২০০-২৫০ কিলোমিটার।
৪) ৪০ এন ৬ ই, এর রেঞ্জ ৪০০ কিলোমিটার। এটিই এস-৪০০ এর প্রধান মিসাইল।
এস ৪০০ একটি মোবাইল মিসাইল সিস্টেম অর্থাৎ এই গোটা মিসাইল সিস্টেম কয়েকটি ভাগে বিভক্ত এবং গাড়ি করে যে কোনও জায়গায় একে মাত্র দশ মিনিটে ইনস্টল করা সম্ভব। ২০১৫ সালে এই মিসাইলটির পরীক্ষা করা হয়। পুরো এস -৪০০ মিসাইল সিস্টেমটির বিভিন্ন ভাগ গুলো সম্পর্কে জানা যাক:–
৯১ এন ৬ ই প্যানোরোমিক রেডার:— এস -৪০০ এর প্রধান রেডার এটিই। এর সারভিলেন্স রেঞ্জ ৬০০ কিলোমিটার কিন্তু কার্যকারী রেঞ্জ ৪০০ কিলোমিটার। আসলে এই রেডার ৬০০ কিলোমিটার দূর থেকে শত্রু মিসাইল, ড্রোন, বিমানকে শনাক্ত করতে পারে কিন্তু ৪০০ কিলোমিটারের মধ্যে এলে তখন টার্গেট করে। এস-৪০০ এর রেঞ্জ ৪০০ কিলোমিটার হলেও বিভিন্ন টার্গেটের জন্য এর রেঞ্জ আলাদা। ব্যালেস্টিক মিসাইল এর জন্য রেঞ্জ ২০০ কিলোমিটার, যুদ্ধবিমানের জন্য ৩৯০ কিলোমিটার এবং স্ট্রাটেজিক বোম্বারের মতন বড় যুদ্ধ জাহাজের জন্য ৪০০ কিলোমিটার। এস-৪০০ এর সারভিলেন্স রেডার প্রথমে টার্গেট কে খোঁজে এবং টার্গেটকে খুঁজে পেলেই সিগন্যাল পাঠায় ফায়ার কন্ট্রোল রেডারকে। ফায়ার কন্ট্রোল রেডারের আদেশেই এস-৪০০ এর লঞ্চার মিসাইল লঞ্চ করে এবং মিসাইল টার্গেট কে ধ্বংস করেছে কীনা তা নজরে রাখে একটি কম্যান্ড সেন্টার। এগুলো সব বিশেষ ট্রাকের উপর ইনস্টল করা থাকে। এই ভাবে পুরো এস-৪০০ মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেম সারভিলেন্স রেডার, ফায়ার কন্ট্রোল রেডার, কম্যান্ড সিস্টেম এবং মিসাইল লঞ্চার টিউব সহ চারটি ভাগে বিভক্ত। এস-৪০০ সবচেয়ে ঘাতক বলা হয় কারন এটি পঞ্চম প্রজন্মের স্টেলথ বিমানকেও ধ্বংস করতে সক্ষম। এস-৪০০ এর মিসাইলের গতি ১৫ ম্যাক মানে এক সেকেন্ডে পাচ কিলোমিটার। বর্তমানে সবচেয়ে অ্যাডভান্সড যুদ্ধবিমানের গতি ৩ ম্যাক বা এক সেকেন্ডে ১ কিলোমিটার। সুতরাং বুঝতেই পারছেন এস-৪০০ কতোটা ঘাতক। এস-৪০০ এর জন্য একটি ট্রাকে চারটি লঞ্চার টিউব থাকে যাকে ক্যানিস্টার বলা হয়। এমন চারটি ট্রাক যুক্ত লঞ্চার বা ১৬ টি টিউব কে বলা হয় এক ব্যাটারি। ২ ব্যাটারি এস ৪০০ কে এক রেজিমেন্ট বা এক ব্যাটেলিয়ন বলা হয়। অর্থাৎ এক রেজিমেন্ট এস ৪০০= ৩২ টি মিসাইল লঞ্চার যাতে ৩২ টি মিসাইল থাকে। ২০১৮ তে রাশিয়ান প্রসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ভারত সফরে ভারত রাশিয়ার সাথে ৪০,০০০ কোটি বা ৫.৫ বিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে ৫ রেজিমেন্টে এস -৪০০ কেনে যার প্রথম রেজিমেন্টের ডেলিভারি শুরু হয়ে গেছে। অর্থাৎ ভারত ৫×৩২= ১৬০ মিসাইল লঞ্চার কিনছে। ভারত আরও ১০০০ টি মিসাইল অতিরিক্ত কিনেছে। এস-৪০০ দুটো মিসাইল একসাথে ফায়ার করে যদি একটা থেকে কোনও রকমে বেঁচে যায় টার্গেট তাহলে দ্বিতীয়টা নিশ্চিত হিট করবে। ভারত ৫ রেজিমেন্ট এস-৪০০ এর ৩ রেজিমেন্ট পাকিস্তান সীমান্তে এবং ২ রেজিমেন্ট চীন সীমান্তে মোতায়েন করতে পারে বলে মত বিশেষজ্ঞদের। চীন নিজেও এস-৪০০ কিনেছে তাহলে আপনাদের মনে হতেই পারে একই সিস্টেম ভারত কেনো কিনল? দেখুন চীন যে এস-৪০০ কিনেছে তা ২০১০ এর মডেল কিন্তু ভারত যে এস-৪০০ কিনেছে তা একেবারে লেটেস্ট ২০২০ এর মডেল। এছাড়াও চীন এমটিসিআর সদস্য নয় কিন্তু ভারত এর সদস্য। এমটিসিআর বা মিসাইল টেকনোলজি কন্ট্রোল রেজিম একটি আন্তর্জাতিক সংস্থান এর সদস্য না হলে কোন দেশ অন্য দেশ থেকে ৩০০ কিলোমিটারের বেশী রেঞ্জের মিসাইল কিনতে পারবে না। যার জন্য চীন এস ৪০০ এর প্রধান মিসাইল ৪০ এন ৬ ই পায় নি চীন যা ভারত পেয়েছে সুতরাং ভারতীয় এস-৪০০ সিস্টেম চীনের তুলনায় অনেক অ্যাডভান্সড। ভারতের প্রধান শত্রু চীন ও পাকিস্তান। পাকিস্তানের প্রায় ২০ স্কোয়াড্রন যুদ্ধবিমান এবং চীনের প্রায় ১৭০০ যুদ্ধবিমান রয়েছে। সবথেকে বড় কথা চীনের পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধবিমান জে-২০ ও জে-৩১ আছে তাই ভারতের এস-৪০০ সিস্টেম দরকার।
এবার জানা যাক বারাক ৮ বা এমআরস্যাম সম্পর্কে। ইসরায়েলি হিব্রু ভাষায় বারাক শব্দের অর্থ লাইটনিং বা বজ্রপাত। এটি ভারত ও ইসরায়েলের যৌথ প্রজেক্ট। এয়ারক্রাফট, হেলিকপ্টার, ড্রোন সহ অ্যান্টিশিপ মিসাইল কে ধ্বংস করতে সক্ষম এই সিস্টেম ল্যান্ড ও নেভি উভয় ক্ষেত্রেই ব্যবহার করা সম্ভব। ইসরায়েলি এরোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিজ, এলবিট সিস্টেম, রাফায়েল অ্যাডভান্সড ডিফেন্স সিস্টেম ও ভারতের ডিআরডিও যৌথভাবে এটি তৈরি করেছে। বারাক-১ মিসাইলের উপর বেসড করে এই সিস্টেম তৈরি করা হয়েছে। নভেম্বর, ২০০৯ এ ভারত ও ইসরায়েলের মধ্যে ১.১ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি হয় ট্যাকটিক্যাল বারাক-৮ মিসাইল সাপ্লাইয়ের জন্য। ২০১৭ সালের মে মাসে ভারতীয় নৌবাহিনীর চারটি জাহাজের জন্য বারাক-৮ এর চুক্তি হয় ইসরায়েলের সাথে। ২০১৮ সালে আবারও ১.২৮ বিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে শিবালিক ক্লাস ফ্রিগেট গুলোর জন্য সাতটি বারাক-৮ সিস্টেমের চুক্তি হয়। ৪.৫ মিটার দৈর্ঘ্যের বারাক-৮ সিস্টেমের ওজন ২৭৫ কেজি এবং এর ওয়ারহেডের ওজন ৬০ কেজি। বারাক-৮ সিস্টেমের কয়েকটি বিশেষত্ব হচ্ছে :- ১) টু ওয়ে ডাটা লিংক সিস্টেম ২) অ্যাক্টিভ রেডার সিকার মিসাইল ৩) ৩৬০ ডিগ্রি কভারেজ ৪) স্মোকলেস প্রোপালশন ৫) থ্রাস্ট ভেক্টর কন্ট্রোল ৬) ডুয়াল পালস প্রোপালশন ৭) ভারটিকেল লঞ্চ ৮) পয়েন্ট ডিফেন্স বারাক- ৮ একটি মাল্টি লেয়ার এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম যার তিনটি ভাগ রয়েছে মিডিয়াম রেঞ্জ স্যাম যার রেঞ্জ ৭০ কিলোমিটার, লং রেঞ্জ স্যাম যার রেঞ্জ ১০০ কিলোমিটার এবং এক্সটেন্ডেড রেঞ্জ স্যাম যার রেঞ্জ ১৫০ কিলোমিটার। ভারত বারাক-৮ এর ল্যান্ড ও নেভাল দুটি ভার্সনই ব্যবহার করে। বারাক-৮ এর ল্যান্ড বেসড ভার্সনকে এম আর স্যাম বা মিডিয়াম রেঞ্জ স্যাম বলা হয়। ভারতীয় সেনাবাহিনী ২.২ বিলিয়ন ডলার বা ১৭,০০০ কোটি টাকার বিনিময়ে পাঁচ রেজিমেন্ট এম আর স্যাম অর্ডার দিয়েছে। ২০২৩ সালের মধ্যে পুরো ডেলিভারি কমপ্লিট হবে। এম আর স্যামের প্রতিটি লঞ্চারে আটটি মিসাইল থাকে অর্থাৎ ভারতের পাচ রেজিমেন্টে ৪০ লঞ্চার থাকবে যাতে ৪০×৮= ৩২০ টি মিসাইল সবসময় রেডি টু ফায়ার মোডে থাকবে। এম আর স্যামের গতি তিন ম্যাক বা সেকেন্ডে এক কিলোমিটার। জুলাই,২০১৯ এ ভারতীয় সেনাবাহিনী ও বায়ুসেনা ১০০০ টি এম আর স্যামের জন্য কল্যানী রাফায়েল অ্যাডভান্সড সিস্টেমের সাথে ১০০ মিলিয়ন ডলারের চুক্তি করে। ভারতীয় কল্যানী ও ইসরায়েলি রাফায়েল অ্যাডভান্সড ডিফেন্স সিস্টেমের যৌথ সংস্থা এই কল্যানস রাফায়েল অ্যাডভান্সড সিস্টেম। এদের প্ল্যান্ট তেলেঙ্গানার হায়দ্রাবাদে অবস্থিত। গত ২৭ মার্চ বালসোরের ইন্ট্রিগেটেড টেস্ট রেঞ্জ থেকে দুটি এম আর স্যামের সফল পরীক্ষা করা হয়। ভারত সহ ইসরায়েল, আজারবাইজান বারাক-৮ ব্যাবহার করে। ভারতের কলকাতা ক্লাস ডেস্ট্রয়ার, বিশাখাপত্তনম ক্লাস ডেস্ট্রয়ার, শিবালিক ও নীলগিরি ক্লাস ফ্রিগেট এবং আই আন এস বিক্রমাদিত্যে এই সিস্টেম ব্যবহার করা হচ্ছে।
এবার জানা যাক এস-৪০০ ও বারাক ৮ মিসাইল ডিফেন্স সিস্টেমের মধ্যে পার্থক্য কী :—
** বারাক ৮ ও এস ৪০০ এর মধ্যে তুলনা কখনওই করা উচিত না। কারন এস ৪০০ একটি কমপ্লিট এয়ারডিফেন্স প্যাকেজ, অন্যদিকে বারাক ৮ শিপ বেসড এয়ারডিফেন্স সিস্টেম।
** এস ৪০০ লং রেঞ্জ এয়ারডিফেন্স সিস্টেম যার রেঞ্জ ৪০০ কিলোমিটার কিন্তু বারাক-৮ এর সর্বোচ্চ রেঞ্জ ১২০ থেকে ১৫০ কিলোমিটার। যার জন্য বারাক-৮ মিডিয়াম রেঞ্জ এয়ারডিফেন্স সিস্টেম।
** এস ৪০০ এর রেডার ৬০০ কিলোমিটার পর্যন্ত সারভিলেন্স করতে পারে কিন্তু বারাক-৮ এর রেডার রেঞ্জ ১৫০ কিলোমিটার।
** বারাক -৮ এ একরকম মিসাইলই ব্যবহার করা হয় কিন্তু এস -৪০০ এ শর্ট রেঞ্জ, মিডিয়াম রেঞ্জ, লং রেঞ্জ সহ চারটি মিসাইল আছে। যা পুরো কমপ্লিট এয়ারডিফেন্স সিস্টেম।
** বারাক-৮ এর মিসাইলের গতি ৩ ম্যাক যেখানে এস -৪০০ এর গতি ১৫ ম্যাক।
** এস-৪০০ যেখানে চার লেয়ারড এয়ারডিফেন্স সিস্টেম, বারাক-৮ সিংগেল লেয়ারড এয়ারডিফেন্স সিস্টেম।
** এস ৪০০ স্টেলথ টার্গেট কে ধ্বংস করতে সক্ষম।
তবে বারাক-৮ স্ট্রাটেজিক্যালি আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কারন চীনের কাছে এস-৪০০ আছে কিন্তু বারক-৮ সম্পূর্ণ একটি নতুন সিস্টেম এবং ইসরায়েলি প্রযুক্তি যুক্ত তাই পাকিস্তান ও চীনের বর্ডারে এম আর স্যাম ব্যাপক এফেক্টিভ হবে।