চীনের নেভাল ফ্লীটকে কাউন্টার করতে অগ্রিম চতুর্থ প্রজন্মের যুদ্ধবিমান তৈরি হচ্ছে ভারতবর্ষের মাটিতে
রাজেশ রায়:– ভারতের ভবিষ্যতের কয়েকটি যুদ্ধবিমান প্রজেক্টের অন্যতম হচ্ছে টিডিবিএফ। টিডিবিএফ বা টুয়াইন ইন্জিন ডেক বেসড ফাইটার জেটকে ভারতীয় নেভির ভবিষ্যত বলা হয়। আজ এই প্রজেক্ট সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব।
হিন্দুস্তান এরোনটিকস লিমিটেড বা হ্যালের দ্বারা তৈরি টিডিবিএফ মূলত ভারতীয় নৌবাহিনীর জন্য তৈরি হচ্ছে। ভারতীয় নৌবাহিনীতে থাকা এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার থেকে অপারেশনের জন্য এই বিমান ডিজাইন করা হয়েছে। টিডিবিএফ সম্পর্কে একটু জানা যাক টিডিবিএফ প্রজেক্ট হ্যাল ও এডিএ এর যৌথ প্রজেক্ট। ২০২০ সালে এই প্রজেক্ট শুরু করা হয়। ভারতীয় নেভি নেভাল এলসিএ বিমান বাতিল করে দিলে এই প্রজেক্ট শুরু করা হয়। ২০২৬ সালে এই বিমানের প্রথম প্রোটোটাইপ তৈরি করার লক্ষ্য আছে হ্যালের। ২০৩২ এর মধ্যে টিডিবিএফের ফুল প্রোডাকশন শুরু হবে। এই পোগ্রামের জন্য ভারত সরকার ১৩,০০০ কোটি টাকা বাজেট দিতে চলেছে। আমেরিকার জেনারেল ইলেকট্রিকের দুটি এফ-৪১৪ ইঞ্জিন এতে ব্যাবহার করা হবে যার প্রত্যেকটি ৯৮ কিলো নিউটন থ্রাস্ট উৎপন্ন করতে সক্ষম। এর সর্বোচ্চ গতি ১.৬ ম্যাক বা ১৯৭৫ কিলোমিটার হতে চলেছে। টিডিবিএফে রেডার হিসাবে ডিআরডিওর উত্তম এসা রেডার ব্যবহার করা হবে।
ভারতের টিডিবিএফ পোগ্রামের দরকার কেন পড়ল? বর্তমানে ভারতীয় নেভির এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারে রাশিয়ান মিগ-২৯ কে এয়ারক্রাফট ব্যবহার করা হয় কিন্তু মিগ-২৯ পুরোনো হয়ে গেছে। বর্তমানে আরও অ্যাডভান্সড টেকনোলজি যুক্ত আধুনিক যুদ্ধবিমান তৈরি হয়ে গেছে। মিগ -২৯ কে ভারত যথেষ্ট আপগ্রেড করেছে কিন্তু এর বেশী আর সম্ভব না। তবে মিগ-২৯ এর বিকল্প খোজার জন্য এটাই প্রধান কারন না, আরও বেশ কিছু কারন আছে। প্রথমত মিগ-২৯ অত্যন্ত দুর্ঘটনা প্রবন। এখনও পর্যন্ত ভারতীয় নেভির তিনটি মিগ-২৯ কে যুদ্ধবিমান দুর্ঘটনাগ্রস্থ হয়েছে। গত বছরই একটি মিগ-২৯ কে দুর্ঘটনায় নেভির কমান্ডার নিশান সিং বীরগতি প্রাপ্ত হন। আসলে রাশিয়ার মিগ সিরিজের সমস্ত বিমানই দুর্ঘটনা প্রবন। দ্বিতীয়ত মিগ-২৯ কে সংখ্যা খুবই কম। এই ব্যাপারটা একটু ভাল ভাবে বলা যাক। ভারত ২০০৪ সালে দুটি ব্যাচে রাশিয়া থেকে ৪৫ টি মিগ-২৯ কে যুদ্ধবিমান কিনেছিল, এরমধ্যে তিনটি বিমান দুর্ঘটনাগ্রস্থ হয়েছে, তাই আমাদের কাছে এই মহূর্তে মোট ৪২ টি মিগ-২৯ কে রয়েছে। ভারতীয় নৌবাহিনীর কাছে বর্তমানে দুটি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার রয়েছে আইএনএস বিক্রমাদিত্য ও আইএনএস বিক্রান্ত। প্রতিটি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারের জন্য অন্তত ২ স্কোয়াড্রন বা ৩৬ টি করে মোট ৭২ টি মিগ -২৯ কে যুদ্ধবিমান দরকার কিন্তু আমাদের আছে মাত্র ৪২ টি। এখানে একটা কথা না বললেই নয় তাহল স্কোয়াড্রনে কটি করে যুদ্ধবিমান থাকে। দেখুন প্রতি স্কোয়াড্রনে কতগুলি করে যুদ্ধবিমান থাকে তা বিভিন্ন দেশের উপর নির্ভর করে। সাধারনত প্রতি স্কোয়াড্রনে ১৬-২২ টি করে যুদ্ধবিমান থাকে। যেমন ভারতের নেভি ও বায়ুসেনায় প্রতি স্কোয়াড্রনে ১৮ টি করে যুদ্ধবিমান থাকে। এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারে কতগুলি যুদ্ধবিমান থাকবে তা দেশের রাজনৈতিক অবস্থার উপর নির্ভর করে। যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে ভারতের এয়ারক্রাফর ক্যারিয়ার গুলোর প্রতিটিতে ২ স্কোয়াড্রন করে মোট ৪ স্কোয়াড্রন বা ৭২ টি যুদ্ধবিমান দরকার কিন্তু শন্তিকালীন পরিস্থিতিতে প্রতিটি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারে ১ স্কোয়াড্রন করে ২ স্কোয়াড্রন বা ৩৬ টি যুদ্ধবিমান দরকার। এবার অনেকের মনে হতে পারে আমাদের ৪২ টি মিগ-২৯ কে আছে যা শান্তিকালীন পরিস্থিতির জন্য যথেষ্ট কিন্তু এটা ভুল। আপনাদের এয়ারক্রাফট অ্যাভেলেবিলিটি রেশিও সম্পর্কে জানা দরকার। ভারতীয় বায়ুসেনায় ৩৬ টি রাফায়েল যুদ্ধ বিমান যুক্ত হয়েছে। হঠাৎ যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে পুরো ফ্লীটের ৭৫ শতাংশ বা ২৭ টির মতন রাফায়েল অ্যাক্টিভ থাকবে কারন একটি এয়ারক্রাফট একবার মিশনে যাওয়ার পর পুনরায় মিশনে যাবার আগে মেইনটেন্যান্স, ওভারহোলিং এ প্রায় কয়েকঘন্টা সময় লাগে। সব দেশের এয়ারক্রাফট স্কোয়াড্রনের ক্ষেত্রেই এমন হয়। বিভিন্ন এয়ারক্রাফটের অ্যাভেলেবিলিটি রেশিও ভিন্ন রকমের। রাফায়েলের যেমন ৭৫ শতাংশ তেমনি মিগ-২৯ কে এর ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ। অর্থাৎ ৪২ টি মিগ-২৯ কের মধ্যে সবসময় ২২ টির মত অ্যাক্টিভ থাকে। সুতরাং যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে আমাদের যে ৭২ টি যুদ্ধবিমান দরকার সেটাতো দূরের কথা বরং শান্তিকালীন পরিস্থিতির জন্য ৩৬ টি বিমানের পুরোটাই নেই আমাদের। তৃতীয়ত বর্তমানে পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধবিমান বিভিন্ন দেশ ব্যবহার করছে সেই তুলনায় চতুর্থ প্রজন্মের মিগ-২৯ কে এর রিপ্লেসমেন্ট দরকার। চতুর্থত ভারত মহাসাগর এলাকায় চীনের নেভাল ফ্লীটকে কাউন্টার করতে টিডিবিএফ প্রজেক্টের দরকার।
ভারতীয় নেভি ৫৭ টি এয়ারক্রাফট নেওয়ার জন্য একটি টেন্ডার জারি করেছে। যাতে প্রধান প্রতিযোগী রয়েছে ফ্রান্সের রাফায়েল এম এবং আমেরিকার বোয়িং এর এফ-১৮ সুপার হর্নেট। তবে যতদূর সম্ভব জানা যাচ্ছে ভারতীয় নেভি টিডিবিএফ প্রজেক্টকেই প্রধান গুরুত্ব দিয়েছে যার জন্য অন্য কোন যুদ্ধবিমান আপাতত নিতে চাইছে না। কারন নেভির কাছে টিডিবিএফ রাফায়েল ও এফ-১৮ এর থেকে বেশী এফেক্টিভ মনে হয়েছে। টিডিবিএফ এর দৈর্ঘ্য ১৬.৩০ মিটার যা রাফায়েলের থেকে আয়তনে বড় কিন্তু এফ-১৮ এর থেকে আয়তনে ছোট। রাফায়েলের দৈর্ঘ্য ১৫.২৭ মিটার এবং এফ -১৮ এর দৈর্ঘ্য ১৮.৩১ মিটার। ২৬,০০০ কেজি ওজন নিয়ে টেকঅফ করা টিডিবিএফ ৬০ হাজার ফুট উচ্চতায় উড়তে সক্ষম। টিডিবিএফ ৪.৫++ জেনারেশনের সেমি স্টেলথ ফাইটার জেট হতে চলেছে। এলসিএ তেজসের উপরই বেসড করে তৈরি বলে টিডিবিএফেও ডেল্টা ডিজাইন রয়েছে। টিডিবিএফে কী কী যুদ্ধাস্ত্র ব্যবহার করা হবে তা এখনও জানা যায় নি তবে এটা জানা গেছে ভারতের তৈরি নিজস্ব ওয়েপনস সিস্টেমই এখানে ব্যবহার করা হবে। সেই হিসাবে দেখতে গেলে এতে অস্ত্র এয়ার টু এয়ার মিসাইল, ব্রাহ্মস এনজি মিসাইল অবশ্যই ব্যবহার করা হবে। আগেই বলা হয়েছে যে ভারতীয় নেভি এই মহূর্তে কোন নতুন এয়ারক্রাফট না ক্রয় করে তাদের প্রধান লক্ষ্য টিডিবিএফ তৈরির উপর। তবে টিডিবিএফ সার্ভিসে আসবে ২০৩২ এ। সুতরাং মাঝের এই দশ বছর ভারতীয় নেভির দুটি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারের জন্য ভারত সম্ভবত ১০ বছরের জন্য কিছু যুদ্ধবিমান লিজ নেবে। প্রাথমিক ভাবে ১০০ টি টিডিবিএফ ক্রয় করবার পরিকল্পনা আছে নেভির তবে আন্দামান নিকোবর দীপপুঞ্জে যদি টিডিবিএফ রাখা হয় তাহলে আরও বেশী সংখ্যায় এই বিমান ক্রয় করা হবে। আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুন্জ কে ভারতের এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার বলা হয় কারন এর চারদিকে জল এবং দ্বীপে রানওয়ে সহ যুদ্ধবিমান রয়েছে ভারতের। টিডিবিএফ এর একটি বায়ুসেনা ভার্সন রয়েছে যার নাম ওআরসিএ বা ওমনি রোল কমব্যাট এয়ারক্রাফট। ভারতীয় বায়ুসেনা চাইলে হ্যাল এটা তৈরি করবে। একটি রাফায়েল এম এর দাম মোটামুটি ১২০ থেকে ১৫০ মিলিয়ন ডলার, এফ -১৮ সুপার হর্নেটের সর্বাধুনিক ভার্সন ব্লক ৩ এর দাম ও প্রায় ১২০ মিলিয়ন ডলার সেখানে টিডিবিএফ এর দাম ৮৫ মিলিয়ন ডলার অথচ যথেষ্ট অ্যাডভান্সড টেকনোলজি থাকবে টিডিবিএফে। ওআরসিএর দাম ও প্রায় ৭৫-৮০ মিলিয়ন ডলারের মতই হবে। প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখা ভাল ভারতের তেজস মার্ক ১ এর দাম প্রায় ৪৪ মিলিয়ন ডলার এবং মার্ক ২ এর দাম প্রায় ৬০ মিলিয়ন ডলার।