অফবিট

কতোটা খারাপ ছিল কার্ল মার্কসের রাজনৈতিক জীবনের পথ?

নিউজ ডেস্ক  সকলেই শূন্য থেকে ১০০য় ওঠে। তবে কার্ল মার্কসের জীবনটা ছিল বড়ই কষ্ট দায়ক। প্রভাব-প্রতিপত্তির মুখ দেখলেও বেশিদিন স্থায়ী ছিল না সেটি। যার কারণে শেষ জীবনে এই রাজনীতিবিদের যথেষ্ট কঠিন সমাজের সম্মুখীন হতে হয়েছে। কাল মার্কসের জীবনী সম্পর্কে বলতে গেলে শুরু থেকে শুরু করতে হয়। 

১৮১৮ সালের ৫ই মে থেকে শুরু হয় কার্ল মার্কসের জীবন। কারণ ১৮১৮ সালে প্রুশিয়ার রাইন অঞ্চলের ত্রিয়ের শহরে জন্মগ্রহণ করে কার্ল মার্কস। তার পিতা ছিলেন একজন আইনজীবী ইহুদি। খুব অল্প বয়সে অর্থাৎ ১৮২৪ সালে তিনি প্রোটেস্ট্যান্ট খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করেন। তবে শুধু তিনি নয় গোটা পরিবারই ছিল খ্রিস্টীয়, সচ্ছল এবং সংস্কৃতিবান। তবে পরিবারের কোনো সদস্য ছিল না রাজনীতিবিদ তথা বিপ্লবী। তবে ধ্বনি না হলেও সচ্ছলতার মধ্যে দিয়ে শৈশব কাটিয়েছিলেন কার্ল মার্কস।

পরবর্তীতে ত্রিয়েবের একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে শিক্ষা প্রাপ্তির পর তিনি উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় জান। প্রথমে বন-য়ে এবং পরে বার্লিনে। এখানে তিনি আইনশাস্ত্র সহ অধ্যায়ন করেছিলেন ইতিহাস ও দর্শনের। এপিকিউরাসের দর্শনীয় উপর ডক্টর্যা ল থিসিস জমা দিয়ে ১৮৪১ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাপ্ত করেন। সেই সময় তিনি দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে ছিলেন হেগেলীয় ভাববাদী। কার্যত বার্লিনেই তিনি বাম হেগেলীয় পন্থী গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত ছিলেন যারা হেগেলের দর্শন থেকে নারীশ্বরবাদী ও বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত সমূহ টানার চেষ্টা করতেন।  তবে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ সমাপ্ত করার পর পড়াশোনা শেষ করেননি। কার্যত এর পরেই অধ্যাপক হওয়ার বাসনায় তিনি বার্লিন থেকে চলে গেলেন বন শহরে। 

তবে সেখানেও ঘটে বিপত্তি। সেই সময়কার সরকারের প্রতিক্রিয়াশীল নীতি অনুযায়ী ১৮৩২ সালে ল্যূদভিক ফয়েরবাক অধ্যাপকের পদ থেকে অপসারণ করে। যার কারণে ১৮৩৬ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসার অনুমতি দিন অস্বীকার করায় ১৮৪১ সালে তরুণ অধ্যাপক ব্রুনো বাউয়েরকে বন নগরীতে বক্তৃতা দেওয়ার নিষেধাজ্ঞা আরোপ করায়  হেগেলের ভাবধারা ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয় মার্কস। ওই সময় জার্মানিতে বাম হেগেলীয় মতামত দ্রুত বিস্তৃতি লাভ করেছিল। 

পরবর্তীতে ১৮৩৬ সালের পর ধর্মতত্ত্বের সমালোচনা এবং বাস্তববাদের দিকে মোড় ফেরাতে শুরু করে মার্কসের। যা ১৮৪১ সালে তার দর্শনচিন্তা প্রতিপত্তির লাভ করে খ্রিস্টান ধর্মের মর্মবস্ত গ্রন্থে। তাই ১৮৪৩ সালেই ভবিষ্যৎ দর্শনশাস্ত্রের নীতিমালা বইটি প্রকাশ করেন তিনি।  বইটি প্রকাশ করার পর এঙ্গেলস লিখেছিলেন,”মুক্তিদায়ী প্রভাব প্রতীতি মর্মেই অনুভব করা গিয়েছিল। আমরা সবাই মার্কস সহ বামপন্থীরা অবিলম্বে হয়ে পড়েছিলাম ফয়েরবাখপন্থী।”

যদিও শোনা যায় ওই সময় বাম হেগেলীয় পন্থীদের সংস্পর্শে যে সকল ব্যক্তি এসেছেন তারা ইংল্যান্ডের কিছু প্রগতিবাদী বুর্জোয়া কলোন শহরে প্রতিষ্ঠা করেন রাইমস গ্যাজেট নামে সরকারি পত্রিকা। সেই সময়টা ছিল ১৮৪২ সালের ১লা জানুয়ারি। পত্রিকা প্রকাশের করার পরেই মার্কস ও ব্রুনো বাউয়েরকে প্রধান লেখক হওয়ার আমন্ত্রণ জানানো হয় এবং ১৮৪২ সালের অক্টোবরে মাক্সের প্রধান সম্পাদক নিযুক্ত হন ও বন থেকে কোলনে চলে আসেন তিনি। 

তবে পত্রিকা প্রকাশিত হওয়ার পর জানা যায় মার্কসের সম্পাদকীয় পত্রিকাটির বিপ্লবী গণতান্ত্রিক প্রবণতা উত্তরোত্তর স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে এবং সরকার পত্রিকাটির উপর প্রথমে দুই ও তিন দফা সেন্সরশিপ আরোপ করে। যার কারণে ১৮৪৩ সালের ১লা জানুয়ারি পত্রিকাটির পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তবে ওই তারিখের পূর্বেই সম্পাদকীয় পদ থেকে পদত্যাগ করতে হয় মার্সকে। তবে মার্কস ভেবেছিলেন পদত্যাগ করার পর হয়তো পত্রিকার রক্ষা পাবে। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। ১৮৪৩ সালের মার্চে পত্রিকাটির প্রকাশনা বন্ধ করে দেওয়া হয়। 

তবে পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরেও দমে যায়নি মার্কস। আমার সাংবাদিকতা কর্মকাণ্ড তার মধ্যে রাজনৈতিক অর্থশাস্ত্রের সাথে পরিচয় করায়। তবে সেই বিষয়ের জ্ঞান কম থাকায় তিনি অর্থশাস্ত্রের উপর অধ্যায়ন শুরু করেন। এরপর ১৮৪৩ সালে ক্রয়েজনাখ শহরে নিজের বাল্যকালের বন্ধু তথা প্রেমিকা  জেনিফার ওয়েস্ট ফালেনের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি। তার স্ত্রী ছিলেন প্রুশীয়  অভিজাত সম্প্রদায়ের এক প্রতিক্রিয়াশীল পরিবারের সন্তান। 

সম্প্রতিকালে ১৮৫০-৫৮ ছেলের সবচেয়ে প্রতিক্রিয়াশীল আমলে প্রুশিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন তাঁর বড় ভাই। তবে ১৮৪৩ সালে আর্নল্ডরুগেরের সাথে একত্রিত হয়ে আবর একটি র্যা ডিকাল পত্রিকা প্রকাশকরা উদ্দেশ্যে প্যারিতে চলে আসেন মার্কস। এরপরেই নিজেদের পরিকল্পনা মাফিক দৎসে-ফ্রানজ্শিশেইয়ার বুখার নামে পত্রিকার একটি মাত্র সংখ্যা প্রকাশিত করেন জার্মানিতে। সেই সময় খুব গোপনে বিলি করার কারণে এই পত্রিকাটির প্রকাশনাও বন্ধ হয়ে যায়। তবে পত্রিকাটিতে কার্ল মার্কসের যে নিবন্ধন লেখা ছিল সেটি দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছিল বহু জন। নিবন্ধনটির মাধ্যমে “তিনি ইতিমধ্যে এক বিপ্লবী হয়ে উঠেছিলেন। তিনি প্রয়োজনীয় সব কিছুকে নির্মম সমালোচনা আর বিশেষ করে অস্ত্রের জোরে সমালোচনা সমর্থক হয়ে উঠেছিলেন।” 

পরবর্তীতে ১৮৪৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ফ্রেডেরিখ এঙ্গেলস কয়েকদিনের জন্য প্যারিতে আসে। আর্শি খান এই দেখা হয় মার্কসের সঙ্গে। এরপরে ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে ওঠেন তারা। সেই সময় প্যারিতে চলা বিপ্লবী গ্রুপগুলোর সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হন তারা। সেই সময় প্রচন্ড সংগ্রাম চালিয়ে তারা গড়ে তোলেন বৈপ্লবিক সর্বহারা সমাজতন্ত্রের    বা সাম্যবাদের তত্ত্ব ও রণকৌশল। তবে তাদের রণকৌশল ১৮৪৫ সালে বিপদজনক বিপ্লবীর আকার ধারণ করলে সেসময়কার সরকার মার্সকে প্যারি থেকে বহিষ্কার করে দেন। যার কারণে প্যারি থেকে ব্রাসেলসে চলে যান মার্কস। 

এরপর ১৮৪৭ সালে একটি গুপ্ত প্রচার কমিউনিস্টলীগের সঙ্গে যুক্ত হন মার্কস এঙ্গেলস।  গুপ্ত সংস্থার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পর ১৮৪৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে কংগ্রেসের অনুরোধে তার রচনা করা সুবিখ্যাত কমিউনিস্ট ইশতেহার প্রকাশিত হয়। শেক্সপিয়ার কি পড়বি তো করিস না এক নতুন বিশ্ববীক্ষা সংগতিপূর্ণ বাস্তবাদকে। তবে বেলজিয়ামে বিপ্লব শুরু হওয়ার সময় ১৮৪৮ সালে সেখান থেকে নির্বাচন নেন মার্কস। 

বেলজিয়ামের যুদ্ধকালীন সময়ে প্রথমে প্যারি ও তারপর জার্মানির কোলন শহরে চলে আসেন তিনি। সেখানেই ১৮৪৮ সালের ১লা জুন থেকে ১৮৪৯ সালের ১৯শে মে পর্যন্ত তাঁর সম্পাদিত করা নয়া রাইনিশ গ্যাজেট পত্রিকা প্রকাশিত হয়। তবে গ্যাজেট প্রকাশিত করার পর মার্কসের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা দায়ের করে বিজয়ী  প্রতিবিপ্লবীরা। যদিও ১৮৪৯ সালের ৯ই ফেব্রুয়ারি তিনি বেকাসুর প্রমাণিত হন। কিন্তু এতে সকল সমস্যার সমাধান হয়নি কার্ল মার্কসের। পরবর্তীতে তাকে জার্মান থেকে নির্বাসন দেয়া হয় সেই বছরের ১৬ই মে। 

দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের ওঠা নামার পর ১৮৪৯ সালের ১৩ই জুন প্রথমে প্যারিতে বিক্ষোভ শোভাযাত্রার পর লন্ডনে চলে আসেন তিনি। নির্বাচন নিয়ে সেখানে আসার পর মৃত্যু পর্যন্ত লন্ডনে ছিলেন। তবে কার্ল মার্কসের রাজনৈতিক জীবনকে খুব একটা সহজ ছিল না সেটি মার্কস ও এঙ্গেলসের পত্রাবলীর মাধ্যমে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এমনকি কিছু তথ্য এমন উঠে এসেছে যেখানে স্পষ্ট করে যে এঙ্গেলসের  নিরন্তর ও নিঃস্বার্থ আর্থিক সাহায্য না পেলে পুঁজি গ্রন্থখানি সমাপ্ত করতে অসমর্থ থাকতেন কার্ল মার্কস। 

তবে দরিদ্র দমিয়ে রাখতে পারেনি মার্কসকে। তাই পেটিবুর্জোয়া সমাজতন্ত্র আর সাধারন অসর্বহারা সমাজতন্ত্রের বিদ্যমানগুলি ধারাবাহিক ও নির্মম সংগ্রাম পরিচালনা করতে বাধ্য করতো মার্কসকে। সেই সময়কালে মার্কস নিজের অর্থশাস্ত্রের প্রয়োগ করেন। যার কারণে তখন রাজনৈতিক অস্ত্রশস্ত্রের সমালোচনামূলক নিবন্ধ এবং পুঁজি গ্রন্থ তৈরি করেন তিনি। পঞ্চদশ শতকের ষাটের দশকে আন্দোলনের পুনরুজ্জীবনকালে মার্কস ফিরে আসেন সক্রিয় রাজনীতিতে। তাই ১৮৬৪ সালের ২৮শে সেপ্টেম্বরে লন্ডনে আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী সমিতি যখন গড়ে ওঠে তিনি ছিলেন তার প্রাণস্বরূপ। এই রণকৌশল গড়ে তোলার জন্য কঠোর পরিশ্রম করেন তিনি। তবে ১৮৭১ সালে প্যারি কমিউনের পতনের পর আন্তর্জাতিক কারণে সৃষ্ট ফাটলে তার সংগঠনটি ইউরোপে টিকে থাকতে পারেনি। আন্তর্জাতিকের সাধারণ পরিষদটি নিউইয়র্কে স্থানান্তরিত হয়। এর পরে তিনি এমন একটি পথ উন্মোচন করেন যেখানে আন্দোলনটি ক্রমেই বেড়ে চলে। আর এই আন্দোলন পথেই স্বতন্ত্র জাতীয় রাষ্ট্রসমূহের গণ আকৃতির সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক পার্টি গড়ে ওঠে। এই সকল কর্মকান্ডের মধ্যেও তিনি কঠোর পরিশ্রম করে অর্থশাস্ত্রকে ঢেলে সাজানোর বিষয়ে এবং পুঁজি গ্রন্থটিকে সম্পূর্ণ করার জন্য তিনি ঝুড়ি ঝুড়ি ভাষা শিখেছিলেন। এই রাজ্য রাজনীতি চলাকালীন সময়ে ১৮৮১ সালের ২রা ডিসেম্বর দেহাবশেষ হয় তার স্ত্রীর। কার্যত নিজের স্ত্রীর মৃত্যু ঘটনা য তিনি সহ্য করতে পারেননি। যার কারণে তার মৃত্যুর দু’বছর পর অর্থাৎ ১৮৮৩ সালে নিজের বাড়ি আরাম কেদারায় বসে শান্তভাবে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন মার্কস। এরপরই তার শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী লন্ডনের হাইড্রেট সমাধিক্ষেত্র তার স্ত্রীর পাশে তার কবর দেওয়া হয়। নিজের স্ত্রী কাছে বরাবরই একজন আইডল স্বামী ছিলেন তিনি। তবে শুধুমাত্র মার্কস ও তার স্ত্রী নয় দারিদ্র্যের সংসারে বহু সন্তান হারিয়েছেন তারা। বর্তমানে যে অবশিষ্ট সন্তানও রয়েছে তাদের মধ্যে তিনজন মেয়ের বিয়ে হওয়া ইংরেজ ও ফরাসি সমাজতন্ত্রের সাথে। তবে কাল মার্কসের গোটার জীবনে তিনি যেমন ছিলেন একনায়কতন্ত্র ঠিক সেরকমই ছিলেন একজন দারিদ্রীক  সাধারন মানুষ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *