চীন, পাকিস্তানের চিন্তার কারন ভারতীয় নেভির ভয়ঙ্কর যুদ্ধজাহাজ বা শক্তিশালী ব্রহ্মপুত্র ক্লাস ফ্রিগেট। কি কি যুদ্ধাস্ত্র রয়েছে যুদ্ধজাহাজটিতে?
রাজেশ রায়:– ভারতীয় নৌবাহিনীতে যুক্ত থাকা একটি ঘাতক ফ্রিগেট হল ব্রহ্মপুত্র ক্লাস ফ্রিগেট। ১৯৮৬ সালে ক্যাবিনেট কমিটি অন পলিটিক্যাল অ্যাফেয়ার্স (সিসিপিএ) ভারতের যুদ্ধজাহাজ ফ্লীটে বৈচিত্র্য আনতে এই ব্রহ্মপুত্র ক্লাস ফ্রিগেট নির্মানের পরিকল্পনা করে। এই ব্রহ্মপুত্র ক্লাস ফ্রিগেট আদতে গোদাবরী ক্লাস ফ্রিগেটের আপগ্রেডেড ভার্সন। পুরো গোদাবরী ক্লাস ফ্রিগেটের ডিজাইনের উপর বেসড করেই ব্রহ্মপুত্র ক্লাস ফ্রিগেট নির্মান করা হয়েছে। মুম্বাইয়ের মাজগাঁও ডকে গোদাবরী ক্লাস ফ্রিগেট তৈরি হচ্ছিল যারজন্য কলকাতার গার্ডেনরিচ শিপইয়ার্ড লিমিটেড কে বাছা হয় এই ব্রহ্মপুত্র ক্লাস ফ্রিগেট তৈরির জন্য। মাজগাঁও ডক গার্ডেনরিচ শিপইয়ার্ড কে গোদাবরী ক্লাসের টেকনোলজি ট্রান্সফার করে। পরে এর ডিজাইনে কিছু পরিবেশ করা হয়, এর পর এই প্রজেক্টের নাম দেওয়া হয় প্রজেক্ট ১৬ আলফা। এই প্রজেক্টের বেসিক ডিজাইন করে ভারতীয় নৌবাহিনীর নেভাল ডিজাইন ব্যুরো। বাকী সমস্ত ডিটেইলস ডিজাইন করে গার্ডেনরিচ শিপইয়ার্ড লিমিটেড।
ব্রহ্মপুত্র ক্লাসের মোট তিনটি ফ্রিগেট তৈরি করা হয়েছে। প্রথম ব্রহ্মপুত্র ক্লাস ফ্রিগেট আইএনএস ব্রহ্মপুত্র ১৪ এপ্রিল ২০০০ সালে ভারতীয় নেভিতে যুক্ত হয়, দ্বিতীয় জাহাজ আইএনএস বেতোয়া ৭ জুলাই, ২০০৪ সালে এবং তৃতীয় জাহাজ আইএনএস বীস ১১ জুলাই, ২০০৫ সালে ভারতীয় নেভিতে সার্ভিসে আসে। ডিজাইন পরিবর্তন, লেবার প্রবলেম, সঠিক সময়ে ইকুইপমেন্ট না পাওয়া এবং ওয়েপনস সিস্টেম ইন্সটলেশনে সমস্যা হওয়ায় এই প্রজেক্ট শুরু হতে দেরী হয়। গোদাবরী ক্লাস ফ্রিগেট হিসাবে এর প্রজেক্ট লঞ্চ হয় ১৯৮৯ সালে কিন্তু ডিজাইন পরিবর্তন করে প্রজেক্ট ১৬ হিসাবে শুরু হয় ১৯৯৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এবং অবশেষে সমস্ত জটিলতার পর প্রথম যুদ্ধজাহাজ সার্ভিসে আসে ২০০০ সালে। ২০১৬ সালের ৫ ডিসেম্বর মুম্বাইয়ের নেভাল ডকইয়ার্ডে রিফটের সময় জাহজটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পুরো দুই বছর সময় লাগে জাহাজটিকে সম্পূর্ণ রিপিয়ারিং করতে। ব্রহ্মপুত্র ক্লাস ফ্রিগেট কে ডিজাইন করা হয়েছিল যাতে এতে ত্রিশূল স্যাম ইনস্টল করা সম্ভব হয় কিন্তু পরে এতে ইসরায়েলের বারাক স্যাম ইনস্টল করা হয়। ২০০৫ সালের ৭ সেপ্টেম্বর টাইমস অফ ইন্ডিয়ার রিপোর্ট অনুযায়ী ব্রহ্মপুত্র ক্লাস ফ্রিগেট আইএনএস বেতোয়া প্রথম কোন ভারতীয় যুদ্ধজাহাজ যাতে নিজস্ব ব্যাটেল ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম সহ ভারতীয় ও বৈদেশিক টেকনোলজি, সেন্সর ও ওয়েপনসের সমন্বয় রয়েছে। তৎকালীন বেতোয়ার কমান্ডিং অফিসার ক্যাপ্টেন সি এস মূর্তি জানিয়েছিলেন আইএনএস বেতোয়াতে ভারত ইলেকট্রনিক লিমিটেডের তৈরি কমব্যাট সিস্টেম রয়েছে। ব্রহ্মপুত্র ক্লাস ফ্রিগেটকে ডিজাইন করা হয়েছে বিশেষভাবে অ্যান্টি সাবমেরিন ওয়ারফেয়ার ও অ্যান্টি সারফেস মিশনের জন্য।
ব্রহ্মপুত্র ক্লাস ফ্রিগেটে ৪০ জন অফিসার সহ ৩৫০ জন ক্রু থাকতে পারে। ব্রহ্মপুত্র ক্লাস ফ্রিগেটে ভারত হেভি ইলেকট্রিক্যাল লিমিটেডের তৈরি দুটি ব্রেক হর্সপাওয়ার স্টীম টার্বাইন ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয়েছে। যা ১১,০০০ কিলোওয়াট শক্তি উৎপন্ন করে।
ব্রহ্মপুত্র ক্লাস ফ্রিগেটে তিন ধরনের রেডার ব্যবহার করা হয়েছে:–
*আরএডব্লুইএস-০৩ রেডার:— ভারত ইলেকট্রনিকসের তৈরি এটি একটি এস ব্যান্ড রেডার। এয়ার ও সারফেস সার্চের জন্য এতে ডিএ০৮ অ্যান্টেনা ব্যবহার করা হয়েছে। এটি মিডিয়াম রেঞ্জ সারভিলেন্স রেডার। একে পিএফএন-৫১৩ ও বলা হয়।এটি ডিএ-০৫ রেডারের আপডেটেড ভার্সন।
*আরএডব্লুএল-০২:— এটিও ভারত ইলেকট্রনিকসের তৈরি। এটি এল ব্যান্ড ফ্রিকোয়েন্সি যুক্ত। এয়ার ও সারফেস টার্গেটের জন্য একটি লং রেঞ্জ সারভিলেন্স রেডার। ডি ব্যান্ড ফ্রিকোয়েন্সি যুক্ত এই রেডার এলডব্লু -০৮ অ্যান্টেনা ব্যবহার করে। ফ্রান্সের তৈরি এলডব্লু-০৮ জুপিটার রেডারের ভারতীয় ভার্সন। ভারত ইলেকট্রনিকস লাইসেন্স নিয়ে এই রেডার ভারতে তৈরি করে।
*রাশমি রেডার:— ভারত ইলেকট্রনিক লিমিটেডের তৈরি এটি একটি নেভিগেশন রেডার। এটি আই ব্যান্ড ফ্রিকোয়েন্সি যুক্ত। নেভিগেশনের জন্য এতে জেড ডব্লু -০৬ অ্যান্টেনা ব্যবহার করা হয়েছে।
ব্রহ্মপুত্র ক্লাস ফ্রিগেটে ভারত ইলেকট্রনিকসের তৈরি মিডিয়াম ফ্রিকোয়েন্সীর হামসা সোনার ব্যবহার করা হয়েছে। তাছাড়া ফ্রান্সের থ্যালসের তৈরি সিন্ট্রা টাওয়েড অ্যারে সোনার ব্যবহার করা হয়েছে। ব্রহ্মপুত্র ক্লাস ফ্রিগেটে ভারত ইলেকট্রনিক লিমিটেডের তৈরি ইএমসিসিএ (ইলেকট্রনিক মডিউলার কম্যান্ড এন্ড কন্ট্রোল অ্যাপ্লিকেশন) কমব্যাট সিস্টেম রয়েছে যা এমপিআরডি ৯৬৫১ লিংক ব্যবহার করে। এছাড়াও ব্রিটেনের ইনমারস্যাট কমিউনিকেশন সিস্টেম রয়েছে। ব্রহ্মপুত্র ক্লাস ফ্রিগেটের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য এটি কেমিক্যাল, বায়োলজিক্যাল এবং নিউক্লিয়ার ওয়ারফেয়ারের সময়ও অ্যাক্টিভ থাকতে পারে। ৩৮৫০ টন ডিসপ্লেসমেন্ট এবং ১২৬.৪ মিটার লম্বা ব্রহ্মপুত্র ক্লাস ফ্রিগেটের সর্বোচ্চ গতি ৩০ নট, রেঞ্জ ৪৫০০ নটিক্যাল মাইল বা ৮৩৩০ কিলোমিটার। ব্রহ্মপুত্র ক্লাস ফ্রিগেটে ভারত ইলেকট্রনিক লিমিটেডের তৈরি অজন্তা মার্ক ২সি ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার সুট ও ইলোরা ইলেকট্রনিক সাপোর্ট মেজার সিস্টেম ব্যবহার করা হয়েছে। তাছাড়া ভারত ইলেকট্রনিক লিমিটেডের রাডার ওয়ার্নিং রিসিভার ও রয়েছে।
অস্ত্র হিসাবে ব্রহ্মপুত্র ক্লাস ফ্রিগেটে রয়েছে:–
*১৬ টি রাশিয়ান ৩এম – ২৪ই কেএইচ -৩৫ অ্যান্টিশিপ মিসাইল, যার ন্যাটো নাম এসএস-এন-২৫ সুইচব্লেড। এই মিসাইলের জন্য জাহাজে রয়েছে চারটি কেটি-১৮৪ লঞ্চার যার প্রতিটি চারটি করে মিসাইল বহন করে। কেএইচ-৩৫ আমেরিকাব হারপুন ব্লক-১ মিসাইলের সমতুল্য। রেঞ্জ ১৩০ কিলোমিটার।
*২৪ টি ইসরায়লি বারাক-১ এয়ারডিফেন্স মিসাইল।
*ক্লোজ রেঞ্জের জন্য রয়েছে একটি ইটালিয়ান অটো মেলেরা ৭৬ মিলিমিটার গান।
*চারটি রাশিয়ান একে-৬৩০ গান
*অ্যান্টি সাবমেরিন ওয়ারফেয়ারের জন্য রয়েছে ২ টি ট্রিপল আইএলএএস ৩ ৩২৪ মিলিমিটার টর্পেডো টিউব।
একটি ব্রহ্মপুত্র ক্লাস ফ্রিগেট দুটি সী কিং অ্যান্টি সাবমেরিন ও অ্যান্টি শিপ হেলিকপ্টার বহন করে।
গোদাবরী ক্লাসেরই আপগ্রেডেড ভার্সন এই ব্রহ্মপুত্র ক্লাস ফ্রিগেট। গোদাবরী ক্লাসের মতই এর আয়তন, এননকী ইঞ্জিন সক্ষমতাও সমান, তবে সামান্য কীছু পার্থক্য আছে:—
*ব্রহ্মপুত্র ক্লাসের গতি গোদাবরী ক্লাস ফ্রিগেটের থেকে বেশী।
*ব্রহ্মপুত্র ক্লাস ফ্রিগেট গোদাবরী ক্লাস ফ্রিগেটের তুলনায় ডেডিকেটেড অ্যান্টি সাবমেরিন ও অ্যান্টি সারফেস স্পেশালিষ্ট।
*ব্রহ্মপুত্র ক্লাস ফ্রিগেটের রেডার অনেক নেশী আপগ্রেডেড।
*ব্রহ্মপুত্র ক্লাসে ভারত ইলেকট্রনিক লিমিটেডের অজন্তা মার্ক ২ ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার সুট ও ইলোরা সুট ব্যবহার করা হয়েছে যা গোদাবরী ক্লাসে ব্যবহৃত সেলেনিয়া আইএনএস-৩ ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার সুটের তুলনায় শক্তিশালী।
*গোদাবরী ক্লাসে রাশিয়ান পি-১৫ টারমিট, যার ন্যাটো নাম এসএস-এন-২ অ্যান্টি শিপ মিসাইল ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু ব্রহ্মপুত্র ক্লাসে কেএইচ-৩৫ অ্যান্টি শিপ মিসাইল ব্যবহার করা হয়েছে যার রেঞ্জ অনেক বেশী ও এটি বেশী অ্যাডভান্সড।