ডিফেন্স

কাশ্মীর ভ্যালি সহ লে, লাদাখের মত উচ্চতায় যে হেলিকপ্টার বিশেষভাবে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে সাহায্য করবে। আসছে প্রচুর সংখ্যায়

রাজেশ রায়:– যুদ্ধের ময়দানে স্থলসেনাকে সাপোর্ট দেবার ক্ষেত্রে অ্যটাক হেলিকপ্টারের জুড়ি মেলা ভার। ভারতের কাছে ডেডিকেটেড অ্যটাক হেলিকপ্টারের অভাব বহুদিন ধরেই ছিল যার জন্য ভারত ইতিমধ্যে আমেরিকা থেকে ২৮ টি অ্যাপাচি হেলিকপ্টার কিনেছে, ভবিষ্যতে আরও অ্যাপাচি হেলিকপ্টার কেনা হবে। তবে শুধু বিদেশের উপর নির্ভর করেই নেই ভারত, হিন্দুস্তান এরোনটিকস লিমিটেড বা হ্যাল ভারতের সেনাবাহিনীর জন্য একটি বিশেষ মাস্টারপিস হেলিকপ্টার তৈরি করেছে যার নাম এলসিএইচ বা লাইট কমব্যাট হেলিকপ্টার। ১৯৯০ এর শেষের দিকে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে কারগিল যুদ্ধ শুরু হয়। এইসময় উঁচু পার্বত্য অঞ্চলে শত্রুর অবস্থানের উপর সঠিক বোম্বিং এর জন্য ভারতের কাছে কোন ডেডিকেটেড  অ্যাটাক হেলিকপ্টার ছিল না। সেই সময় ভারতের কাছে মিল মি -২৪ হিন্দ হেলিকপ্টার ছিল যা উঁচু পার্বত্য অঞ্চলে অ্যাটাকের জন্য উপযোগী ছিল না। তাই বাধ্য হয়ে ভারত কিছু পুরোনো এমআই ১৭ হেলিকপ্টারে রকেট পড লাগিয়ে ব্যবহার করে কিন্তু এমআই ১৭ কোনওদিনও ডেডিকেটেড অ্যটাক হেলিকপ্টার না তাই যুদ্ধে তেমন কোন প্রভাব ফেলতে পারে নি। পাকিস্তান ভারতের একটি এমআই ১৭ হেলিকপ্টার কে শুট ডাউন করে, যাতে হেলিকপ্টারে থাকা সমস্ত ক্রুরা মারা যায়। এরপরেই ভারত ঠিক করে একটি ডেডিকেটেড অ্যটাক হেলিকপ্টার তৈরির। তাছাড়া ভারতের চিতা ও চেতক হেলিকপ্টার গুলোর রিপ্লেসমেন্ট ও দরকার ছিল।

২০০৪ সালের মাঝামাঝি হিন্দুস্তান এরোনটিকস লিমিটেড বা হ্যাল জানায় তারা ধ্রুব হেলিকপ্টারের উপর বেসড করে একটি লাইট কমব্যাট হেলিকপ্টার ডিজাইন করার ব্যাপারে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাথে আলোচনা করছে। সেইবছরেরই শেষের দিকে ভারতীয় সেনাবাহিনী বিদেশ থেকে লাইট কমব্যাট হেলিকপ্টার কেনা বাদ দিয়ে হ্যালের উপরই আস্থা রাখে। ২০০৬ সালে হ্যাল জানায় তারা এলসিএইচ তৈরি করছে এবং ভারত সরকার সেসময় এই প্রজেক্টে ফান্ডিং করে। হ্যাল ধ্রুব হেলিকপ্টারের উপর বেসড করে, যা ১৯৯০ সালে তৈরি শুরু হয়ে ২০০০ সালে ভারতীয় সেনাবাহিনী তে যুক্ত হয়, এলসিএইচ ডিজাইন করে। 

২০১০ সাল পর্যন্ত তথ্য অনুযায়ী এলসিএইচ প্রজেক্টে খরচ হয় প্রায় ৫০ মিলিয়ন ডলার বা ৩৭৬ কোটি টাকা। ২০১০ সালে ভারতীয় বিমানবাহিনী ৬৫ টি ও সেনাবাহিনী ১১৪ টি এলসিএইচ কিনবে বলে ঠিক করে। ২০০৭ সালের ২১ জুন তৎকালীন হ্যালের চেয়ারম্যান অশোক বাওয়েজা জানায় ২০০৮ সালের অক্টোবরে প্রথম এলসিএইচের ফ্লাইট টেস্ট হবে। নভেম্বর, ২০০৮ এ হ্যাল জানায় প্রথম ফ্লাইট ২০০৯ সালের মার্চ মাসে হবে এবং ইনিশিয়াল অপারেশন ক্লিয়ারেন্স বা আইওসি ২০১০ এর ডিসেম্বরে ও ফাইনাল অপারেশনাল ক্লিয়ারেন্স এফওসি ২০১১ সালে পাওয়া যাবে। কিন্তু ২০০৯ এর ফেব্রুয়ারিতে হ্যাল জানায় সাপ্লাই এর সমস্যা হওয়ায় ফ্লাইট টেস্ট আরও ছয় মাস পিছিয়ে যাবে। শেষপর্যন্ত ২০১০ সালের জানুয়ারী তে প্রথম এলসিএইচ প্রোটোটাইপের সফল গ্রাউন্ড টেস্টিং হয় এবং মার্চে প্রথম ফ্লাইট টেস্ট হয়। ২৯ মার্চ, ২০১০ প্রথম এলসিএইচ এর টেকনোলজি ডেমনস্ট্রেটর টিডি-১ ব্যাঙ্গালোরে হ্যালের হেলিকপ্টার কমপ্লেক্সে ২০ মিনিটের ফ্লাইট টেস্ট করে। ১২ নভেম্বর, ২০১৪ সালে তৃতীয় এলসিএইচ প্রোটোটাইপের প্রথম ফ্লাইট টেস্ট হয়। তৃতীয় এলসিএইচ প্রথম ভার্সনের থেকে অনেক হালকা হয়। এরপর এলসিএইচ এর চতুর্থ প্রোটোটাইপ টিডি-৪ তৈরির কাজ শুরু হয় এই টিডি-৪ এ ওয়েপনস ও সেন্সর টেস্টিং এর কাজ শুরু হয়। টিডি-৪ তৈরির জন্য ভারত সরকার ১২৬ কোটি টাকার অর্থ সাহায্য দেয়। ২০১৫ সালে হাইঅল্টিটিউডে মাইনাস ১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় এলসিএইচের টেসিং হয়। এই সময় ১৩,৬০০ – ১৫,৮০০ ফুট উচ্চতায় সিয়াচেনে এলসিএইচের প্রথম ল্যান্ডিং হয়, পৃথিবীর সবচেয়ে উঁচু যুদ্ধক্ষেত্র সিয়াচেনে এই প্রথম কোন ডেডিকেটেড অ্যাটাক হেলিকপ্টার অবতরন করে, এটা একটা রেকর্ড। সেই বছরই জুন মাসে যোধপুরে ৩৯-৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় এলসিএইচের হট ওয়েদার টেস্টিং হয়। শেষ পর্যন্ত ২৬ আগস্ট, ২০১৭ তে তৎকালীন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী অরুন জেটলি এলসিএইচ এর ফুল স্কেল প্রোডাকশন শুরু করে। অবশেষে সমস্ত ওয়েপনস টেস্টিং এর পর ২০২০ এর ফেব্রুয়ারিতে এলসিএইচ পুরোপুরি প্রোডাকশনের জন্য তৈরি হয়। সেনাবাহিনী ও বিমানবাহিনীর জন্য মোট ১৬২ টি এলসিএইচ তৈরির পরিকল্পনা নেওয়া হয়। প্রথমিক ভাবে হ্যাল ১৫ টি লিমিটেড সিরিজ এলসিএইচ তৈরি করছে যা ২০২২ এর মার্চের মধ্যে সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া হবে। ইতিমধ্যে ২০২১ এর জুলাইয়ে হ্যাল তিনটি এলসিএইচ ভারতীয় বায়ুসেনার হাতে তুলে দিয়েছে।
এলসিএইচ এর ডিজাইন করেছে হ্যালের রোটারি উইং রিসার্চ  এন্ড ডিজাইন সেন্টার। মাল্টিরোল অ্যাটাক হেলিকপ্টার এলসিএইচ কে ডিজাইন করা হয়েছে বিশেষভাবে পার্বত্য অঞ্চলে যুদ্ধ করার জন্য। এলসিএইচের ককপিটে দুজন পাইলট থাকতে পারে। অ্যান্টি ইনফ্রেন্টি ও অ্যান্টি আর্মর রোলের পাশাপাশি কাশ্মীর ভ্যালীতে অ্যান্টি টেরর অপারেশনেও একে ব্যাবহার করা হয়। শত্রুর এয়ারডিফেন্স ও ড্রোনের বিরুদ্ধেও দক্ষতার সাথে লড়াই করতে সক্ষম এই হেলিকপ্টার। দিনে ও রাতে সমান ভাবে অভিযান চালাতে সক্ষম এলসিএইচে রয়েছে একটি ডিজিটাল প্রটেকশন সিস্টেম। হ্যাল ধ্রুব হেলিকপ্টারের অনেক টেকনোলজি রয়েছে হ্যাল এলসিএইচে। যেমন উভয়ই হ্যালের তৈরি শক্তি ইন্জিন ব্যবহার করে। এই শক্তি ইন্জিন আবার ফ্রান্সের স্যাফরনের এরডিডেন ইন্জিনের লাইসেন্স কপি। এলসিএইচ ১৯,৭০০ থেকে ২১,৩০০ ফুট উচ্চতাতেও অভিযান চলাতে সক্ষম, বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী কমব্যাট হেলিকপ্টার অ্যাপাচিও এটা পারে না। সুইডেনের সাবের তৈরি একটি বিশেষ ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার সুট এলসিএইচে ব্যবহার করা হয়েছে যার মধ্যে রয়েছে রেডার ওয়ার্নিং রিসিভার, লেজার ওয়ার্নিং রিসিভার এবং একটি মিসাইল অ্যাপ্রোচ ওয়ার্নিং সিস্টেম। এলসিএইচে অনবোর্ড সেন্সর সুট হিসাবে এলবিট কমপাস সিস্টেম ব্যবহার করা হয়েছে, এই সুট ভারত ইলেকট্রনিক লিমিটেড ভারতে তৈরি করে টেকনোলজি নিয়ে। ১৫.৮ মিটার লম্বা এলসিএইচের পেলোড বহন ক্ষমতা ৭০০ কেজি, সর্বোচ্চ গতি ২৬৮ কিমি/ঘন্টা। এলসিএইচের কমব্যাট রেঞ্জ ৫৫০ কিলোমিটার এবং এটি একটানা ৩ ঘন্টা ১০ মিনিট অপারেশন চালাতে সক্ষম। এলসিএইচে অস্ত্র হিসাবে রয়েছে ফ্রান্সের নেক্সটারের তৈরি একটি ২০ মিলিমিটার এম ৬২১ ক্যান। এলসিএইচের চারটি হার্ড পয়েন্ট রয়েছে যাতে ৪৮ টি ফ্রান্সের থ্যালসের তৈরি এফজেড২৭৫ লেজার গাইডেড রকেট অথবা এমবিডিএর তৈরি ৮ মিস্ত্রাল এয়ার টু এয়ার মিসাইল অথবা ডিআরডিও এর তৈরি আটটি ধ্রুবাস্ত্র অ্যান্টি ট্যাংক গাইডেড মিসাইল ব্যবহার করা সম্ভব। তাছাড়া এলসিএইচ বিভিন্ন ধরনের ক্লাস্টার মিউনেশন, আনগাইডেড বোম্ব, গ্রেনেড লঞ্চার বহন করতে সক্ষম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *