ডিফেন্স

এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারকে নিরাপত্তা প্রদান করাই মূলত কাজ ডেস্ট্রয়ারের। ১৯৯৩ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার ফলে ক্ষতি যেভাবে ক্ষতি হয় ভারতবর্ষের

রাজেশ রায়: যেকোন দেশের প্রতিরক্ষায় নৌসেনার ভূমিকা অনস্বীকার্য। প্রত্যেকটা শক্তিশালী দেশের মধ্যে একটা জিনিস কমন যে তাদের নৌবাহিনী শক্তিশালী। আমেরিকা, রাশিয়া, চীন, ভারত বিশ্বের সমস্ত সুপার পাওয়ারদের শক্তিশালী নেভি রয়েছে। ভারতের মত দেশের যার তিনদিকে রয়েছে ভারত মহাসাগর, আরব সাগর ও বঙ্গোপসাগর, সেই দেশের এত সুবিশাল জলসীমা পাহাড়া দেওয়ার জন্য দরকার শক্তিশালী নৌবাহিনী। সেইকারনে প্রত্যেকটি শক্তিশালী দেশের মত ভারতের নেভিতেও রয়েছে এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার, যা থেকে যুদ্ধবিমান ওঠানামা করতে পারে। এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার হচ্ছে নেভির একটি অ্যাসেট। আর এই এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারের নিরাপত্তা প্রদান করাই মূলত কাজ ডেস্ট্রয়ারের। ডেস্ট্রয়ার বলতে বোঝায় ৬৫০০-১০০০০ টনের বিশাল যুদ্ধজাহাজ যা গাইডেড মিসাইলে ভর্তি থাকে।

ভারতীয় নেভিতে সার্ভিসে থাকা এমনই একটি শক্তিশালী ডেস্ট্রয়ার হচ্ছে দিল্লী ক্লাস ডেস্ট্রয়ার। এই মহূর্তে ভারতীয় নৌসেনায় তিনটি দিল্লি ক্লাস গাইডেড মিসাইল ডেস্ট্রয়ার অ্যাক্টিভ আছে। ১৯৮০ সালে দিল্লি ক্লাস ডেস্ট্রয়ার তৈরির প্রজেক্ট প্রথম শুরু হয়। তখন এই প্রজেক্টের নাম দেওয়া হয় “প্রজেক্ট ১৫”. তবে প্রথমেই কিন্তু এই প্রজেক্ট ডেস্ট্রয়ার হিসাবে শুরু হয় নি। ভারতীয় নেভি ঠিক করেছিল গোদাভরি ক্লাস ফ্রিগেট তৈরির প্ল্যান হিসাবে এই ৩৫০০ টনের জাহাজ তৈরির যাতে আরবিইউ-৬০০০ অ্যান্টি সাবমেরিন ওয়ারফেয়ার রকেট লঞ্চার ইনস্টল করা হবে। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৮৩ সালে রিভার্সিবেল গ্যাস টার্বাইন ইঞ্জিন এবং মর্ডান ওয়েপনস অফার করে যার ফলে ফ্রিগেট হিসাবে প্ল্যান হওয়া এই প্রজেক্টের ডিজাইন পরিবর্তন করে ৬২০০ টন ডেস্ট্রয়ারের ডিজাইন করা হয়। ডাইরেক্টেরট অফ নেভাল ডিজাইন ১৯৮০ সালে এই প্রজেক্টের যাবতীয় ডিজাইন কমপ্লিট করে। ১৯৮৫ সালে সুইডেনে এবং ১৯৮৬ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের কিরলভ ইন্সটিটিউটে এর মডেল টেস্ট হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের সেভারনোয়ি ডিজাইন ব্যুরো ওয়েপনস ডিজাইন ও প্রোপালশন প্যাকেজ দেয়। দিল্লি ক্লাস ডেস্ট্রয়ারের অনেক টেকনোলজি সোভিয়েত ইউনিয়ন সাপ্লাই করেছিল। ১৯৯৩ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাবার ফলে এই প্রজেক্টে অন্তত তিন বছর দেরী হয়ে গিয়েছিল। মুম্বাইয়ের মাজগাও ডকে দিল্লি ক্লাস ডেস্ট্রয়ার গুলো তৈরি হয়েছে। ১৯৮৭-২০০১ এর মধ্যে মোট তিনটি দিল্লি ক্লাস ডেস্ট্রয়ার তৈরি হয়। দিল্লি ক্লাস ডেস্ট্রয়ারের প্রথম জাহাজ আইএনএস দিল্লি ১৯৯৭ সালে ভারতীয় নেভি তে যুক্ত হয়, দ্বিতীয় জাহাজ আইএনএস মাইশোর ১৯৯৯ এবং তৃতীয় বা সর্বশেষ জাহাজ আইএনএস মুম্বাই ২০০১ সালে ভারতীয় নেভিতে যুক্ত হয়। প্রতিটি দিল্লি ক্লাস ডেস্ট্রয়ারের দাম ৩৬০ মিলিয়ন ডলার বা ২২০০ কোটি টাকা প্রায়।

দিল্লি ক্লাস ডেস্ট্রয়ার আদতে রাজপুত ক্লাস ডেস্ট্রয়ারের আপগ্রেডেড ভার্সন যাতে গোদাবরী ক্লাস ফ্রিগেট এবং সোভিয়েত সোভ্রিম্যানি ক্লাস ডেস্ট্রয়ারের টেকনোলজি রয়েছে। দিল্লি ক্লাস ডেস্ট্রয়ারে ইউক্রেনের তৈরি দুটি জোরিয়া ম্যাশপ্রোকেট এম৩৬ই গ্যাস টার্বাইন ইঞ্জিন রয়েছে। যার প্রতিটিতে দুটি ডিটি-৫৯ রিভার্সিবেল গ্যাস টার্বাইন রয়েছে যা সংযোগ করে একটি আরজি-৫৪ গিয়ারবক্স রয়েছে। এই ইন্জিন ৮২,৮২০ হর্স পাওয়ার উৎপন্ন করে। দিল্লি ক্লাস ডেস্ট্রয়ারের ডিসপ্লেসমেন্ট ৬২০০ টন। ১৬৩ মিটার লম্বা ও ১৭ মিটার চওড়া দিল্লি ক্লাস ডেস্ট্রয়ারের গতি ৩২ নট বা ৫৯ কিমি/ঘন্টা যা কলকাতা ক্লাস ও বিশাখাপত্তনম ক্লাস ডেস্ট্রয়ারের থেকেও বেশী এবং রেঞ্জ ৭২০০ কিলোমিটার। একটি দিল্লি ক্লাস ডেস্ট্রয়ারে ৪০ জন অফিসার সহ ৩৫০ জন ক্রু থাকতে পারে। 

দিল্লি ক্লাস ডেস্ট্রয়ারে আট রকমের রেডার ব্যবহার করা হয়েছে :–

* প্রথমেই প্রধান রেডার হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে রাশিয়ান এম আর ৭৫৫ ফ্রিগেট এমএই ই ব্যান্ড এয়ার এন্ড সারফেস সার্চ রেডার। এর রেঞ্জ ১৫০-৩০০ কিমি।

*  ফ্রান্সের থ্যালসের তৈরি এল ডাব্লু ২ডি রেডার ব্যবহার করা হয়েছে। এটি একটি ডি ব্যান্ড রেডার যার রেঞ্জ ২৬০ কিমি। ভারতে এই রেডার তৈরি করে ভারত ইলেকট্রনিক লিমিটেড বা বেইল।

* তিনটি এম আর ২১২/২০১ নেভিগেশন রেডার ব্যবহার করা হয়েছে। বেসিক্যালি এটি একটি এক্স ব্যান্ড শর্ট রেঞ্জ সারফেস সার্চ এন্ড নেভিগেশন রেডার।১৯৭০ সালে সোভিয়েত কে এটি তৈরি করে। এর ন্যাটো নাম “প্লাম ফ্রন্ড”.

* সোভিয়েত ইউনিয়নের তৈরি ছয়টি এম আর ৯০ ওরেখ জি ব্যান্ড ফায়ার কন্ট্রোল রেডার ব্যবহার করা হয়েছে। এটি একটি এক্স ব্যান্ড রেডার যার রেঞ্জ ৩০ কিমি, এর ন্যাটো নাম ফ্রন্ট ডোম। কোন সারভিলেন্স রেডারে টার্গেট ডিটেক্ট হলে এই এমআর ৯০ রেডার নিজস্ব মিসাইল কে গাইডেন্স করে ডিফেন্সের জন্য। 

* রাশিয়ান এম আর -১৮৪ কাইট স্ক্রিচ ফায়ার কন্ট্রোল রেডার। 

* দুটি রাশিয়ান এম আর -১২৩ আই/জে ব্যান্ড “বাগিরা” ফায়ার কন্ট্রোল রেডার। 

* ইসরায়েলের তৈরি দুটি ইএল/এম -২ ২২১ ফায়ার কন্ট্রোল রেডার। এটি এক্স ও কা ব্যান্ড ডুয়াল রেডার যার রেঞ্জ ৩০ কিমি।

* রাশিয়ান গ্রানিট গ্রাপুন বি ফায়ার কন্ট্রোল রেডার। এটি একটি এক্স ব্যান্ড রেডার যা তৈরি হয়েছিল ১৯৮৯-৯৮ সালে।

এছাড়াও দিল্লি ক্লাস ডেস্ট্রয়ারে ভারত ইলেকট্রনিক লিমিটেডের তৈরি হামসা হাল মাউন্টেড সোনার ও থ্যালসের অ্যাডভান্সড টাওয়েড অ্যারে সোনার ব্যবহার করা হয়েছে। ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার সিস্টেম হিসাবে রয়েছে ভারত ইলেকট্রনিক লিমিটেড বা বেইলের তৈরি অজন্তা মার্ক ২ ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার সুট ও ইলেকট্রনিকা টিকিউএন-২ জ্যামার।

অস্ত্র হিসাবে দিল্লি ক্লাস ডেস্ট্রয়ারে রয়েছে:— 

* রাশিয়ান জেভেদ কেএইচ-৩৫ সাবসনিক টার্বোজেট অ্যান্টিশিপ মিসাইল। ১৯৮৩ সালে তৈরি হওয়া মিসাইলটির গতি ০.৮-০.৯৫ ম্যাক বা ৯৮০-১১৬৪ কিমি/ঘন্টা। এর অপারেশনাল রেঞ্জ ১৩০-৩০০ কিমি। ২০১০ সালের ডাটা অনুযায়ী একটি কেএইচ -৩৫ এর দাম প্রায় ৫ লাখ ডলার বা প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকা। শুধু যুদ্ধজাহাজ না, হেলিকপ্টার ও যুদ্ধবিমান থেকেও এই মিসাইল ফায়ার করা সম্ভব। 

* শর্ট রেঞ্জ এয়ারডিফেন্স সিস্টেম হিসাবে রয়েছে ইসরায়েলের তৈরি বারাক-১ সারফেস টু এয়ার মিসাইল। এর রেঞ্জ প্রায় ১২ কিমি এবং গতি ২.১ ম্যাক। তবে ভারতীয় নেভির বিভিন্ন যুদ্ধজাহাজে ব্যাবহৃত বারাক-১ কে আপগ্রেডেড বারাক-৮ মিসাইল দিয়ে রিপ্লেস করা হচ্ছে। 

* রাশিয়ান শ্টিল সারফেস টু এয়ার মিসাইল। সোভিয়েত ইউনিয়নের তৈরি এই মিসাইল কে থ্রিএস৯০ ও এসএ-এন-৭ গ্যাড ফ্লাই ও বলা হয়। মূলত মিডিয়াম রেঞ্জ অ্যান্টি শিপ মিসাইল এটি। এর সর্বোচ্চ গতি ২.৫ ম্যাক। দিল্লি ক্লাস ডেস্ট্রয়ার এমন ৪৮ টি মিসাইল বহন করে।

* শর্ট রেঞ্জ ডিফেন্স সিস্টেম হিসাবে রয়েছে ১০০ মিলিমিটার একে-১০০ গান ও দুটি ৩০ মিলিমিটার একে ৬৩০ গান।

* অ্যান্টি সাবমেরিন ওয়ারফেয়ারের জন্য রয়েছে দুটি আরবিইউ – ৬০০০ রকেট লঞ্চার ও ৫৩৩ মিলিমিটারের টর্পেডো টিউব। 

একটি দিল্লি ক্লাস ডেস্ট্রয়ার ২ টি সী কিং হেলিকপ্টার বহন করতে পারে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *