করোনার মতো আরও এক রুপ ১৯০০ সালে গোটা বিশ্বে আছড়ে পড়েছিল
নিউজ ডেস্ক – বর্তমানে যে মহামারীর জন্য গোটা বিশ্ব স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে আজ থেকে কয়েক শতাব্দী আগে সেই মহামারী গোটা বিশ্বে আছড়ে পড়েছিল অন্য রূপ নিয়ে। সেই সময়েও ঠিক করোনার মতো মৃত্যু হয়েছিল বহু মানুষের। স্বাস্থ্যবিধি মানতে হয়েছিল সেই সময়েও। এমন মহামারী রোগটির নাম ছিল স্প্যানিশ ফ্লু বা ইনফ্লুয়েঞ্জা। এটি মূলত ১০০ বছর আগে অর্থাৎ ১৯১৮ সালে ঘটেছিল। এই স্প্যানিশ ফ্লুর কারণে মৃত্যু হয়েছিল গোটা বিশ্বে প্রায় পাঁচ কোটি মানুষের। সেই সময়ে বিভিন্ন দেশের সরকার বিভিন্ন প্রটোকল মেনেছেন।
বর্তমানে কোভিড ১৯-য়ে বয়স্কদের সংক্রমনের সংখ্যা অধিক থাকলেও স্পানিশ ফ্লুতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি ছিল ২০-৩০ বয়সী মানুষদের। এই সংক্রমণের কারণে এক এক করে মৃত্যু হয়েছিল বহু মানুষের। সেইদিকে নজর দিয়েই তখনকার সময়ে সমস্ত বিনোদন হল ও তীর্থ স্থানে জনসাধারণের প্রবেশ নিষিদ্ধ করে দিয়েছিল সরকার। করোনার মতো স্প্যানিশ ফ্লু সংক্রমণ নিয়ে গবেষণা করে ইংল্যান্ড জনস্বাস্থ্য বিষয়ক সংস্থা জানিয়েছিলেন, ১৯১৮ সালের শরৎকালের রোগটি দ্বিতীয় ধাপে ছড়িয়ে পড়লে তার প্রথম দফার চেয়ে অনেক বেশি ভয়াবহ ও আতঙ্কিত ছিল। তাই ১৯১৮ সালের মে মাসে যখন প্রথম রোগ ধরা পড়েছিল যুক্তরাজ্যে তখন সময়কাল ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের। জনসাধারণদের জনসংযোগ করতে বারণ করা হলেও তারা মূলত শোনেনি। কারণে যুক্তরাজ্যের সরকার ও দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে ছিল যে যুদ্ধকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে না রোগকে।
পরবর্তীতে ১৯১৯ সালে রয়েল সোসাইটি অব মেডিসিনের জন্য স্যার আর্থার একটি প্রতিবেদনের মাধ্যমে জানিয়েছেন, গণপরিবহন, সৈনিক বহনকারী পরিবহন এবং যুদ্ধ উপকরণ তৈরি কারখানা মত দাবানলের আকারে ছড়িয়ে পড়ছে মারণরোগ স্প্যানিশ ফ্লু। যদিও এই রোগের এক বছর আগে অর্থাৎ ১৯১৮ সালে জুলাই মাসে মানুষদের ঘরে থাকতে এবং জনসমাগম এড়িয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। কার্যত এই নিয়ম মেনে চললে যে কয়েক লক্ষ প্রাণ গিয়েছে সেটি যেত না। অনেকে নামনাই আর্থার বলেছেন,”অনেক সময় জাতীয় পরিস্থিতি এমন হয় যে তখনকার প্রধান দায়িত্ব হয় চালিয়ে যাওয়া। এমনকি এমন সময়ও যখন স্বাস্থ্য এবং জীবনের ঝুঁকি মুখে থাকে।”
অর্থাৎ বর্তমানের মত তখনকার সময়ে ১৯১৮ সালে মহামারী রোগে স্প্যানিশ ফ্লু ইনফ্লুয়েঞ্জার ও চিকিৎসা ছিলনা এবং নিউমোনিয়া রোগের চিকিৎসার মতো কোন অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কার হয়নি। ঠিক বর্তমানে চিত্রই দেখা গিয়েছিল আজ থেকে কয়েক বছর আগে। দ্রুত রোগীর কারণে পূর্ণ হয়ে যেত হাসপাতাল। যার কারণে বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল একাধিক দোকানপাট, সিনেমা হল, মনোরঞ্জন করার জিনিসপত্র অর্থাৎ পার্ক ও গির্জা , মন্দির বা মসজিদ। তবে কেন্দ্রীয়ভাবে কোনরকম লকডাউন জারি করা হয়নি। এমনকি ইংল্যান্ড ফুটবল লীগ এবং এফএ কাপ যুদ্ধের জন্য আগেই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। তবে মহামারী কোন প্রভাব পড়েনি খেলার উপর। প্লেগ্রাউন্ডে অডিয়েন্স অ্যালাউ না করলেও খেলা চলেছিল সমস্ত প্রটোকল মেনে।
অন্যদিকে শহরের কিছু অংশের জীবাণুনাশক স্প্রে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল, মাস্ক ব্যবহার করত বহু মানুষ। মনোবিজ্ঞানীদের মতানুসারে ১৯১৮ সালে একটি নিষেধাজ্ঞা মেনে দেওয়া হয়েছিল। যেখানে লিখা ছিলো প্রতিদিন রাতে ও সকালের নাকের ভিতর সাবান জল দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে, সকালে ও রাতে জোর করে হাঁচি দিতে হবে এরপর লম্বা নিশ্বাস নিতে হবে। প্রতিদিন দ্রুতবেগে হাঁটতে হবে এবং কাজ থেকে হেঁটে বাড়ি ফিরতে হবে। কোনরকম মাফলার ব্যবহার করা যাবে না। কার্যত এই সকল নিষেধাজ্ঞা মেনে চললে কিছুটা স্থিতিশীল হবে দেশ। সেই সময়ে রটে গিয়েছিল ধূমপান করলে নাকি রোগ থেকে এড়ানো সম্ভব। তাই অধিক সংখ্যক মানুষ ধূমপান করতে।
তবে মহামারী নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রত্যেকটা দেশের সরকার একাধিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। যেমন যুক্তরাষ্ট্রের কোন কোন রাজ্য তাদের নাগরিকদের কোয়ারেন্টিন করার নির্দেশ দেয়। পাশাপাশি কোন কোন রাজ্য জনসাধারণের মুখে মাস্ক পরার নির্দেশ দেয়। মূলত ২০ বছর আগে যক্ষ্মার বিরুদ্ধে ক্যাম্পেইন চালিয়ে আসছিল নিউইয়র্করা। স্প্যানিশ ফ্লু জন্য ক্যাম্পেইন করছে তাদের খুব একটা অসুবিধা হয়নি। যার কারণে সেই দেশে মৃত্যু হয়েছিল খুব কম। তবে সকল দোকানপাট ও মনোরঞ্জনকর স্থান বন্ধ করে দেয়া হলেও জনসমাগম বন্ধ করা যায়নি মন্দির কিংবা তীর্থস্থান থেকে। মানুষের ঢল লেগেই থাকত মন্দির ও মসজিদে। এখানে সেই সময় যুক্তরাজ্যে মৃত্যুর হার বেড়ে দাঁড়িয়েছিল প্রায় দুই লাখ ২৮ হাজার। গোটা বিশ্বের এক চতুর্থাংশের মধ্যে অর্ধেক জনসংখ্যার মৃত্যু হয়েছিল। তবে সমস্ত প্রটোকল মানার পর সংক্রমণ কিছুটা ঢাকা না গেলেও তার পরেও বেশ কয়েকবছর সংক্রমণকে ঝাড়ে মূলে শেষ করতে সময় লেগেছিল প্রত্যেক সরকারের। ২০ সালে দাঁড়িয়ে যেমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হচ্ছে সাধারণ মানুষ ঠিক সেই রকমই কয়েক শতক আগেও একই দুর্যোগ দেখা দিয়েছিল গোটা পৃথিবীতে। মহামারীর কালো ছায়ায় ঢেকে গিয়েছিল গোটা বিশ্ব।