ডিফেন্স

স্বাধীনতার এতো বছর পর নেহেরুর মতো করে আবার আমেরিকানদের সামনে নতুন ভারতবর্ষের পরিচয় দেওয়া কি আদৌ দরকারী?

নিউজ ডেস্কঃ 70 বছর আগে নেহরু ঠিক যা করেছিলেন  জয়শঙ্কর বর্তমানে ঠিক সেই একই কাজ করছেন – ভারতকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিকট মিত্র দেশ রূপে কাছে কাছাকাছি আনতে চাইছে।

সরকার বর্তমানে বিশ্ববাসীর সামনে ভারতকে এক নতুন আলোকে তুলে ধরতে উদ্যত। ক্ষমতায় আসার পর থেকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং তার বিদেশ মন্ত্রী জয়শঙ্কর সুব্রহ্মণ্যম নানা দেশের বিভিন্ন হেভি ওয়েট  নেতা, থিঙ্ক ট্যাঙ্ক এবং মিডিয়া আউটলেটের সাথে কথা বলে চলেছেন। তবে, এতো আলাপ আলোচনায় মাঝেও একটা প্রশ্ন ওঠেই। কাশ্মীরের উন্নয়ন এবং ভারতীয় গণতন্ত্র সম্পর্কে বিদেশী কূটনীতিবিদদের উদ্বেগ বাড়ানো ছাড়া মোদির পররাষ্ট্রনীতি আদেও কি কিছু সদার্থক ভূমিকা পালন করতে পেরেছে? দুই দেশের মধ্যে দীর্ঘদিন চলা যাবতীয় কথোপকথন ছাপিয়ে যখন এই উদ্বেগগুলিই প্রথম স্থানে উঠে আসছে তখন ভারতের কূটনীতিকদের অবশ্যই উদ্বিগ্ন হওয়া প্রয়োজন এবং দরকার এই পুরোনো কূটনীতির কার্যকারিতা পর্যালোচনা করা।

বিশ্ববাসীকে, বিশেষত আমেরিকানদের ভারতের প্রতি আকৃষ্ট করার এবং বন্ধু হিসাবে পাশে পাওয়ার এই প্রচেষ্টা প্রথম শুরু হয় হিউস্টনে 22 শে সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী মোদীর ‘হাউডি, মোদি!’ ইভেন্টের মাধ্যমে। নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের (ইউএনজিএ) সাইডলাইনে ভারত ও আমেরিকার নেতাদের দ্বিপাক্ষিক, বহুপাক্ষিক বৈঠক এবং ওয়াশিংটন ডিসিতে এস. জয়শঙ্করের তিন দিনের আলোচনা সভার মাধ্যমে শেষ হয় মোদির এই ক্যাম্পেইন।

সংবাদ প্রতিবেদন অনুসারে, শুধুমাত্র নিউইয়র্কেই জয়শঙ্কর মোট ৪২ টি দেশের প্রতিনিধিদের সাথে দেখা করেছিলেন এবং প্রায় তিন ডজন দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেছিলেন। একই সাথে মাত্র এই কয়েক দিনেই, আটটি পুল অ্যাসাইড এবং  বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের সাথে আলাদা করে আরো ৭ টি বৈঠক সেরেছিলেন তিনি। জয়শঙ্কর আমেরিকায় প্রধানমন্ত্রীর ডাকা প্রত্যেকটা সভায় যেমন অংশ গ্রহণ করেছিলেন তেমনি নিউইয়র্কে বক্তৃতাও দিয়েছিলেন তিনি। নিউইয়র্কের পর ওয়াশিংটন ডিসিতে, জয়শঙ্কর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর, প্রতিরক্ষা বিভাগ এবং জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদে সভা করার পাশাপাশি পাঁচটি মার্কিন থিঙ্ক ট্যাঙ্কে সরকারী ও বেসরকারী অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিয়েছিলেন।

বৈঠকগুলো থেকে একটা কথা স্পষ্ট যে কংগ্রেস জমানা এবং মোদি জমানার মধ্যে ভারতের পরিবর্তন ও তফাৎ আমেরিকাকে বোঝাতে সচেষ্ট মোদি সরকার। তবে, ঘটনাটা কিন্তু সেই কিছুটা ১৯৪৯ সালের মতোই। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সদ্য স্বাধীন ভারতবর্ষের পরিচয় করানোর উদ্দেশ্যে এবং দীর্ঘমেয়াদী এক বন্ধুত্ব গড়ে তোলার আশায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় তিন সপ্তাহ সময় কাটিয়েছিলেন।

কিন্তু প্রশ্ন হলো আজ স্বাধীনতার এতো বছর পর নেহেরুর মতো করে আবার আমেরিকানদের সামনে ‘পুরাতন ভারত’ এর তুলনায় নতুন ভারত কতটা আলাদা তা ব্যাখ্যা করা বা নতুন ভারতবর্ষের পরিচয় দেওয়া কি অদেও দরকারী? আমরা ভারতীয়রা এখনও নিজেদের পুরোনো গৌরব সম্পূর্ণরূপে ভাবে ভুলতে পারিনা; হয়তো আমরা এখনও বিশ্বাস করি যে শুধুমাত্র ৫০০০ বছরের পুরনো সভ্যতা, সংস্কৃতি সমৃদ্ধ ইতিহাস থাকার কারণে ভারত এখনো জগৎ সভায় এক উচ্চ আসন পাওয়ার হকদার। তবে, মুশকিল হলো এসব আবেগ নিয়ে চলে না আন্তর্জাতিক কূটনীতি।

আমেরিকা সফরে কৌশলগত ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আমেরিকার বন্ধুত্ব অর্জনের চেষ্টায় ভারত অন্যান্য বারের মতোই এদেশের উচ্চ জনসংখ্যা, এশিয়ায় কৌশলগত  অবস্থান এবং অতীতের ঐতিহ্যের ওপর ভিত্তি করে ভারতের গুরুত্ব আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে ঠিক কতটা তা বোঝানোর চেষ্টা চালিয়েছে। একই সঙ্গে আলাদা করে, কাশ্মীর ইস্যু সহ বিভিন্ন বিষয়ে যারা ভারতে মোদি সরকারের কর্মকাণ্ডকে বিভিন্ন ভাবে সমালোনা করেছে তারা কীভাবে ভারতকে বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে সেটাও বিস্তৃত ভাবে আমেরিকা সফরে এবার বোঝানোর চেষ্টা চলেছিল।

স্বাধীনতার পর পেরিয়ে গেছে বহু বছর। ১৯৪৭ সালের তুলনায় স্বাভাবিক ভাবেই ভারতের অর্থনৈতিক শক্তি বৃদ্ধি পেয়েছে অনেকটাই। এখন অতীতের তুলনায় অনেক বেশি কৌশলগত অংশীদারিত্ব ভোগ করতে পারছে ভারত। তার ওপর উপরি পাওনা হলো আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এমন একজন ব্যক্তি যিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ভালো ভাবে বোঝেন, রাষ্ট্রদূত হিসাবে ওয়াশিংটন ডিসিতে সময় কাটিয়েছেন এবং সর্বোপরি স্পষ্টভাষী ও সুভাষী।

জয়শঙ্কর ভালো করেই জানেন যে ওয়াশিংটন ডিসিতে পুরোনো কথা কেউ বেশি দিন মনে রাখে না। শত্রুর বন্ধু হতেও সময় লাগে না আবার বন্ধুর শত্রুতে পরিণত হতেও। সবচেয়ে বড় কথা হলো তিনি বোঝেন যে সেখানে গুরুত্বপূর্ণ স্টেকহোল্ডারদের আকর্ষণের জন্য ভিউ পয়েন্ট পুনরাবৃত্তি করা যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি একই সাথে সমান গুরুত্বপূর্ণ হলো দৃষ্টিভঙ্গি পর্যালোচনা করা এবং অন্যদের উদ্বেগে সাড়া দিয়ে তা মেটানোর চেষ্টা করা।

ঠান্ডা যুদ্ধ চলাকালীন আমেরিকা ও ভারতের মতবিরোধ ঘটেছে প্রায়শই তবে, বর্তমান সম্পর্কের নিরিখে মার্কিন যুক্তাষ্ট্রের স্বার্থকে চিরতরে উপেক্ষা করা সম্ভব নয় ভারতের পক্ষে। বিশ্বশক্তি হিসাবে এশিয়াতে চীনের উত্থানের মাঝে ভারতের উদার অর্থনীতি, বিশ্ব মঞ্চে নতুন করে এক বড় ভূমিকা পালন করতে চাওয়ার ইচ্ছা আমেরিকার সামনে এক কৌশলগত অংশীদারিত্বের আশা উত্থাপিত করেছে। আমেরিকার এই প্রত্যাশা ভারতকে উপকৃত করেছে বিভিন্ন দিক দিয়ে। একই সঙ্গে বিগত কয়েক দশকে এই ভারত-মার্কিন সম্পর্ক সেই দেশের সব রাজনৈতিক দলেরও সমর্থন লাভ করেছে।

আজ সম্পর্কটি কেবল 4 মিলিয়ন (40 লক্ষ) ভারতীয়-আমেরিকানদের উপর নির্ভর করে নয়, বরং এক শক্তিশালী অর্থনৈতিক সম্পর্ক এবং দুই দেশের কৌশলগত অংশীদারিত্বের সম্ভাবনার উপরও ভীষণভাবে নির্ভর করে। চীনের উত্থানের মাঝে ভারত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক অন্যতম ডিফেন্স পার্টনারের পরিণত হয়েছে। এই মুহূর্তে চীনের উত্থানের বিরুদ্ধে আমেরিকার নেতৃত্বাধীন ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজির একেবারে কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে নয়াদিল্লি।

ইরান সম্পর্কে আমেরিকা ও ভারতের ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি এবং সীমান্তে ভারসাম্য রক্ষার খেলাতে চীনের সাথে তাল মিলিয়ে ভারতের নিজস্ব উচ্চাকাঙ্ক্ষার বহিঃপ্রকাশ; আমেরিকার শত্রু দেশ রাশিয়ার কাছ থেকে তৈরি প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম S-৪০০ কেনা, এই সবই দুই দেশের সম্পর্কে কিছুটা হলেও অস্থিরতার সৃষ্টি করেছে। ভারত-মার্কিন দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য আজ বৃদ্ধি পেয়ে ১৪২ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে ঠিকই কিন্তু, জাতীয়তাবাদী, সুরক্ষাবাদী মনোভাব এবং অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এখনো ঠিক ভাবে সামাল দেওয়া না গেলে ভবিষ্যতে ভারত ও আমেরিকার সম্পর্কে চির ধরবে অনিবার্য ভাবে। 

বিগত দুই দশকে ভারতের অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ অন্যান্য অনেক দেশের কাছেই ভারতকে করে তুলেছিলো বেশ আকর্ষণীয়। কিন্তু, হঠাৎ দেশের অর্থনীতিতে যে মন্থরতা দেখা গেছে তাতে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন কিছুটা হলেও সেই আকর্ষণে ভাটা পড়বে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে, শুধুমাত্র ভারতীয় এবং আমেরিকানরা একে অপরকে পছন্দ করে বলেই আমেরিকা নিশ্চয়ই ওভারল্যাপিং অর্থনৈতিক অসুবিধার কারণে ক্ষতিপূরণ দিতে চাইবে না! আবার একই ভাবে ভারত বার বার উভয় দেশে একই রকম গণতন্ত্রের বুলি আউড়ে, একই মূল্যবোধ ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু হওয়ার দাবি করে চিরকাল মার্কিন স্বার্থকে উপেক্ষা করতে পারে না।

শেষ পর্যন্ত, সম্পর্ক বজায় রাখার স্বার্থে ভারতকে আমেরিকার অনুরোধে সাড়া দিয়ে আজ না হয় কাল বেশ কিছু বাণিজ্যিক নীতিতে পরিবর্তন আনতেই হবে। ভারতের বাজারে মার্কিন প্রবেশাধিকার এবং মার্কিন প্রযুক্তি সংস্থাগুলির ব্যবসার জন্যেও আমাদের অবশ্যই কিছু সুযোগ সুবিধার ব্যবস্থা করে দিতে হবে।  ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে চীনের আধিপত্য রুখতে চাইলে আমেরিকার আশা পূর্ণ করে ভারতকে শীঘ্রই নিজের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে হবে। 

তবে,গান্ধীর প্রতি আমেরিকানদের ভালবাসা এবং ভারতের যে যে বৈশিষ্ট্যগুলি এতোদিন এই দেশের প্রতি আমেরিকানদের সম্মান ও আকর্ষণ বৃদ্ধি করতো সেগুলিকে বর্তমানে ভারতের নেতৃবৃন্দ এক প্রকারে জলাঞ্জলি দিয়ে স্রোতের বিপরীতে পা চালাতেই বদ্ধপরিকর বলে মনে হয়। মহাত্মা গান্ধী যে এখনো নিঃসন্দেহে আমেরিকানদের পরিচিত সবচেয়ে জনপ্রিয় ভারতীয় – তা মহাত্মা গান্ধীর ১৫০ তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে হোয়াইট হাউসের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি এর বক্তৃতাতেই পরিষ্কার হয়ে গেছিলো। এমনকি হালে ২ অক্টোবরে দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস- এ গান্ধী সম্পর্কিত এক নিবন্ধে মোদি নিজেও তা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন।

ভারতবর্ষ বরং আমেরিকার কাছ থেকে বেশি সমর্থন লাভ করবে আমেরিকার নিউ ইয়র্ক টাইমসের পাঠকদের সঠিক ভাবে আশ্বস্ত করতে পারলে। তার জন্য আমেরিকানদের বোঝানো দরকার যে ‘ নতুন ভারতের’ নেতারা আমেরিকার মতোই ভালোবাসে গান্ধীর অহিংসা নীতি। বিশ্বাস করে সংখ্যালঘুদের প্রতি সহনশীলতায় এবং সমর্থন জানায় বৈচিত্র্যেকে।

যতক্ষণ না ভারতের যে সমস্ত নীতি বা নীতিহীনতাগুলো আমেরিকানদের ভাবতে আরম্ভ করেছে সেগুলো নিয়ে সরকার কোনো রকম পরিবর্তন আনছে ততক্ষণ ভারতের বর্তমান কূটনীতির দ্বারা আমেরিকার সাথে স্থায়ী এক সম্পর্ক গঠন করা নিঃসন্দেহে  হবে বেশ কঠিন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *