Uncategorised

বিমানবাহিনীর কিংবদন্তি যুদ্ধবিমান। ১৫০ এর উপর পাইলটের প্রান যাওয়ার পরেও কেন ফ্লাইং কফিন নামে খ্যাত মিগ-২১ একটিভ রাখা রয়েছে?

রাজেশ রায় : ভারতীয় বিমানবাহিনীতে অ্যাক্টিভ থাকা একটি কিংবদন্তি যুদ্ধবিমান হচ্ছে রাশিয়ান মিগ-২১। ১৯৬০ এর দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের তৈরি মিগ-২১ আক্ষরিক অর্থেই ছিল আকাশের রাজা। শত্রুর কাছে মূর্তিমান আতঙ্ক ছিল মিগ-২১। সোভিয়েত ইউনিয়নের মিকোয়ান গুরেভিচ কোম্পানির তৈরি মিকোয়ান মিগ -২১ আদতে একটি সুপারসনিক ও ইন্টারসেপ্টার যুদ্ধবিমান। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরোধী জোট ন্যাটো একে ফিশবেড বলে। মিগ -২১ কে আদর করে বলালাইকা ও বলা হয় যা রাশিয়া ও পূর্ব ইউরোপের একটি বিশেষ ধরনের বাদ্যযন্ত্র। পোল্যান্ড মিগ-২১ এর বিশেষ আকারের জন্য একে পেনসিল বলে। ভিয়েতনাম ভাষায় একে এন ব্যাক বলে যার অর্থ সাদা চড়ুই।

১৯৫০ এর দিকে মিগ-২১ তৈরির কাজ শুরু হয়। সোভিয়েত ইউনিয়নের তৈরি প্রথম সুপারসনিক যুদ্ধবিমান মিগ-১৯ এর উপর নির্ভর করে আরও অত্যাধুনিক ভার্সন মিগ-২১ তৈরি করা হয়। সোভিয়েত সেসময় ম্যাক-২ গতির অনেক প্রোটোটাইপ তৈরি করেছিল যাট মধ্যে সুখোই এর তৈরি Su-7 ও ছিল তবে সবের মধ্যে মিগ-২১ ছিল সবচেয়ে সফল মডেল। মিকোয়ান সংস্থা প্রথমে ১৯৫৪ সালে Ye-1 নামে একটি প্রোটোটাইপ তৈরি করেছিল কিন্তু এর ইন্জিন পারফরম্যান্স আশানুরূপ না হওয়ায়, নতুন করে ডিজাইন করে Ye-2 নামে একটি প্রোটোটাইপ তৈরি করা হয় কিন্তু এরও উইং বা ডানায় সমস্যা দেখা যায়। যারজন্য ডেল্টা উইং বিশিষ্ট Ye-4 নামে আরও একটি প্রোটোটাইপ তৈরি করা হয়, এটিরই পরে মিগ-২১ নাম হয়। ১৯৫৫ সালের ১৬ ই জুন এর প্রথম ফ্লাইট টেস্ট হয়। ১৯৫৬ সালে মস্কোর তুসিনো এয়ারফিল্ডে সোভিয়েত অ্যাভিয়েশন ডে উপলক্ষে এটি প্রথম জনসমক্ষে আসে।

সোভিয়েত ইউনিয়নের তৈরি মিগ-২১ এমনই একটি মাস্টারপিস যাতে ফাইটার ও ইন্টারসেপ্টারের উভয় গুনই আছে। এর প্রতিপক্ষ যুদ্ধবিমান ছিল আমেরিকার লকহিড মার্টিনের F-104 স্টারফাইটার, ফ্রান্সের মিরাজ-৩ ও নর্থ্রুপ গ্রুম্যানের এফ -৫ ফ্রিডম ফাইটার। 

১৯৫৯-৮৫ এই ২৬ বছরে ১১,৪৯৬ যুদ্ধবিমান তৈরি করা হয়েছিল, যার মধ্যে ১০,৬৪৫ টি বিমান সোভিয়েত ইউনিয়ন তৈরি করেছিল, ৮৪০ টি ভারতে এবং ১৯৪ টি চেকস্লোভিয়া তে তৈরি করা হয়েছিল। বিশ্বের ৬০ টি দেশ মিগ-২১ ব্যবহার করে। প্রায় ৬০ বছর পরেও ভারত সহ বিশ্বের অনেক দেশের বায়ুসেনা তে আজও মিগ-২১ সার্ভিসে আছে। ভারত ৮৪০ টি মিগ-২১ কিনেছিল। সেই ১৯৬২ সালে ভারত মিগ-২১ কিনেছিল প্রথম। ভারতে এই বিমান তৈরি করেছিল হিন্দুস্তান এরোনটিকস লিমিটেড বা হ্যাল। ভারতের বায়ুসেনা তে এখনও ৬৪ টি মিগ-২১ রয়েছে। ভারতের অন্যতম শত্রু দেশ চীন প্রথমে কিছু সংখ্যক মি-২১ কেনে, তারপর কপি করে চেংদু জে-৭ নামে একটি যুদ্ধবিমান তৈরি করে। চীনের বিমানবাহিনী তে এখনও ৩৮৮+ জে-৭ সার্ভিসে আছে। 

মিগ-২১ এ অস্ত্র হিসাবে একটি ২৩ মিমি gryazev-shipunov gsh-23L  অটোক্যানন রয়েছে। মিগ-২১ এ মোট ৫ টি হার্ড পয়েন্ট রয়েছে যা এস-২৪, ইউবি-১৬-৫৭ রকেট বহন করতে পারে এবং এয়ার টু এয়ার মিসাইল হিসাবে রয়েছে কে-১৩, আর-৫৫, আর-৬০ মিসাইল। এছাড়াও মিগ -২১ একসাথে দুটো ৫০০ কেজি ও ২ টো ২৫০ কেজি বোম্ব বহন করতে পারে।

ভারতের মিগ-২১ কেনে ১৯৬২ সালের আগস্ট মাসে, চুক্তি অনুযায়ী সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে সরাসরি ১২ টি মিগ-২১ কেনা হয়েছিল এবং মিগ-২১ এর লাইসেন্স প্রোডাকশন ভারতে হ্যাল তৈরি করেছে। মিগ-২১ এর পাইলট ট্রেনিং এর জন্য তৎকালীন সময়ে ভারতীয় বিমানবাহিনীর আটজন পাইলট কে রাশিয়া পাঠানো হয়েছিল যাদের লিডার ছিলেন উইং কম্যান্ডার দিলবাগ সিং যিনি পরে ভারতীয় বিমানবাহিনীর প্রধান হয়েছিলেন। প্রথমে মিগ-১৫, মিগ-১৭ বিমানের উপর ট্রেনিং দেওয়া হয়েছিল তারপর মিগ-২১ এর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। ১৯৬৩ সালের চন্ডীগড়ে মিগ-২১ এর প্রথম স্কোয়াড্রন গঠন করা হয়, যার নাম দেওয়া হয় “ফাস্ট সুপারসনিক”. ১৯৬৫ সালে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে দ্বিতীয় কাশ্মীর যুদ্ধে ভারত সর্ব প্রথম মিগ-২১ ব্যবহার করেছিল। সেই সময় ভারতের কাছে মাত্র ৮ টি মিগ-২১ ছিল, বাধ্য হয়ে সেগুলোই ব্যবহার করতে হয়েছিল। মিগ-২১ কে ভারতীয় বিমানবাহিনীতে ত্রিশূল বলা হয়। 

ভারতীয় বিমানবাহিনীতে এখন যে মিগ-২১ গুলো রয়েছে এগুলো মিগ-২১ এর সর্বাধুনিক ভার্সন এর নাম মিগ-২১ ইউপিজি যা বাইসনের আপগ্রেড ভার্সন, যা ২০২৫ পর্যন্ত ভারতীয় বিমানবাহিনীতে সার্ভিসে থাকবে। বাইসন ভার্সন তৈরি করা হয়েছে মিগ-২১ ৯৩ আপগ্রেডের উপর নির্ভর করে।১৯৯১ সালে মিকোয়ান ৩৯ প্যারিস এয়ারশো তে মিগ-২১ এর মিড লাইফ আপগ্রেডেশন প্রকাশ করেছিল। এটা সম্ভব হয়েছিল মিগ-২১ এর জন্য বিশেষ এনপিও ফেজাট্রন কোপিও রেডার তৈরির পর যা আগের আরপি ২২ রেডার কে রিপ্লেস করে। মোস এয়ারশো ১৯৯২ তে সর্বপ্রথম এই কোপিও রেডার জনসমক্ষে আনা হয়। এই রেডার একসাথে ৮ টি টার্গেট কে চিহ্নত করতে এবং ২ টি টার্গেট কে এনগেজ করতে সক্ষম। এই রেডার আপগ্রেডেশনের ফলেই মিগ-২১ এর সক্ষমতা বহুগুণ বেড়ে গিয়েছিল, কারন এই আপগ্রেডের ফলে মিগ-২১ এ রাশিয়ার বিখ্যাত আর-৭৩ ও আর-৭৭ এয়ার টু এয়ার মিসাইল ইনস্টল করা সম্ভব হয়। ডগফাইটে মিগ-২১ এর চারটি মোড রয়েছে, প্রথম হচ্ছে ভারটিক্যাল মোড, যুদ্ধবিমানটির একদম সামনে থাকা টার্গেটের বিরুদ্ধে এই মোড ব্যবহার হয়। দ্বিতীয় হচ্ছে কাই (KAI) মোড, এটি একটি রাশিয়ান শব্দ। রেডার এর + – ১৪ ডিগ্রি কোনে থাকা টার্গেটের বিরুদ্ধে এই মোড অটোমেটিক টার্গেটকে লক করে। তৃতীয় হচ্ছে অপটিক্যাল মোড, এই মোডে পাইলট নিজে থেকেই ম্যানুয়ালি এমিং পাইপারের সাহায্যে টার্গেট কে লক করতে পারে। চতুর্থ হচ্ছে HMDS বা হেলমেট মাউন্টেড ডিসপ্লে সাইট। এটি একটি বিশেষ সিস্টেম, যার দ্বারা পাইলট যে দিকে তাকাবে টার্গেট অটোমেটিক লক হয়ে যাবে, এখন সব আধুনিক যুদ্ধবিমানে এই টেকনোলজি ব্যবহার করা হয়। এই রেডার টেস্টিং এর সময় টোটাল ১২ টি মিসাইল ফায়ার করা হয়েছিল, যা ১০০ শতাংশ টার্গেট কে হিট করেছিল অর্থাৎ এর কিল রেশিও ছিল শতভাগ। ১৯৯৮ সালে ৩ মে ভারতীয় সরকার মিগ-২১ ইউপিজি প্রজেক্ট শুরু করা হয়। এই প্রজেক্টের আওতায় ১২৫ টি মিগ-২১ বাইসন কে ৪২৮ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে আপগ্রেড করা হয়েছে। ৬ অক্টোবর ১৯৯৮ সালে প্রথম মিগ-২১ ইউপিজি ভার্সন এর ফ্লাইট টেস্ট হয় এবং ২০০০ সালের ১৪ ডিসেম্বর ভারতীয় বিমানবাহিনীতে প্রথম মিগ-২১ ইউপিজি যুক্ত হয়েছিল। এই আপগ্রেডেশনে ফ্রান্সের থ্যালস কোম্পানির টোটেম নেভিগেশন কম্পিউটার ও সেক্সট্যান্ট অ্যাভিয়নিক কোম্পানির তৈরি হেলমেট মাউন্টেন ডিসপ্লে সাইট, টপ ফ্লাইট নেভিগেশন সিস্টেম ও যুক্ত করা হয়েছিল।

বর্তমানে সবাই জানেন মিগ-২১ কে উড়ন্ত কফিন বলা হয় কিন্তু জানেন কী এর কারন কী? কবে থেকে এর শুরু?  ২০১২-২০২১ পর্যন্ত ৯ টি মিগ-২১ ইউপিজি দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে যাতে পাচজন পাইলট বীরগতি প্রাপ্ত হয়েছেন। ভারত মোট ৮৭২ টি মিগ-২১ ক্রয় করেছিল, আপনারা শুনে চমকে যাবেন ১৯৬৩-২০০২ মাত্র ৪০ বছরে ৪৮২ টি মিগ-২১ দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে যাতে ১৭১ জন পাইলট বীরগতি প্রাপ্ত হয়েছেন ও ৩৯ জন সাধারণ মানুষ মারা গেছে। ২০০৬ সালে বলিউডে মিগ-২১ এর উপর তো একটা সিনেমাই তৈরি হয়েছিল যার নাম রং দে বসন্তি, যার প্রধান চরিত্র ছিল আমির খান। দেখুন মিগ-২১ কিন্তু মোটেও খারাপ বিমান না, কিন্তু প্রতিটা জিনিসের একটা নির্দিষ্ট সময় থাকে। মিগ-২১ এর সোনালী সময় ছিল ১৯৮০ পর্যন্ত। তারপর সোভিয়েত ইউনিয়নও এর প্রোডাকশন বন্ধ করে দেয়। আর আমাদের সব মিগ ২১ এর দুর্ঘটনার বেশীরভাগই হয়েছে নম্বই এর দশকে। ১৯৯০ এর দিকে ভারতীয় বায়ুসেনা সরকার কে বারবার অনুরোধ করে এই যুদ্ধবিমান বদলাতে কিন্তু নব্বই এর দশকে ভারতের অর্থনীতির অবস্থা খারাপ ছিল যার জন্য তখন নতুন যুদ্ধবিমান কেনা সম্ভব হয় নি। কিন্তু ২০০৭ থেকে মাল্টিরোল যুদ্ধবিমানের টেন্ডার বারবার পিছিয়ে গেছে যারজন্য ততকালীন কংগ্রেস সরকার সম্পূর্ণ দায়ী বলে মনে করেন সামরিক বিশেষজ্ঞরা। ২০১৬ সালে বিজেপি সরকার যখন ফ্রান্সের সাথে রাফায়েল কেনার ডিল করল তখনও তার উপর দুর্নীতির অভিযোগ এনে কংগ্রেস জলঘোলা করল, পরে সুপ্রিম কোর্টে প্রমান হল রাফায়েল চুক্তি স্বচ্ছ ছিল। শুধুমাত্র রাজনীতির কারনে ভারতীয় বায়ুসেনা তে আজও মিগ-২১ এর মতন ফ্লাইং কফিন কে সার্ভিসে রাখতে হচ্ছে। মিগ-২১ এর এয়ারফ্রেমের লাইফটাইম শেষ হয়ে গেছে, মিগ-২১ এর প্রোডাকশন সেই আশির দশকে বন্ধ হয়ে গেছে যারজন্য এখন স্পেয়ার পার্টসের সমস্যা রয়েছে, তাই দুর্ঘটনা ঘটে। মিগ-২১ কে ফ্লাইং কফিন বলা হলেও এর দায় কিন্তু মিগ-২১ এর কখনওই হতে পারে না। ষাট বছরের পুরোনো বিমান ব্যবহার করলে দুর্ঘটনা হবেই। ২০২৫ এ তেজস মার্ক ১ দ্বারা মিগ-২১ গুলোকে রিপ্লেস করা হবে।

মিগ-২১ এর সেরা কৃতিত্ব হচ্ছে ২০১৯ এর ফেব্রুয়ারীতে। স্যার অভিনন্দন বীরত্বের সাথে পাকিস্তানের মাটিতে ঢুকে F-16 কে ধ্বংস করেছিল। F-16 ব্লক-৫০ মিগ-২১ এর থেকে অনেক আপগ্রেডেড, তারপরেও মিগ-২১ তাকে ধ্বংস করে যা স্পষ্ট প্রমান করে সোনালী দিনে সত্তরের দশকে মিগ-২১ কী ছিল! আমেরিকা, ইসরায়েল সহ ইউরোপের সমস্ত গুপ্তচর সংস্থা একসময় এই মিগ-২১ চুরির কম চেষ্টা করে নি। শেষপর্যন্ত ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ ১৯৬৩ তে একটি ইরাকের মিগ-২১ নিয়ে আসে যা ইতিহাসে অপারেশন ডায়মন্ড নামে পরিচিত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *