পরমানু বোম্ব বহনে সক্ষম ভারতবর্ষের যে যুদ্ধবিমান ১৫০ রাউন্ড করে ফায়ারিং করার পাশাপাশি যা যা করতে পারে
রাজেশ রায়ঃ আজ আমরা আলোচনা করব ভারতীয় বিমানবাহিনীতে যুক্ত থাকা একটি মাস্টারপিস বিমান সম্পর্কে যার নাম হচ্ছে সেপিক্যাট জাগুয়ার। ভারতীয় বিমানবাহিনীতে জাগুয়ার কে আদর করে “সামশের” বা তরোয়াল ও বলা হয়। অনলাইনে এই বিমান সম্পর্কে তেমন কোন ভাল প্রতিবেদন নেই, তাই এর ক্ষমতা সম্পর্কে অনেকেই জানেন না, তাছাড়া এটি অনেক পুরোনো বিমান হওয়ায় একে এবার নতুন কোন মাল্টিরোল সুপারসনিক বিমান দিয়ে রিপ্লেস করে দেওয়া উচিৎ বলে মনে করেন সামরিক বিশেষজ্ঞরা। সত্যিই কী জাগুয়ার কে অবসরে পাঠানো উচিৎ? নাকী এখনও সার্ভিসে রাখা দরকার!
সময়টা ১৯৬০ এর দিকে। ফ্রান্স ও ব্রিটেন দুটি দেশই একটি সুপারসনিক ট্রেনিং বিমানের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে। বিশেষ করে ব্রিটেন তাদের ফোল্যান্ড গ্যানাট টি-১, হকার হান্টার টি-৭ বিমান এবং ফ্রান্স তাদের লকহিড টি-৩৩, ড্যাসল্ট মিস্ট্রি ৪, ফওগা ম্যাজিস্টার বিমানগুলির বিকল্প হিসাবে একটি আধুনিক, লাইট অ্যাটাক, সুপারসনিক যুদ্ধবিমানের প্রয়োজনীতা অনুভব করে। এর জন্য ব্রিটেন ও ফ্রান্স যৌথভাবে একটি বিমান তৈরির ব্যপারে চুক্তি করে ১৯৬৫ সালে। দুটি দেশের অনেক কোম্পানি যেমন ব্যাক, হান্টিং, ব্রাগুয়েট, ফোল্যান্ড এই কনট্রাক্ট পাবার জন্য আবেদন করে। শেষপর্যন্ত ব্যাক, ব্রাগুয়েট এবং ব্রিটিশ এয়ারক্রাফট কর্পোরেশন যৌথভাবে এই বিমান তৈরির দায়িত্ব পায়। ব্রিটেন ও ফ্রান্স আলাদাভাবে নিজেদের দেশে জাগুয়ারের দুটি ভার্সন তৈরি করে।
১৯৬৮ সালের ৮ সেপ্টেম্বর জাগুয়ারের প্রথম ব্রিটিশ মডেলকে আকাশে দেখা যায়। ১৯৬৯ সালে মার্চ মাসে ফ্রান্সের জাগুয়ার ভার্সন প্রথম উড্ডয়ন করে। ১৯৭৩ সালে প্রথম জাগুয়ার ভার্সনটি সার্ভিসে আসে। ১৯৬৮-৮১ সাল পর্যন্ত সর্বমোট ৫৪৩ টি জাগুয়ার যুদ্ধবিমান তৈরি হয়েছে যা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বায়ুসেনাতে তে যুক্ত আছে। বর্তমানে ব্রিটেন, ফ্রান্স, ভারত সহ ইকুয়েডর, ওমান, নাইজেরিয়া এই বিমান ব্যবহার করেছে, ভারতীয় বিমানবাহিনীতে এখনও সার্ভিসে আছে এই জাগুয়ার।
জাগুয়ার যুদ্ধবিমানটি দুই ইন্জিন বিশিষ্ট, সুপারসনিক, লাইট অ্যাটাক বিমান। এর সর্বোচ্চ গতি ১৩৫০ কিমি/ঘন্টা, কমব্যাট রেঞ্জ ৮১৫ কিমি। হ্যা রেঞ্জ হয়ত কম মনে হচ্ছে কিন্ত তখনকার দিনে এর প্রতিদ্বন্দ্বী বিমান সোভিয়েত ইউনিয়নের মিগ-২৭ এর থেকে এর রেঞ্জ বেশী। জাগুয়ারের একটা দারুন ব্যপার হচ্ছে মাত্র ৩০ মিনিটে এর ইঞ্জিন পরিবর্তন করা যায়। বলা বাহুল্য জাগুয়ারের বিশ্ব বিখ্যাত কোম্পানি রোলস রয়েসের ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয়।
জাগুয়ারে মোট ৭ টি হার্ড পয়েন্ট রয়েছে
* এতে দুটি ৩০ এম এম গান রয়েছে, যাতে ১৫০ রাউন্ড করে ফায়ারিং হয়।
* জাগুয়ারে ৮ টি মাট্রা ও ১৮ টি স্নেব রকেট ব্যবহার করা হয়েছে।
* মিসাইল হিসাবে যুদ্ধবিমানটিতে রয়েছে :–
> AS.37 মার্শাল অ্যাটি রেডার মিসাইল
> ২ টি এইম সাইডউইন্ডার এয়ার টু এয়ার মিসাইল।
> রুদ্রম -১ অ্যান্টি রেডিয়েশন মিসাইল
> অ্যান্টিশিপ মিসাইল হিসাবে রয়েছে হারপুন ও সী ইগল মিসাইল
> ডিআরডিও এর স্মার্ট অ্যান্টি এয়ারফিল্ড ওয়েপন।
> ২ টি R550 ম্যাজিক এয়ার টু এয়ার মিসাইল।
> AS-30 L লেজার গাইডেড এয়ার টু গ্রাউন্ডেড মিসাইল।
> এতে বিভিন্ন ধরনের লেজার গাইডেড বোম্ব ব্যবহার করা হয়।
জাগুয়ারের উপর আগ্রহ ভারতীয় বিমানবাহিনীর ১৯৬৬ সাল থেকেই ছিল, কিন্তু তখন এই প্রজেক্টের ভবিষ্যত সম্পর্কে ব্রিটেন ও ফ্রান্স নিজেরাই বিভ্রান্ত ছিল। সেই কারনে বেশীদূর এগোয় নি। তারপর ১৯৭৮ সালে ভারত ব্রিটেনের সাথে জাগুয়ার কেনার চুক্তি করে। সেইসময় ভারতের বিমানবাহিনীতে থাকা হকার হান্টার ও ক্যানবেরা বোম্বার গুলোর বিকল্প হিসাবে ভারতের নজরে তিনটি বিমান ছিল জাগুয়ার, ফ্রান্সের মিরাজ এফ-১ ও সুইডেনের সাব ভিগান। কিন্ত মিরাজ এফ-১ ও সাব ভিগান ছিল এক ইঞ্জিন বিশিষ্ট বিমান এবং জাগুয়ার ছিল দুই ইন্জিন বিশিষ্ট বিমান যার জন্য শেষ পর্যন্ত জাগুয়ার ক্রয় কর ভারতীয় বিমানবাহিনী। দেখুন দুই ইন্জিন বিশিষ্ট বিমান সর্বদা এক ইন্জিন বিশিষ্ট বিমানের থেকে বেশী নিরাপদ কারন কোন কারনে একটি ইঞ্জিন বিকল হয়ে গেলে আরেকটি ইন্জিন দিয়ে বিমনাটিকে নিরাপদ ভাবে অবতরন করানো সম্ভব। চুক্তি অনুযায়ী ব্রিটেন থেকে সরাসরি ৪০ টি জাগুয়ার কেনা হয়েছিল ও ভারতে ১২০ টি জাগুয়ার তৈরি হয়েছিল। এছাড়া ব্রিটেনের বিমানবাহিনীর ১৮ টি জাগুয়ার আনা হয়েছিল যাতে ভারতীয় ইন্জিনিয়াররা জাগুয়ার সম্পর্কে পুঙ্খানুপুঙ্খ শিখত। ভারত প্রথম জাগুয়ার বিমান পেয়েছিলো ১৯ জুলাই, ১৯৭৯ সালে। আর ভারতীয় বিমানবাহিনীর প্রথম জাগুয়ার স্কোয়াড্রন তৈরি হয়েছিল তার নাম ছিল ১৪ নং স্কোয়াড্রন যা হরিয়ানার আম্বালা তে ছিল। বলে রাখা ভালো যে স্কোয়াড্রন বলতে বোঝায় অনেকগুলো বিমান একসাথে। সাধারণত ১৬,১৮,২০,২২ টি বিমান নিয়ে এক একটি স্কোয়াড্রন তৈরি হয়, বিভিন্ন দেশের বিমানবাহিনী তে এর হিসাব ভিন্ন হয়ে থাকে। তবে ভারতীয় বিমানবাহিনীতে ১৮ টি বিমান নিয়ে একটি স্কোয়াড্রন তৈরি হয়। ভারতে হিন্দুস্তান এরোনটিকস লিমিটেড বা হ্যাল জাগুয়ার তৈরি করত।
ভারতীয় বিমানবাহিনী তাদের ৮ টি জাগুয়ার কে বিশেষভাবে আপগ্রেড করেছিল যা নৌসেনা ব্যবহার করত। প্রথমে যে জাগুয়ার গুলো এসেছিলো তার নেভিগেশন সিস্টেম সহ ওয়েপনস এমিং আরও সব সিস্টেম অতটা কার্যকারি ছিল না, একে নাভাস সিস্টেম বলা হত। পরে ব্রিটেন তাদের নিজস্ব সিস্টেম তৈরি করে, যার নাম ফ্যারান্টি সিস্টেম। ব্রিটেন এই প্রজেক্টে অংশ নেবার জন্য ও বিনিয়োগের জন্য ভারত কে বলে কিন্তু ব্রিটেন চালাকি করে আসল ফ্যারান্টি সিস্টেমের বদলে একটু্ কম কার্যকারী সিস্টেম অফার করে ভারত কে। ভারত ব্রিটেনের ফাঁদে না পড়ে নিজস্ব সিস্টেম তৈরি করে। প্রথমে এই সিস্টেম কে ইন্দিরা বলা হত পরে নাম পরিবর্তন করে ডারিন রাখা হয় যার অর্থ ডিসপ্লে, অ্যাটাক, রেঞ্জিং, নেভিগেশন।
১৯৮৫ এ ভারত প্রথম জাগুয়ারের ডারিন-১ আপগ্রেড করে, এই নতুন আপগ্রেডেড জাগুয়ার ব্রিটিশ বিমানবাহিনীর জাগুয়ারের থেকে ১০ গুন শক্তিশালী ছিল। এরপর জাগুয়ারের ডারিন-২ আপগ্রেড করা হয় যাতে জাগুয়ারের জীবনকাল আরও ২০ বছর বেড়ে যায়। এই আপগ্রেডেশনে জাগুয়ারের অ্যাভিয়নিক সুইট কে আপগ্রেড করা হয়েছিল, ডিআরডিও এর তৈরি দুটি নতুন মিশন কম্পিউটার ইনস্টল করা হয়েছিল, ইসরায়েলের এলবিট সিস্টেমের তৈরি নতুন ডিসপ্লে ও জিপিএস সিস্টেম ইনস্টল করা হয়েছিল। এছাড়া মেরিটাইম জাগুয়ার এর রেডার পরিবর্তন করে ইসরায়েলের ELTA-2032 রেডার ইনস্টল করা হয়। এর রেঞ্জ কত তা একদম গোপনীয়। বিশেষজ্ঞদের ধারনা অনুযায়ী এয়ার টু সী মোডে ২০০ কিমি এবং এয়ার টু এয়ার মোডে ১০০ কিমি প্রায়। জাগুয়ারের নতুন আপগ্রেডে হচ্ছে ডারিন -৩ আপগ্রেড। এই আপগ্রেডেশনে জাগুয়ারের অ্যাভনিক্স, সেন্সর আপগ্রেড করা হয়েছে নতুন ককপিট লাগানো হয়েছে, স্মার্ট ডুয়েল মাল্টি ফ্যাংশনাল ডিসপ্লে ইনস্টল করা হয়েছে। সলিড স্টেট ভিডিও রেকর্ডার ও ফ্লাইট ডাটা রেকর্ডার ইনস্টল করা হয়েছে। অটো পাইলট সিস্টেম, ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার সুট ইন্ট্রিগেট করা হয়েছে। আপগ্রেডেড ইসরায়েলি ELTA-2052 AESA রেডার ইনস্টল করা হয়েছে।
পৃথিবীর বাকী সব দেশই মোটামুটি জাগুয়ার কে অবসরে পাঠিয়ে দিয়েছে শুধু ভারতই এখনও ব্যবহার করছে। এখনকার দিনে অ্যাডভান্সড মাল্টিরোল বিমানের যুগে সেই ডেডিকেটেড গ্রাউন্ড অ্যাটাক স্পেশালিষ্ট জাগুয়ার কতটা উপযোগী?
* জাগুয়ারের ল্যান্ডিং গিয়ার এমনভাবে তৈরি যাতে যাতে প্রয়োজনে টাফ রানওয়ে তে ল্যান্ডিং ও টেকঅফ করতে পারে। লাদাখের মতো জায়গায় এটা খুবই উপযোগী।
* জাগুয়ারের যদি ডানা বা উইং দেখেন তাহলে দেখবেন হাই উইং কনফিগারেশন যুক্ত, যার জন্য জাগুয়ার অত্যন্ত স্টেবেল, যার জন্য আধুনিক মাল্টিরোল বিমানের তুলনায় জাগুয়ার আনগাইডেড বোম্ব কে সঠিকভাবে টার্গেট হিট করতে পারে।
তেজস মার্ক -১এ যুদ্ধবিমানেও এই একই রেডার লাগানো হবে কিন্তু আলাদা ভার্সন এর। এয়ার টু এয়ার এর শনাক্তকরণ রেঞ্জ ১৫০+ কিমি, এয়ার টু গ্রাউন্ড ও এয়ার টু সী রেঞ্জ ২৫০+ কিমি। ভারতীয় বিমানবাহিনীর কাছে ১২০ টি জাগুয়ার বিমান রয়েছে, যার মধ্যে ৬০ টি জাগুয়ার কে ডারিন-৩ আপগ্রেড করা হচ্ছে এবং বাকী ৬০ টি জাগুয়ার ডারিন-২ ভার্সনের থাকবে। জাগুয়ারে নতুন ওয়েপনস হিসাবে HSLD 450 ও HSLD 250 বোম্ব এবং CBU 105 সেন্টার ফিউজড বোম্ব ও গ্রিফিন -৩ লেজার গাইডেড বোম্ব রয়েছে। আমেরিকার বিখ্যাত হারপুন অ্যান্টিশিপ মিসাইল ইনস্টল করা হয়েছে ভারতীয় জাগুয়ার ডারিন-৩ তে। পুরোনো ম্যাজিক -২ মিসাইলের বদলে এতে আসরাম মিসাইল ইনস্টল করা হয়েছে।
* জাগুয়ার মাটির অনেক নীচু দিয়ে উড়তে পারে আধুনিক বিমান গুলোর তুলনায়।
*তাহলে এখন প্রশ্ন হচ্ছে ব্রাহ্মস, স্ক্যাল্প এর মত মিসাইল আছে যা মোটামুটি ৪০০-৫০০ কিমি দূর থেকে টার্গেট কে হিট করতে সক্ষম তাহলে জাগুয়ার এর কী দরকার? দেখুন এসব ক্রুজ মিসাইলের দাম প্রচুর যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি তে ছোট টার্গেট কে হিট করতে এত দামী মিসাইল ব্যবহার করার দরকার নেই, এক্ষেত্রে জাগুয়ার উপযোগী।
* জাগুয়ার সীস্কমিং করতে সক্ষম। বুঝিয়ে বলি কোন মিসাইল যখন সী স্কিমিং কতে পারে তখন শত্রুর রেডার ততক্ষণ পর্যন্ত মিসাইল কে শনাক্ত করতে পারে না যতক্ষণ পর্যন্ত মিসাইল শত্রুর একেবারে কাছে গিয়ে পৌঁছায়। জাগুয়ার সী স্কিমিং করতে করতে শত্রুর যুদ্ধজাহাজের একবারে কাছে গিয়ে তার হারপুন মিসাইল লঞ্চ করে শত্রু জাহাজকে ধ্বংস করতে সক্ষম।
এইজন্য জাগুয়ারের মত বিমানকে এখনও অনেক দেশ ব্যবহার করে আমেরিকার যেমন A-10 থান্ডারবোল্ট, রাশিয়ার SU-25 ও চীনের JH-7 এগুলো সব জাগুয়ারের মতনই।
*** সবার শেষে একটা কথা না বললেই নয়, তাহল জাগুয়ার পরমাণু অস্ত্র বহন করতে পারে, হ্যাঁ ঠিকই শুনেছেন জাগুয়ার পরমানু বোম্ব বহন করতে সক্ষম, যার জন্য জাগুয়ারের গুরুত্ব ভারতীয় বিমানবাহিনীর কাছে অনেক। ফ্রান্স তাদের বিমানবাহিনীর ৩৩ টি জাগুয়ার ভারতকে দিচ্ছে বন্ধু হিসাবে বিনামূল্যে যাতে এইসব জাগুয়ারের পার্টস ভারত নিজেদের জাগুয়ারে ব্যাবহার করতে পারে।