ডিফেন্স

লকডাউন কে কাজে লাগিয়ে ভারতের লাদাখের গুরুত্বপূর্ণ সীমান্ত এলাকায় ব্যাপক মাত্রায় অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছে চিনা সেনা

নিউজ ডেস্কঃ চীন ও ভারতের মাঝের রাজনৈতিক অস্থিরতা ভাবাচ্ছে অনেককেই। যেখানে বেইজিংয়ের লাদাখ আগ্রাসনের নীতি নয়াদিল্লিকে ক্রমশ চীনের অপর শত্রু ওয়াশিংটনের কাছে ঠেলছে সেখানে সব জেনে শুনে চিন ঠিক কেনো এই মুহূর্তে ভারতের সাথে চিরশত্রুতার পথে পা বাড়াচ্ছে তা অনেকেরই জিজ্ঞেস্য। সম্প্রতি এই প্রশ্নই যথাযথ বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছেন ভূ -কৌশলবিদ এবং “এশিয়ান জগারনাট: দ্য রাইজ অব চায়না, ইন্ডিয়া এবং জাপান” সহ নয়টি বইয়ের লেখক ব্রাহ্ম চেলানি ।

ভারত যেখানে সাম্প্রতিককালে বিধ্বংসী করোনা ভাইরাসের সঙ্গে যুঝতে ব্যস্ত ছিলো সেখানে বিশ্বব্যাপী লকডাউন কে কাজে লাগিয়ে ভারতের লাদাখের গুরুত্বপূর্ণ সীমান্ত এলাকায় ব্যাপক মাত্রায় অনুপ্রবেশ ঘটিয়েছে চিনা সেনা। 

শীতের শেষে বরফ গলাতেই ভারতীয় সেনার চোখে পড়ে ভারতের উচ্চতম এই অঞ্চলে শত শত বর্গ কিলোমিটার অঞ্চল দখল করে সশস্ত্র ঘাঁটি গেড়েছে পিপলস লিবারেশন আর্মি। স্বাভাবিকভাবেই এই ঘটনা পুনরায় উস্কে দিয়েছে ১৯৭৫ সালের ভয়ানক স্মৃতি।

দীর্ঘদিন হয়ে গেলেও এখনো অনুপ্রবেশকারী পিএলএ বাহিনীকে ভারতের মাটি থেকে সরিয়ে সশস্ত্র সংঘর্ষ রোধ করা বা বাফার জোন তৈরি করার কোনোরকম লক্ষণই দেখাচ্ছে না বেইজিং। ঘটনা হলো, সেই ১৯৫০ সালের গোড়ার দিকে চীন যখন স্বশাসিত তিব্বতকে দখল করে ভারতের ঘাড়ে নিশ্বাস ফেলতে আরম্ভ করে তখনও কিন্তু এত দীর্ঘ সময় ধরে ভারতীয় সেনাকে মুখোমুখি হতে হয়নি হাজার হাজার চিনা সেনার। এমনকি কমিউনিস্ট শাসিত চিন যখন ১৯৬২ সালে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলো তখনও যুদ্ধ স্থায়ী হয়েছিল মাত্র ৩২ দিন।

কোভিডের সাথে লড়াইয়ে ভারত এখনও সম্পূর্ণ ভাবে জয়ী হয়ে উঠতে পারেনি আর এর মাঝেই হঠাৎ চীনের এমন অগ্রাসন ভারতের কাছে যথেষ্ট ভীতির কারণ হয়ে উঠছে। অর ঠিক সেই কারণেই সময় থাকতে থাকতে ভারতীয় সেনাপ্রধান লাদাখ সীমান্তে প্রহরারত ভারতীয় সেনাবাহিনীকে ভবিষ্যতে যেকোনো পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে নির্দেশ দিয়েছেন। 

প্রধানমন্ত্রীর নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় আসার পর যেখানে নতুন করে এক বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন চীনের দিকে সেখানে চীনের অতর্কিত আগ্রাসন ভারতের বিদেশনীতিকে এক প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। বিগত পাঁচ বছরে নরেন্দ্র মোদী কম করে হলেও চোদ্দবার চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিনপিংয়ের সাক্ষাৎ করেছেন অথচ সেই সময় হিমালয় সীমান্তে চীনের যুদ্ধ মহড়া, নিত্য নতুন সামরিক ঘাঁটি নির্মাণের মতো ব্যাপারগুলোকে একেবারেই পাত্তা দেননি তিনি। অথচ অবাক করার মতো বিষয় হলো যে নরেন্দ্র মোদী পূর্বে কাশ্মীর ও পাকিস্তান ইস্যুতে কংগ্রেসকে বারংবার দোষারোপ করেছে সেই মোদীই এবার চীনের ভূমি দখল প্রসঙ্গে একেবারে চুপ। সম্মুক্ষে চীনের নাম উল্লেখ করা তো দূরের কথা এমনকি বিস্তীর্ণ এলাকায় চীনের অনুপ্রবেশের কথাও স্বীকার করেননি তিনি। দেশের নিরাপত্তায় এতো বড়ো ক্ষতির পরেও এখনো পর্যন্ত না তো কোন সেনা কমান্ডারকে জবাবদিহি করতে হয়েছে আর না তো প্রতিরক্ষা মন্ত্রী এই ঘটনার দায় স্বীকার করে সামান্য কোনো ভুল স্বীকার করেছেন। ভারত সরকার মুখ বাঁচানোর জন্য গোটা ঘটনা চেপে গিয়ে গোপনে সীমান্ত এলাকায় শান্তি পুনরুদ্ধারের চেষ্টা চালাচ্ছে ঠিকই কিন্তু এতে উল্টে লাভ হচ্ছে চীনেরই। ভারতীয় মিডিয়া এই ইস্যুতে খবর পরিবেশনের সময় বারবার উল্লেখ করছে যে সীমান্তে চীন ও ভারতীয় সেনার মধ্যে দেখা দিয়েছে এক সংঘর্ষ। কিন্তু সত্যি বলতে সংঘর্ষ নয় বরং একে ভারতের মাটিতে চীনের একচ্ছত্র আধিপত্য স্থাপন বলা চলে।

ভারতের এই চুপ থাকা আরো উৎসাহিত করছে চীনকে।  তারা ১০ মাইল এগিয়ে ৫ মাইল পিছোনোর এক সুন্দর কৌশল অবলম্বন করছে। পরিস্থিতি এমনই যে সম্প্রতি ভারতের উদ্দেশ্যে বেজিং বলেছে শান্তি বজায় রাখতে চাইলে দুই দেশকেই কিছুটা ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। যার অর্থ কিন্তু পরোক্ষভাবে চীনের জয় স্বীকার করে নেওয়া। 

পরিস্থিতি এমনদিকে এগোচ্ছে তাতে চিন যে শুধুমাত্র ভারতীয় মরুভূমি দখল করে ক্ষান্ত হবে তাই নয়, বরং জোর করে তারা এই চিনা দখলকে বৈধতা দিতে বাধ্য করবে। 

তবে এই একটি বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কৃতিত্ব স্বীকার করতেই হবে। ভয় পেয়ে পেছনে সরে না গিয়ে তিনি ইতিমধ্যেই হিমালয় সীমান্তে চীনের সামরিক সৈন্যের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অসংখ্য ভারতীয় সেনা মোতায়েন করেছেন। সেই সঙ্গে ভারতের তরফে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে যে যতক্ষণ না দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরছে ততদিন দুই দেশের মধ্যে ব্যবসায়িক সম্পর্কও হবে না স্বাভাবিক।

ভারত সম্প্রতি পঞ্চম প্রজন্মের অর্থাৎ 5G  ওয়্যারলেস নেটওয়ার্ক ট্রায়াল থেকে চীনা নির্মাতাদের বাদ দিয়েছে এবং প্রতিবাদের  ভাষা হিসাবে কোভিডের বাড়বাড়ন্তের মাঝেই চীনের উহানে ১৫ টন চিকিৎসা সামগ্রী  সরবরাহের পরিবর্তে ভারত চিন থেকে সরাসরি কোনো সরকারি সহায়তা নিতে অস্বীকার করেছে।

তবে, এই ঘটনার দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ঠিক কী হতে পারে সেই দিকেও নজর রাখতে হবে আমাদের। এর মধ্যেই সীমান্তে এক বড়োসড়ো সামরিক কাঠামো নির্মাণ শুরু করে দিয়েছে বেজিং। যা থেকে ধরে নেওয়া যেতে পারে হয় ভবিষ্যতের যুদ্ধ প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছে চিন আর না হলে এই বিল্ড আপটিকে অবলম্বন করেই পরবর্তীকালে ভারতের ওপর চাপ সৃষ্টি করবে তারা। 

বাস্তব হলো, ভারত ও চীন সীমান্তের যে তিব্বতীয় মালভূমিতে কিছু দিন আগে অব্দিও সেরকম টহলদারির প্রয়োজন পর্যন্ত পরতো না সেখানেই চীন তাদের সামরিক বিমান, ক্ষেপণাস্ত্র, আর্টিলারি প্রভৃতি মোতায়নের মাধ্যমে এমন এক ত্রাসের সৃষ্টি করেছে যে ক্রমশ এক উত্তপ্ত রণাঙ্গনে পরিণত হচ্ছে এ সীমান্ত। 

ভারতের কাছে সীমান্তে অস্থিরতা বৃদ্ধি মনেই হলো সীমান্ত প্রতিরক্ষার জন্য আরও বেশি করে অর্থ বিনিয়োগ করা এবং সেই সঙ্গে অতিরিক্ত যুদ্ধ বাহিনী নিয়োগ করা। এতো কিছুর মাঝে চীনের সাথে বৃহত্তর কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ভারতের মনোনিবেশ করা এক প্রকার অসম্ভব ফলত, চিন ও পাকিস্তান জোট ও হয়ে উঠবে আরো শক্তিশালী।

চিন যথেষ্ট বুঝেশুনেই পা ফেলেছে। তারা জানে হিমালয় সীমান্ত বরাবর ভারতকে যদি কোনোভাবে ঘিরে ফেলা যায় তবে ভারত মহাসাগরে আধিপত্য বিস্তার করতে সুবিধা আখেরে তাদের। আর ভারতের বিরুদ্ধে সামরিক ফ্রন্ট তৈরি করার অর্থই তো হলো ভারতকে কৌশলগতভাবে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলা।

তবে আরেকটা সম্ভাবনা কিন্তু থেকেই যায়। এতো পরিকল্পনার পরেও সেই ১৯৬২ যুদ্ধের মতই চীনের যাবতীয় পরিকল্পনা তাদের ওপরেই বুমেরাং হয়ে যেতে পারে। সেই যুদ্ধে ভারতের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল ঠিকই কিন্তু চীন সম্পর্কে ভারতের অন্ধ মোহকেও ভ্রষ্ট করেছিল এটি। ১৯৬২ সালের ইন্দো-চিন যুদ্ধ এবং ১৯৬৫ সালে ইন্দো-পাক যুদ্ধের পরেও কিন্তু ১৯৬৭ সালে ভারত তিব্বত সিকিম বর্ডারে সামরিক সংঘর্ষে চীনকে কুপোকাত করেছিল। 

ভূখণ্ডের প্রসারতা বৃদ্ধির দিক থেকে বললে চীনের লাদাখ অগ্রাসন হয়তো সফল হলেও হতে পারে কিন্তু রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলে চীন কিন্তু আদপে এর ফলে এক বড়োসড়ো ক্ষতির মুখেই পড়বে। চীনের ব্যবহার ক্রমশ ভারতকে যেমন ওয়াশিংটনের কাছাকাছি নিয়ে যাচ্ছে তেমনি আবার ভবিষ্যতের অপ্রতিরোধ্য সংঘাতের কথা মাথায় রেখে ভারত নিজের সামরিক ক্ষমতারও ক্রমশ বৃদ্ধি ঘটাচ্ছে।

এক্ষেত্রে উল্লেখ্য 196২ সালে চীনের তৎকালীন প্রিমিয়ার ঝাউ এনলাইয় বলেছিলেন চিন “ভারতকে শিক্ষা দিতে” যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। কিন্তু, এখন কেউ অস্বীকার করতে পারবে না যে সেই সময় চিন যুদ্ধে জিতেছিল ঠিকই কিন্তু বিনিময়ে হারিয়েছিলো নিজেদের শান্তি। সেই সময় আর এই সময়ে মধ্যে পার্থক্য কেবল একটাই। এবার আগ্রাসনের মাধ্যমে চীন তাদের সবচেয়ে বড় প্রতিবেশীর সাথে চিরকালের মতো এক পাকাপোক্ত শত্রুতা তৈরি করে ফেলছে, যেখান থেকে আর পিছু হটা অসম্ভব।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *