ইসরায়েলের হামলায় আহত ৩০০ মানুষ। ফিলিস্তিনি বিরুদ্ধে আক্রমন করতে বড় ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে চলেছে ইসরায়েল
নিজস্ব সংবাদদাতা:প্যালেস্টাইনের সাথে ইসরায়েলের ঝামেলা আজকের নয়। বহু বছর ধরেই প্রতিবেশী দুই দেশের মধ্যে চলেছে নানা রাজনৈতিক চাপানউত্রান। কিন্তু সাম্প্রতিককালে এই বিবাদ বড় যুদ্ধের আকার ধারণ করেছে। পরিস্থিতি এমনই দাঁড়িয়েছে যে বিশ্বের বিভিন্ন সচেতন মানুষের মনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে যে ইসরায়েল কি আদপে প্যালেস্তাইনকে ধ্বংস করে দিতে চায়? ইজরায়েল সামরিক শক্তিতে প্যালেস্টাইনের থেকে অনেক এগিয়ে অথচ একের পর এক যেভাবে ইসরায়েল হামলা চালাচ্ছে প্যালেস্টাইনের ওপর তাতে মারা যাচ্ছে অসংখ্য সাধারণ মানুষ। সম্প্রতিককালেই চলেছে এরকম এক হামলা। যাতে মারা গিয়েছিল প্রায় ৫৬ জন। মধ্যে ১৪ জন শিশু এবং ৫ জন নারী। ভাবা যায়? আনাদুলো জানায় ইসরায়েলের হামলায় আহত হয়েছিলেন প্রায় তিনশত লোক কিন্তু তারপরেও ইসরাইল তাদের হামলা অব্যাহত রেখেছিল।
প্যালেস্টাইন এবং ইসরাইলের ইতিহাস বড়ই জটিল। একতরফাভাবে এই দুই দেশের মধ্যে কাউকে সরাসরি যুদ্ধের জন্য দায়ী না করা গেলেও ইসরায়েল প্যালেস্তাইনের চেয়ে অনেক বেশি ক্ষমতাশালী হওয়ায় কিছুটা বেশি দায়িত্ব তো অবশ্যই বর্তায় তাদের ওপর। প্যালেস্টাইনের অধিকার ছিনিয়ে নিতে ইসরায়েল প্রায়ই বিভিন্ন রকম ঝামেলা করে। প্রযুক্তিগত দিক থেকে প্যালেস্টাইন ইসরাইলের তুলনায় অনেক পিছিয়ে থাকলেও ফিলিস্তিনিরা ইসরাইলের আক্রমণের বিরুদ্ধে বারংবার প্রতিরোধ গড়ে তুলতেও স্বাভাবিকভাবেই তা সামাল দেওয়া হয়ে ওঠে বেশ কঠিন। যাবতীয় প্রতিরোধ ব্যর্থ করে বার বার অসংখ্য সাধারণ ফিলিস্তানি প্রাণ হারিয়েছেন। তাছাড়া খুব বেশিদিন হয়নি আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট পরিকল্পিতভাবে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশগুলির সাথে ইসরায়েলের চুক্তি করায়। কিন্তু সেসব ছেড়ে চিন্তার বিষয় এখন একটাই – আরব- ইসরাইল যুদ্ধে বাকি মুসলিম দেশগুলো যেভাবে এগিয়ে এসেছিল নিরীহ প্রাণ রক্ষার জন্য এবারেও কি দেশগুলোকে ওই একই ভাবে আসবে এগিয়ে?
গত ঝামেলার সূত্রপাত হয় ইজরায়েল অধিকৃত গাজা জেরুজালেমের একাংশে হামাস হামলা চালালে। তার আগেই গাজা থেকে চালানো রকেট হামলায় মারা যান তিনজন ইসরায়েলি। পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠলে পাল্টা জবাব দেয় ইসরাইল। ইসরাইলি সেনার দাবি ছিল সাধারণ মানুষ নয় বরং তাদের আক্রমণের লক্ষ্য ছিল হামাস ই। অপরদিকে এই ঝামেলার মধ্যেই প্যালেস্টাইনের রকেট হামলায় ধ্বংস হয়েছে ইসরাইলের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন জ্বালানি কোম্পানির একটি পাইপ লাইন। ডেইলি সাবাহ্র সূত্রে জানা গেছে, ইসরাইলের আয়রন ডোম ক্ষেপণাস্ত্র ও রকেট প্রতিরোধী ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও ওই রকেট হামলা প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়নি। ইসরাইলের সরকারি কর্মকর্তা এবং সেই দেশের জ্বালানি বিভাগের কর্মকর্তাদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে এ খবর প্রকাশ করেছে রয়টার্স।
চ্যানেল ১২ টিভি এই গোটা ঘটনার ভিডিওটি ভালোভাবে তাদের খবরে তুলে ধরেছিলো। তাদের সম্প্রচারে স্পষ্ট দেখা গেছে ইসরাইলের ভূমধ্যসাগরীয় শহর আশকেলনের একটি বড় জ্বালানি কেন্দ্রে দাউ দাউ করে জ্বলছে অগ্নিশিখা। অবশ্য চ্যানেল ১৩ এর তরফ থেকে জানানো হয়েছে শহরের দক্ষিনে অবস্থিত আশকেলনের জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কার্যক্রম কোন রকম ভাবে ব্যাহত হয় নি। প্যালেস্টাইনের এই আক্রমণের জবাবে অবরুদ্ধ গাজায় হামলা চালায় ইসরায়েলি বিমান। শিশু ও মহিলাসহ বেসামরিক প্রায় ২৮ জন ব্যক্তি প্রাণ হারান। অবস্থা এমনই বেসামাল হয়ে পড়ে যে জেরুসালেমের আল-আকসা মসজিদের চত্বরেও ফিলিস্তিনি ও ইসরাইলিদের মধ্যে দ্বন্দ্ব এক ব্যাপক সংঘাতের আকার ধারণ করে।
প্যালেস্টাইনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে গাজা উপত্যকায় আহত হয়েছেন মোট ১৫২ জন এবং নিহতদের মধ্যে রয়েছেন একজন শিশু ও নারী। অপরদিকে ইসরায়েলের জরুরী বিভাগের কর্মকর্তা মাজেন ডেভিড অ্যাডমের কাছ থেকে জানা গেছে ইসরাইলি হামলার জবাবে প্যালেস্টাইনের হামাস নিয়ন্ত্রিত অবরুদ্ধ গাজা থেকে পুনরায় আসকেলান শহরে রকেট হামলা চালানো হলে তাতে নিহত হন দুজন ইসরাইলি নারী।
এখনো পর্যন্ত পাওয়া খবর অনুযায়ী সমস্ত ঘটনার সূত্রপাত হয়েছিল মসজিদুল আল আকসা থেকে। এই মসজিদে প্যালেস্টাইনের মুসলিমরা যখন জুমাতুল বিদা নামাজ আদায় করছিলেন ঠিক সেই মুহূর্তে অস্ত্র সজ্জিত ইজরায়েলি ইহুদী সেনা নামাজরত মুসলমানদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লে হামলায় শহীদ হন আনুমানিক ২০ জন এবং আহত হন প্রায় দুই শতাধিক ব্যক্তি। ইতিমধ্যে এই হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন বাংলাদেশে, তুরস্ক,পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশ।ইউরোপের মুসলিম দেশ তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগান প্যালেস্টাইনকে আশ্বস্ত করে জানিয়েছেন যে তুরস্ক সবসময় তাদের পাশে থাকবে এবং অত্যাধুনিক অস্ত্র ও গোলাবারুদ দিয়ে যত সম্ভব সাহায্য করবে। এখন বাকি দেশগুলি এ ঘটনায় ঠিক কী প্রতিক্রিয়া দেয় সেটাই দেখার বিষয়।
আরব ভূমি প্যালেস্টাইনে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিক থেকেই মধ্যপ্রাচ্য থেকে ইহুদিদের ব্যাপক আনাগোনা শুরু হয়। ১৯০৫ থেকে ১৯১৪ সাল পর্যন্ত এই কয়েক বছরেই প্যালেস্টাইনে ইহুদিদের সংখ্যা কয়েক হাজারে পৌঁছে যায়। তবে ১৯১৪ সালে বিশ্ব যুদ্ধ শুরু হলে এই সংখ্যাটা বেড়ে যায় আরো অনেকটাই। ব্রিটিশদের সহযোগিতায় ১৯১৮ সালে প্যালেস্টাইনি ইহুদিদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে হয় কুড়ি হাজার। এর আগের বছরই অর্থাৎ ১৯১৭ সালের ২ নভেম্বর তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী আর্থার জেমস বালাফর হঠাৎ প্যালেস্টাইনের ভূখণ্ডে একটি নতুন ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা ঘোষণা করলে সমগ্র ইউরোপ থেকে দলে দলে হাজার হাজার ইহুদি জনগোষ্ঠী প্যালেস্টাইনে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে। যে প্যালেস্টাইনে ১৯১৯ সাল পর্যন্ত ইহুদির সংখ্যা ছিল মাত্র মাত্র ২৫ হাজার সেখানেই ১৯৩১ সালের মধ্যে এক লাফে সংখ্যাটা বেড়ে হয় ১ লাখ ৮০ হাজার এবং ১৯৪৮ সালের মধ্যে সংখ্যাটা আরো বেড়ে দাঁড়ায় ছয় থেকে আট লাখ। তবে ব্যাপারটা হল বিংশ শতাব্দীর শুরুতে প্রথম ইহুদিদের আগমন শুরু হলে ব্যাপারটিকে মধ্যপ্রাচ্যের আরবরা একেবারেই বিপদজনক ইস্যু হিসেবে হিসাবে বিবেচনা করেনি। বরং প্যালেস্টাইনের স্থানীয় আরবরা হাজার হাজার একর জমি ধনী ইহুদীদের কাছে সহজেই চড়া দামে বিক্রি করে দিতো। আসলে ব্রিটেন যে এরকম পদক্ষেপ নিতে চলেছে তা সেখানকার স্থানীয়রা কখনোই আশা করেনি।
ফলত অল্প সময়ের মধ্যেই প্যালেস্টাইনের নতুন নতুন নানা জায়গায় ঘন ইহুদি বসতি গড়ে ওঠে এবং প্রতিনিয়ত একটু একটু করে আরবদের বদলে প্যালেস্টাইনের একটা বড় অংশের নিয়ন্ত্রন চিরদিনের মতো চলে যায় তাদের হাতেই। অবস্থা আরও জটিল হয়ে ওঠে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে হিটলারের নির্দেশে জার্মান ছাড়াও আশপাশের বেশ কিছু দেশে ছড়িয়ে পড়ে ইহুদি বিদ্বেষ। সেই সময় সারা ইউরোপ জুড়ে ৫০ লাখের কাছাকাছি ইহুদি গণহত্যা শিকার হওয়ায় পুনরায় লক্ষ লক্ষ ইহুদি কোনক্রমে আশ্রয় নিতে প্যালেস্টাইনে চলে আসে। পরবর্তীকালে তারা সেখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। এই সময়ে প্যালেস্টাইনে ইহুদিদের জনসংখ্যা ছাড়িয়ে যায় ১০ লাখ। ১৯৪৮ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যের মদতে ইহুদি জনবসতি বিশিষ্ট প্যালেস্টাইনের একটা বড় অংশ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে স্বাধীন ইসরাইল রাষ্ট্রের ঘোষণা করা হলে সেখান থেকেই শুরু হয় দীর্ঘস্থায়ী আরব-ইসরায়েলের ভয়ঙ্কর যুদ্ধ।
১৯৪৮ সালে মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইল নামক নতুন এই ইহুদি রাষ্ট্রের জন্ম হলে আরব দেশগুলির সাথে পরপর চারবার ভয়ানক যুদ্ধে জড়িয়েছে ইসরায়েল। এই যুদ্ধগুলিই পরিচিত আরব-ইসরাইল যুদ্ধ নামে। তবে, মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকার মিলিয়ে মোট ২১ টি আরবদেশ থাকলেও ১৯৪৮-৪৯ সালের প্রথম আরব-ইসরাইল যুদ্ধে গ্রহণ করেছিল মাত্র সাতটি দেশ। তাতেও যুদ্ধক্ষেত্রে যেখানে ইহুদিদের তুলনায় আরবদের সংখ্যা বেশি হওয়ার কথা ছিল সেখানে হয়েছিল ঠিক উল্টো। যুদ্ধক্ষেত্রে ইসরায়েলি সৈন্যসংখ্যা ছিল আরবদের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। মোট ১ লক্ষ ২০ হাজার উন্নত সামরিক সার্চ সরঞ্জামের সজ্জিত ইহুদি সেনার কাছে আরবরা একেবারেই টিকতে পারেনি। মিশর, ইরাক, সিরিয়া, জর্ডান, সৌদি আরব, ইয়েমেন এবং লেবানন আরবদেশ সম্মিলিতভাবে পাঠিয়েছিল মাত্র ৬৩ হাজার সৈন্য। যারা কিনা আবার সামরিক ক্ষমতা সম্পন্ন ইসরাইলি সেনা মোকাবিলার জন্য একেবারেই ছিল না যথেষ্ট।
প্রথম আরব-ইসরাইল যুদ্ধে মিশর ইরাক এবং সিরিয়া সেনা পাঠিয়ে ছিল যথাক্রমে ২০ হাজার,১৮ হাজার এবং ১৮ হাজার। অথচ সৌদি আরব ও ইয়েমেন থেকে সেনা পাঠানো হয়েছিল মাত্র ১,২০০ এবং ৩০০। আসলে সৌদি আরব ও ইয়েমেনের এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ ছিল একেবারেই প্রতিকি। তার ওপর এই গুটিকয়েক আরব দেশ ছাড়া বাকি আর কোনো রাষ্ট্রে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনি। বুঝতেই পারছেন এই যুদ্ধে ইহুদিদের হারানো ছিল কতটা অসম্ভব।
যুদ্ধের শুরু থেকেই আরব দেশগুলো যে যার মতো করে নিজের এজেণ্ডা বাস্তবায়নে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সেই সঙ্গে নিজেদের মধ্যে চরম মাত্রায় সমন্বয়হীনতর কারণে খুব দ্রুতই যুদ্ধের ময়দানে তারা পরাজয় স্বীকার করতে বাধ্য হয়। এই যুদ্ধে হাজার হাজার সাধারণ মানুষের মৃত্যুর পাশাপাশি ধ্বংস হয় শত শত ফিলিস্তিন গ্রাম ও নগর এবং ইসরায়েল নতুন করে পুনরায় ফিলিস্তিনের প্রায় ৭০% এলাকা দখল করে নেয়। অবশ্য জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে আরব-ইসরাইল যুদ্ধ শুরুর আগেই ১৯৪৮ সালে পালেস্তাইনের ভূখণ্ডকে দ্বিখণ্ডিত করার যাবতীয় বিল ১৮১ নম্বর প্রস্তাবের দ্বারা পাশ করে দেওয়া হয়েছিল। এই বিলের আওতায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে প্যালেস্টাইনের ৪৫ শতাংশ ভূমি ফিলিস্তিন আরবদের জন্য এবং বাকি ৫৫ শতাংশ অর্থাৎ অর্ধেকের ও বেশি অঞ্চল ইহুদিদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হবে। আর এই একই প্রস্তাবে পবিত্র ভূমি হিসাবে মনে করা জেরুজালেমকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নিয়ন্ত্রণে থাকা স্বতন্ত্র শহর হিসেবে ঘোষণা করার সিদ্ধান্ত নেয় জাতিসংঘের সাধারণ ও নিরাপত্তা পরিষদ।