ভারতের বহু প্রতীক্ষিত স্যাটেলাইট জিস্যাট-১ অবশেষে ইতিহাস তৈরির জন্য প্রস্তুত! এই স্যাটালাইট ভারতের জন্য এতো গুরুত্বপূর্ণ কেনো?
নিজস্ব সংবদদাতা:অবশেষে ঘটছে বহুদিনের অপেক্ষার অবসান। ভারতের প্রথম আর্থ ইমেজিং স্যাটেলাইট ১২ই আগস্ট স্থাপিত হচ্ছে জিও স্টেশেনারি অর্বিটে। ইসরোর জন্য এ এক বিশাল পদক্ষেপ। ভারতের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় জিস্যাট-১ স্যাটেলাইট আদপে গত বছরের ৫ই মার্চ লঞ্চ করার কথা থাকলেও অজানা কারণে দিন পিছিয়ে যায় অনেকটাই। ঠিক কি কারণে হঠাৎ কাউন্টডাউন বন্ধ করে লঞ্চ এর দিন পিছিয়ে দেওয়া হয়েছিলো তা নিয়ে উঠেছিল বেশ কিছু প্রশ্ন। সেই সময় চাপে পড়ে ইসরোর দাবি ছিল, স্যাটেলাইট এ ভীষণ পরিমাণ ভোল্টেজ ফ্লাকচুয়েশন করায় সেই সমস্যার সমাধানের জন্য পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে লঞ্চ শেডিউল।তবে, গুজব কমে নি এই খবরে। গোপন সূত্রে খবর হঠাৎ শিডিউল পেছোনোর জন্য দায়ী হতে পারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। শোনা যাচ্ছে প্রথমে এই স্যাটেলাইট তৈরিতে ব্যাবহৃত হয়েছিলো বেশ কিছু মার্কিন সেন্সর। যা আমেরিকা ভারতের স্যাটেলাইটে ব্যাবহার করতে দিতে নারাজ ছিলো। ফলত, ইসরো নতুন করে ভারতে তৈরি সেন্সর ব্যাবহার করে স্যাটেলাইট টি বানিয়েছে। দাবি সেই জন্যই এতটা দেরি!
তবে, সে আমেরিকার চাপ ই হোক বা হঠাৎ অতমারির দাপট, সব কাটিয়ে উঠে ভারতের বহু প্রতীক্ষিত স্যাটেলাইট জিস্যাট-১ অবশেষে ইতিহাস তৈরির জন্য প্রস্তুত! খাতায় কলমে এটির ওজন ২২৬৮কেজি বলা হলেও এই সিভিল আর্থ ইমেজিং স্যাটালাইট তার চেয়ে বেশ অনেকটাই বড় বলে আন্দাজ করা হচ্ছে। তবে, এই স্যাটালাইট ভারতের জন্য এতো গুরুত্বপূর্ণ কেনো? বা এই স্যাটালাইট নিয়ে এত গুজব কেনো ছড়াচ্ছে তা বোঝার জন্য আসুন আগে জেনে নেওয়া যাক একটি স্যাটালাইটকে সানসিনক্রোনাস অর্বিট ও জিওস্টেশেনারি অর্বিটে স্থাপন করার পার্থক্য।
সানসিনক্রোনাস অর্বিট মূলত লোয়ার আর্থ অর্বিটে অবস্থিত। সাধারণত আমাদের সমস্ত আর্থ ইমেজিং স্যাটেলাইট (উদা: কার্টোস্যাট) এবং রেডার ইমেজিং স্যাটেলাইট (উদা: রিস্যাট ডেপ্লয়) রয়েছে এই অর্বিটেই। এই অর্বিট পৃথিবীর উত্তর থেকে দক্ষিণ বা দক্ষিণ থেকে উত্তরে প্রদক্ষিণ করে। ফলত, পৃথিবী যেহেতু আহ্নিক গতির কারণে পশ্চিম থেকে পূর্বে প্রদক্ষিণ করে তাই এই অর্বিটে প্রদক্ষিণ করা স্যাটালাইট পৃথিবীর নির্দিষ্ট একটি জায়গায় ফোকাস করতে পারে না। এর সুবিধা যেমন রয়েছে তেমনই রয়েছে অসুবিধাও। একদিকে সুবিধা হলো এটি বিভিন্ন সময় পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় পৌঁছে সেখানকার যাবতীয় খবর ব্রডকাস্ট করতে পারে। একদিকে এটা স্পাই এর কাজ তো করছেই তার ওপর লো অর্বিটে অবস্থান করায় এখন কার স্যাটেলাইট গুলি যে কোনো জায়গায় ছবির ও তুলতে পারে খুব পরিষ্কার ভাবে। যেমন কার্টোস্যাটের রেজোলিউশান হল ০.২৫ মিটার।
অপরদিকে, এর অসুবিধা হলো, নির্দিষ্ট জায়গায় স্থির না থাকার ফলে এখানে পরিক্রমণ করা স্যাটালাইট গুলি এক জায়গায় ফোকাস করে রাখতে পারে না। বর্ডার পাহারা দেওয়া বা দেশের ওপর ২৪ ঘণ্টা নজরদাড়ি এই অরবিট এ থেকে স্যাটালাইট এর দ্বারা অসম্ভব। একটা উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে অনেকটাই। ধরা যাক একটা স্যাটালাইট উত্তর থেকে দক্ষিণে যাচ্ছে। প্রথম অর্বিটে এটি ভারতের উত্তরে কাশ্মীর থেকে কণ্যাকুমারি হয়ে দক্ষিণ মেরু পরিক্রম করলো। তারপর সেখান থেকে যখন উত্তম মেরুতে গিয়ে স্যাটালাইট টি যখন আবার দক্ষিণের দিকে পাড়ি দেবে তখন পৃথিবী যেহেতু পশ্চিম থেকে পূর্বে ঘুরছে তাই স্যাটালাইট টি হয়তো ইরানের ওপর দিয়ে পড়িক্রম করবে। ঠিক একই ভাবে পরের বার আবার সৌদি আরবের ওপর দিয়ে। ফলে যেকোনো একটি দেশ বা পৃথিবীর নির্দিষ্ট একটি অংশে এর মাধ্যমে নজরদারি করা অসম্ভব। তাছাড়া,লোয়ার আর্থে বায়ু থাকে বেশ কিছুটা। ফলে বাতাসের সাথে ঘর্ষণে দ্রুত শেষ হয় স্যাটেলাইটের জীবনচক্র। এই অর্বিটে এক একটি স্যাটেলাইট স্থায়ী হয় গড়ে ৫ বছর।
জিওস্টেশেনারি অর্বিট অপরদিকে পৃথিবী থেকে প্রায় ৩৬,০০০কিমি দূরে অবস্থিত। এই অরবিট অবস্থিত স্যাটেলাইটগুলি পৃথিবীর আহ্নিক গতির সাথে তাল মিলিয়ে পৃথিবীর সাথেই পশ্চিম থেকে পূর্বে আবর্তিত হতে থাকে। ফলে চাইলে একটি নির্দিষ্ট জায়গার ওপর ফোকাস করা যায় এই অর্বিটে উপস্থিত স্যাটালাইট ব্যবহার করে। এই কারণেই এই অর্বিটে সাধারণত কমিউনিকেশান স্যাটেলাইট ব্যবহার করা হয়। লোয়ার আর্থ অর্বিটে থাকা স্যাটলাইট একটি নির্দিষ্ট স্থান ত্যাগ করলে সেখানে কমিউনিকেশান লিংক স্থাপন করা যায় না তাই কমিউনিকেশান স্যাটেলাইট জিওস্টেশেনরি অর্বিটে স্থাপন করা বিশেষ প্রয়োজনীয়। সেই সঙ্গে আরেকটি সুবিধা হলো এই অর্বিটে বায়ু থাকে না থাকায় এক একটি স্যাটালাইট প্রায় ১৫ বছর দীর্ঘস্থয়ী হয় এখানে ।
এবার প্রশ্ন উঠতে পারে, আর্থ ইমেজিং স্যাটেলাইট তো ছবি তোলার জন্য। এটি লো আর্থ অর্বিটে স্থাপন করা হয় ভালো রেজোলিউশানের জন্য। কিন্তু তাহলে জিস্যাট-১ আর্থ ইমেজিং স্যাটেলাইট হওয়া সত্বেও একে লো আর্থ অর্বিটে স্থাপন না করে ৩৬,০০০কিমি দূরে জিও স্টেশেনারি অর্বিটে কেনো স্থাপন করা হচ্ছে যেখানে স্যাটালাইট এর রেজোলিউশন বেড়ে হবে ৪২মিটার? তাহলে এত বাজে রেজোলিউশানে ওঠা ছবির নিয়ে ভারতের লাভই বা কি?
আছে এই প্রশ্নের ও উত্তর। জিস্যাট-১ কোনো সাধারণ স্যাটালাইট নয়। এই নতুন স্যাটেলাইটে কিন্তু বর্ডার পাহারা দেওয়ার জন্যও তৈরি করা হয়নি। বরং এটি ব্যবহৃত হবে ব্যলিস্টিক মিসাইল আর্লি ওয়ার্নিং সিস্টেম হিসেবে।এতে রয়েছে অত্যাধুনিক ইনফ্রারেড সেন্সর যা রকেট বা মিসাইলের বুস্টার থেকে নির্গত থ্রাস্ট হিটকে সহজেই ডিটেক্ট করতে পারে।
জিওস্টেশেনারি অর্বিটে উপস্থিত থাকায় ছবির রেজোলিউশন ভালো হবে না ঠিক ই তবে, এটি ভারতীয় উপমহাদেশের ওপর একটানা নজর রাখতে পারবে। ফলে, যেকোনো বড় আক্রমণ থেকে দেশ তো রক্ষা পাবেই সেই সঙ্গে বহু দিন সচল ও থাকবে স্যাটালাইট টি।
আর ঠিক এই কারণেই এক বছর আগে জিস্যাট-১ এর লঞ্চ বন্ধ হওয়ার পিছনে অনেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সন্দেহ করছে। ভারত সঠিকভাবে স্যাটালাইট টি লঞ্চ করতে পারলে ভারতের হাতে এক প্রভূত ক্ষমতা আসবে। যা থেকে ভারতীয় উপহাদেশে এক ওয়েপেন রেস শুরু হওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। মনে করা হচ্ছে ভারতের হাতে একচ্ছত্র ক্ষমতা দিয়ে অস্ত্র যুদ্ধের ঝুঁকি নিতে চাইছিল না আমেরিকা। তবে, ঘটনা যাই হোক না কেনো ইসরোর এই পদক্ষেপ ভারতকে যে এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছে নিয়ে যাচ্ছে তা বলাই বাহুল্য।