পাকিস্তানে ঢুকে ভারতের শত্রুকে শেষ করেছিল ভারতীয় গোয়েন্দারা
সময়টা ১৯৮৪ সাল, ভারতে একের পর এক সন্ত্রাসী আক্রমন করাচ্ছে পাকিস্তান। একশোটির বেশী সন্ত্রাসী হামলায় পাঁচশোর বেশী মানুষের মৃত্যু হয়ে গেছে ইতিমধ্যেই। এরকম পরিস্থিতিতে অক্টোবর মাসে তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে হত্যা করা হয়। এই ঘটনায় সবচেয়ে খুশী হয় পাকিস্তানের ইনটেলিজেন্স সংস্থা আইএসআই। ভারত থেকে ৭০০০ কিলোমিটার দূরে লন্ডনে থাকা আব্দুল খান আইএসআই প্রধানকে ফোনে ভারতের এরকম পরিস্থিতিতে আরও বেশী সন্ত্রাসী আক্রমনের পরিকল্পনা জানায়। আব্দুল খান লন্ডন থেকেই ভারতে একাধিক সন্ত্রাসী আক্রমন করাতো। আব্দুল খানের ধারনা ছিল সে লন্ডনে আছে তাকে ভারত কিছুই করতে পারবেনা। কিন্ত আব্দুল খান জানতোনা ভারতের ইনটেলিজেন্স সংস্থা র এর এক এজেন্ট সঞ্জীব জিন্দাল তাকে নরকে পৌঁছানোর জন্য পরিকল্পনা তৈরি করছে।
নভেম্বর মাসে সঞ্জীব জিন্দাল লন্ডনে যান এবং তিনি খবর পান আব্দুল খানের বাড়িতে আইএসআই প্রধান, ভারত থেকে পালিয়ে যাওয়া খালিস্তানি জঙ্গী সান্ধু এবং পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা সেক্রেটারির আসা যাওয়া রয়েছে। জিন্দাল জানতে পারেন খান এবং সান্ধু ভারতে আরও বেশী জঙ্গী হামলার ছক তৈরি করেছে। খান ও সান্ধু ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানে যেরকম সমস্যা তৈরি হয়েছিল সেরকমই সমস্যা ভারতেও তৈরি করতে চাইছে যাতে ভারত সরকার এই সমস্যা সমাধান করতে না পারে এবং ভারতের কয়েক টুকরো হয়ে যায়। জিন্দাল বুঝে যান আব্দুল খানকে যেকরেই হোক প্রতিরোধ করতে হবে। তিনি এই সমস্ত গোপন তথ্য নিয়ে দিল্লিতে র এর মুখ্যা কার্যালয়ের উদ্দেশ্যে রওনা দেন।
দিল্লি পৌঁছেই জিন্দাল এই খবর তার বস অনুজ ভরদ্বাজকে জানান। সঞ্জীব জিন্দাল ও অনুজ ভরদ্বাজের মধ্যে দুই ঘন্টার গোপন বৈঠক হয়। বৈঠকের শেষে ভরদ্বাজ জিন্দালকে জিজ্ঞেস করেন তার কাছে কোনও বিশেষ পরিকল্পনা আছে কীনা। কোনও দেরী না করেই জিন্দাল সাথে সাথে জানান লন্ডনেই আব্দুল খানকে হত্যা করতে হবে। ভরদ্বাজ জিন্দালের এই কথা শুনে চমকে যান কারন লন্ডনে খানকে হত্যা করা যথেষ্ট ঝুঁকির কাজ, কারন কোনওরকম ভুল হলেই ইংল্যান্ডের সাথে ভারতের কুটনৈতিক সম্পর্ক খারাপ হতে পারে। কিন্ত সঞ্জীব জিন্দালের আত্মবিশ্বাস দেখে অনুজ ভরদ্বাজ তাকে অপারেশনের সবুজ সংকেত দিয়ে দেয়। সঞ্জীব জিন্দাল এরপর লন্ডনেই আব্দুল খানকে হত্যা করবার বিশেষ পরিকল্পনা তৈরি করে, এই অপারেশনের নাম দেওয়া হয় অপারেশন হর্নেট। কিন্তু আব্দুল খানকে লন্ডনে হত্যা করা এতটা সহজ ছিলনা। আব্দুল খানকে আইএসআই সর্বদা নিরাপত্তা দিত। তাছাড়া ইংল্যান্ডের নাগরিক ও বড় ব্যবসায়ী হওয়ায় ব্রিটিশ পুলিশও আব্দুল খানের নিরাপত্তায় ছিল। আইএসআই এর কড়া নিরাপত্তায় লন্ডনের একটি বিলাসবহুল প্রাসাদে থাকতো আব্দুল খান।
জানুয়ারি, ১৯৮৫ সালে প্যারিসের এক কফিশপে ক্লার্ক ও মোহন নামে র এর দুই এজেন্টের সাথে বৈঠক করে জিন্দাল। বৈঠকে জিন্দাল তাদের জানান অপারেশন দুই ধাপে হবে। প্রথম ধাপে ক্লার্ক ও মোহন লন্ডনে আব্দুল খানের উপর নজর রাখবে এবং দ্বিতীয় ধাপের কাজ জিন্দাল করবে। বৈঠক শেষ হতেই ক্লার্ক ও মোহন লন্ডনের উদ্দেশ্যে রওনা দেন এবং জিন্দাল অস্ট্রিয়া যান সোফি নামে র এর আরেক এজেন্টের সাথে দেখা করতে। সোফির সাহায্যে এর আগেও লন্ডনে এক সন্ত্রাসীকে হত্যা করেছিল জিন্দাল, সেসময় সোফির জন্যই জিন্দালের নামও জানতে পারেনি ব্রিটিশ পুলিশ। জিন্দাল অনেকদিন ধরেই একটা খবর জানার চেষ্টা করছিলো তা হল আইএসআই ও আব্দুল খানকে অর্থ সাহায্য করছে কে। অস্ট্রিয়াতে জিন্দালের সাথে দেখা করতে সোফি একা আসেনি তার সাথে আরও একজন লোক এসেছিল যার নাম হারপ্রীত আহুজা। হারপ্রীত আহুজা সঞ্জীব জিন্দালকে জানায় সে একজন আমেরিকান ব্যবসায়ী শেঠির কাছে কাজ করে। বিগত কীছু মাস ধরেই শেঠির সাথে বেশ কীছু অচেনা লোকের সাখ্যাত বেশী হয়ে গেছে যাদের সে প্রতিমাসে কোটি কোটি টাকা দেয়। হারপ্রীত আরও জানায় সে খোঁজ নিয়ে দেখেছে এই সমস্ত লোক আইএসআইএর লোক। এই খবর শুনেই জিন্দাল হারপ্রীতকে জানান সোফিকেও শেঠির অফিসে কাজে নিয়োগ করতে এবং দুজনে মিলে যতটা সম্ভব আরও তথ্য জোগার করতে। এদিকে লন্ডনে মোহন ও ক্লার্ক আব্দুল খানের বাড়ির মালি তারেক সিদ্দিকীকে অর্থের মাধ্যমে দশ মাস ধরে যাবতীয় খবরা খবর নিতে থাকে।
১৯৮৫ সালের অক্টোবর মাসে মোহন তারেকের মাধ্যমে একটি কাগজ পায় যা একটি ব্যাঙ্কের রশিদ। এখানে দেখা যাচ্ছিল সান্ধু ও তার দেহরক্ষী হারবাক্স কোনও অজানা ব্যক্তির থেকে মোটা অর্থ পেয়েছে। মোহন বুঝে যায় আরও তথ্যের জন্য হারবাক্সকে প্রয়োজন তাদের। এজন্য মোহন ভারত থেকে আসা হারবাক্সের ভাই অমরজিতকে ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নেয়। অমরজিত ভারত থেকে ইংল্যান্ডে এসে বহুদিন ধরেই নাগরিকত্বের জন্য ইমিগ্রেশন অফিসে যাতায়াত করছিলো। একদিন অফিসের সামনে হঠাৎ করে ক্লার্কের সাথে পরিচয় হয় অমরজিতের। একজন ব্রিটিশ নাগরিকের সাথে পরিচয় হয়ে ব্যাপক খুশি হয় অমরজিত, ক্লার্ক তাকে জানায় সে ইমিগ্রেশন অফিসেই কাজ করে। এই ঘটনা শুনে অমরজিত এতটাই আনন্দিত হয় যে সে ক্লার্কের সাথে ইমিগ্রেশন অফিসে প্রবেশ করে। অফিসের একটি গোপন কক্ষে আগে থেকেই বসে ছিল মোহন। ক্লার্ক ও মোহন উভয়েই অমরজিতকে জানায় তারা র এর এজেন্ট, তারা তার ভাই হারবাক্সের খবর জানতে চায়। অমরজিতকে বলা হয় হারবাক্সের খবর না জানালে তার অতীত জীবন ব্রিটিশ প্রশাসনকে জানিয়ে দেওয়া হবে। অমরজিত ভারতে চারটি খুন করে ইংল্যান্ডে পালিয়ে এসেছিল সে জানতো এই খবর ইংল্যান্ডের প্রশাসন জানতে পারলে তাকে ভারতে ফেরত পাঠিয়ে দেবে। সেজন্য সে বাধ্য হয়ে হারবাক্সের বিরুদ্ধে সমস্ত তথ্য জানায় এবং ভবিষ্যতেও জানাতে থাকবে বলা জানায়, এর বদলে তাকে দশ হাজার ডলার দেওয়া হয়। নভেম্বর মাসে জিন্দালের সাথে বৈঠকে মোহন ও ক্লার্ক সমস্ত তথ্য জানায়। জিন্দাল তাদের নির্দেশ দেয় হারবাক্সের বিরুদ্ধে সব তথ্য ব্রিটিশ পুলিশকে জানিয়ে দিতে। কিন্তু ব্রিটিশ পুলিশের গ্রেফতারের আগেই হারবাক্স পাকিস্তান পালিয়ে যায় কারন আইএসআই অমরজিতের মাধ্যমে এই খবর আগেই পেয়ে গিয়েছিল। পাকিস্তানে কীছু মাসের দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় হারবাক্সের। অন্যদিকে শেঠিও সোফির কারনে বাধ্য হয় আইএসআইয়ের পক্ষ ছেড়ে জিন্দালের সাথে যোগ দিতে।
জুলাই, ১৯৮৬ সালে হারপ্রীত, সোফি, শেঠি ও জিন্দালের মধ্যে প্যারিসে বৈঠক হয়। বৈঠকে শেঠি জিন্দালকে একটি সিডি দেয় যাতে আইএসআই এর ভারতের বিরুদ্ধে সমস্ত ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনা, ভারতে থাকা আইএসআই এজেন্টের নাম ছিল। সিডিতে সান্ধুর ভারত বিরোধী কার্যকালাপের প্রমানও ছিল। এই সিডি ব্রিটিশ হোম সেক্রেটারিকে পাঠিয়ে দেয় জিন্দাল। দীর্ঘদিন ধরে ভারত বিরোধী খালিস্তানি নেতা সান্ধুকে আশ্রয় দেওয়া ব্রিটিশ পুলিশ এবার বাধ্য হয় তাকে গ্রেফতার করতে। কিন্ত তখনও আব্দুল খানকে ধরা বাকী ছিল। সঞ্জীব জিন্দাল একে একে আব্দুল খানের সমস্ত নেটওয়ার্ক ধ্বংস করে দেয়। সান্ধু গ্রেফতারের পর দীর্ঘ কয়েকমাস পরেও আব্দুল খানকে হত্যা করবার কোনও উপায় খুঁজে পাচ্ছিলেন না জিন্দাল। উপরন্তু হারবাক্স ও সান্ধুর ঘটনার পর থেকে আব্দুল খান আরও সতর্ক হয়ে গেছিল। জিন্দাল বুঝে যান খানকে ইংল্যান্ডে হত্যা করা যাবেনা। এদিকে ভারতে তখনও সন্ত্রাসী গতিবিধি থামেনি। জিন্দাল বুঝে যান যতদিন আব্দুল খান জীবিত থাকবে ততদিন ভারতে সন্ত্রাসী কার্যকালাপ হতেই থাকবে। কিন্তু খানের লন্ডন ছেড়ে বেরোনোর কোনও লক্ষনই ছিলনা।
১৯৮৭ সালের মে মাসে হঠাৎই জিন্দালের কাছে একটি ফোন আসে। ফোনের ওপার থেকে তারেক সিদ্দিকী জানায় আব্দুল খান পরিবারের সাথে দেখা করতে পাকিস্তানে যাবে। সাথে সাথে পরিকল্পনা শুরু করে দেয় সঞ্জীব জিন্দাল। আব্দুল খান পাকিস্তানে গিয়ে প্রতিদিন সকাল চারটেয় নামাজ পড়তে যেত এবং তারপর হাট থেকে সবজী কিনে নয়টার দিকে বাড়ি ফিরত। এরকমই একদিন নামাজ শেষে হাটে যাওয়ার পথে হঠাৎই দুজন অপরিচিত ব্যক্তি বন্দুক নিয়ে খানের পীছু নেয়। আব্দুল খান সাথে সাথে বুঝে যায় তারা র এর লোক। আব্দুল খান কখনও কল্পনাও করেনি র পাকিস্তানেও চলে আসবে তাকে খুঁজতে। লন্ডনে বসে ভারতে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ চালানো খান সাক্ষাৎ মৃত্যুকে তার চোখের সামনে দেখতে পায়। প্রান বাঁচাতে বিভিন্ন গলিতে দৌড়াতে থাকে খান। কিন্ত বাইকের সাথে পাল্লা দিয়ে একজন মানুষ আর কতক্ষন দৌড়াবে। একটা সময় বাইকের পেছনে থাকা আরোহীর পরপর নয়টা গুলি খানের শরীর ভেদ করে। ভারতে অসংখ্য সাধারন মানুষকে হত্যা করা আইএসআইয়ের কসাই আব্দুল খান পাকিস্তানের নোংরা গলিতেই মৃত অবস্থায় পড়ে থাকে।
