রক্ত জমাট বাধার পরীক্ষার মতো আর কি কি নিয়ে পরীক্ষা করতেন জার্মান চিকিৎসকরা?
যুদ্ধ মানেই ধ্বংসের খেলা। তবে ধ্বংসের স্তরে শুধুমাত্র যোদ্ধারই নয় ভেঙে পড়ে গোটা একটা দেশ এবং তার পরিকাঠামো। ধ্বংসলীলার মধ্যে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় সাধারণ মানুষের। যুদ্ধ বললেই সবার প্রথমে মনে পড়ে যায় প্রথম এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কথা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে শুধুমাত্র যুদ্ধক্ষেত্রে মানুষ রক্তাক্ত হয়নি, পাশাপাশি বহু মানুষের অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও একাধিক গবেষণা হয়েছে তাদেরকে নিয়ে। তারই বেশ কয়েকটি উদাহরণ এই প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে। এখানে আরেকটি কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা দরকার যে এই সমস্ত পরীক্ষারগুলি মূলত ডক্টর জোসেফ মেঙ্গেলের দ্বারা সম্পাদিত করা হতো।
I) যমজদের নিয়ে পরীক্ষা :- নাৎসি চিকিৎসক জোসেফ মেঙ্গেল যমজ শিশুদের নিয়ে অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছেন। অনেক সময় দেখা গিয়ছিল যে অসউইৎজ কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে বন্দীদের মধ্যে থেকে বেছে বেছে যমজদের আলাদা করে রাখতেন। প্রতিদিন রুটিন করে যমজদের রক্তের নমুনা নেয়া হতো। এর পেছনের কারণ যে আসলে কী তা আজও জানা যায় নি। যমজদের শরীর অত্যন্ত নিখুঁতভাবে পরীক্ষা করা হতো। তাদের শরীরের প্রতিটি অংশের মাপ নেয়া হতো যথাসম্ভব নির্ভুলভাবে। এমনকি কখনো কখনো একজন থেকে আরেকজনের শরীরে রক্ত সঞ্চালনও করা হতো মাত্রাতিরিক্ত পরিমাণে। এছাড়া অনেক সময় একজন শিশু শরীরে ব্যাকটেরিয়া প্রবেশ করিয়ে দেওয়া হতো। সেই ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে একটি শিশু মারা গেলে অন্য জনকেও মেরে ফেলা হতো। অর্থাৎ কথা বলা যেতেই পারে যে ক্যাম্পে যে সকল জমজ শিশু আসতো তারা কেউই আর বাইরের আলো দেখতে পেতো না। এমনই নানা পরীক্ষার কারণে তাদের মৃত্যু হতো।
II) হাড়, পেশী বা স্নায়ু প্রতিস্থাপন :- ১৯৪২ থেকে ১৯৪৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে মানুষের অঙ্গ স্থাপন করা হতো কোন রকম অ্যানেস্থেসিয়া ছাড়াই। কারণ বিজ্ঞানীরা দেখতে চেয়েছিলেন যে টিস্যু বা কোষের কিভাবে পুনর্জনম ঘটে। এই পরীক্ষাগুলি Ravensbrück-এ মহিলাদের শিবিরে বন্দী করা মহিলাদের উপরেই বেশি প্রয়োগ করা হতো। তবে অ্যানেস্থেসিয়া প্রয়োগ না করার কারণে অনেক মহিলা পেশী স্থাপনের যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে মারা যেত।
III) স্পটেড ফিভারের পরীক্ষা :- বুখেনওয়াল্ড ও নাৎজওয়েইলার কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে ১৯৪১-১৯৪৫ সাল পর্যন্ত এই পরীক্ষা করতে দেখা গিয়েছে। এই পরীক্ষার মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা জার্মান সেনাবাহিনীদের শারীরিক উন্নতি ঘটাতে গিয়ে অধিকাংশ মানুষের হত্যা করেছেন। কারণ এই পরীক্ষার মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা বন্দীদের শরীরে স্পটেড ফিভার ও অন্যান্য রোগের ভ্যাক্সিন নিয়ে গবেষণা চালায়। এই পরীক্ষায় তাদের দেহে প্রবেশ করানো হয় রোগটির ভাইরাস, দুর্ভাগ্যজনকভাবে ভ্যাকসিনটি অকার্যকর হওয়ায় তাদের প্রায় ৯০ ভাগই মারা যায় এতে। বাকি ২৫ শতাংশ মানুষের শরীর কোনরকম ভ্যাকসিন না দিয়েই রোগ প্রবেশ করানোয় তাদেরও মৃত্যু ঘটে।
IV) রক্ত জমাট বাধার পরীক্ষা :- জার্মান চিকিৎসক সিগমুন্ড র্যাশারের তত্ত্বাবধানে ডাকাউ কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের বন্দীদের উপর রক্ত জমাট বাধা সংক্রান্ত নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হতো। এই পরীক্ষা করতে গিয়ে বন্দীদের উপরে নরকিয় অত্যাচার করতেন চিকিৎসকরা। রক্ত জমাট বাঁধার এই পরীক্ষা সফলের জন্য প্রথমে বীট ও আপেলের পেক্টিন যেটি চিনির মতো এক ধরনের যৌগিক পদার্থ যা জ্যাম, জেলি বানাতে ব্যবহৃত হয়, তার থেকে পলিগ্যাল নামক একটি ট্যাবলেট বানিয়েছিলেন চিকিৎসক সিগমুন্ড র্যাশার। এরপর চিকিৎসক নিজস্ব ফর্মুলায় তৈরিকৃত এই ট্যাবলেটটি যুদ্ধক্ষেত্র ও চিকিৎসায় রক্তপাত বন্ধ করতে সাহায্য করবে বলেই অনুমান করেছিলেন।যার কারণে ট্যাবলেট অতটা সফল হয়েছে, তবে এই পরীক্ষা করতে বন্দীদের জোর করে ট্যাবলেট খাইয়ে সরাসরি গুলি করা হতো তার বুক কিংবা ঘাড়ে। এরপর কোনরকম চেতনানাশক প্রয়োগ না করেই দুর্ভাগা সেই বন্দীদের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেটে নেওয়া হতো। যদিও এই পরীক্ষার ফলস্বরূপ চিকিৎসক কোনরকম সফলতা তো পাননি উপরন্ত বন্দীরা অকালে নিজেদের প্রাণ হারিয়েছেন।
V) সালফোন্যামাইড পরীক্ষা :- চিকিৎসা বিজ্ঞানের আরো কঠিন ও নরকীয় পরীক্ষা হল সালফোন্যামাইড পরীক্ষা। এই পরীক্ষা মূলত দেখা গিয়েছে র্যাভেন্সব্রুক কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে। এখানে প্রথমে বন্দিদের পায়ের মাংস পেশির কিছু অংশ কেটে নেওয়া হতো। এরপরই সেখানে ব্যাক্টেরিয়ার মিশ্রণ দিয়ে জায়গা রেখে ভালো করে সেলাই করে দেওয়া হতো। এছাড়াও অনেকসময় যুদ্ধক্ষেত্রে যোদ্ধাদের গায়ে গুলি লাগলে রক্ত বন্ধ করার জন্য দুটো শিরা একসঙ্গে নিয়ে গিট বেঁধে দেওয়া হতো। এমন নরকীয় পরীক্ষা পরবর্তীকালে চিকিৎসা বিজ্ঞানে এক বিরাট পরিবর্তন আনলেও তখনকার দিনে মানুষদের অসহ্য যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়েছিল। অনেক পরীক্ষায় কাটাছেড়ার যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে অনেকেই মৃত্যুবরণ করেছিল।
VI) হাইপোথার্মিয়ার প্রভাব পরীক্ষা করা :- মানুষের শরীর কতটা ঠান্ডা সহ্য করতে পারে, সেই পরীক্ষাই হলো হাইপোথার্মিয়া। এই পরীক্ষায় মাধ্যমে প্রথমে বন্দীদের ঠান্ডা বরফ জলে ও তুষারের মধ্যে নগ্ন হয়ে রেখে দেওয়া হতো।
প্রায় ৩০০ জন বন্দীর উপর এই পরীক্ষা একাধিকবার করা হয়েছিল এবং অনেকেই ঠাণ্ডায় মারাও গেছে। মরে গেলেও নিস্তার ছিল না এই পরীক্ষা থেকে। কারণ মৃত মানুষদের আবার পুনর্জীবিত করার জন্য অনেক সময় গরম জলের মধ্যে মৃত দেহগুলিকে দিয়ে দেওয়া হতো।
