চানক্যের সময়ে ভারতবর্ষের গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক কতোটা শক্তিশালী ছিল জানেন?
শত্রুর থেকে যেমন নিরপদে থাকতে চায় প্রতিটি মানুষ ঠিক তেমনই কোন ছোট রাজ্য হোক কিংবা বড় দেশ প্রত্যেকেই তার শত্রুর উপর নজর রাখে গোপনে যাতে শত্রুর প্রতিটি পদক্ষেপের ব্যাপারে আগে থেকেই সচেতন থাকা যায়। বর্তমানে কোন দেশ তার শত্রু দেশের পাশাপাশি বন্ধু দেশের উপরেও গোপনে নজর রাখে কারন ভূ রাজনীতিতে চিরস্থায়ী মিত্র বা চিরস্থায়ী শত্রু বলে কিছু হয়না। প্রত্যেক দেশ নিজের স্বার্থ অনুযায়ী কুটনৈতিক সম্পর্ক তৈরি করে। যার কারনে মিত্র দেশের উপরেও নজর রাখা প্রয়োজন। এই কারনে প্রতিটি শক্তিশালী দেশই তার নিজস্ব ইনটেলিজেন্স নেটওয়ার্ক তৈরি করেছে যারা সেই দেশটির শত্রু ও মিত্রর উপর নজর রাখে প্রতিনিয়ত, যেমন ভারতের রয়েছে র, আমেরিকার সিআইএ, ইসরায়েলের মোসাদ, ব্রিটেনের রয়েছে এমআইসিক্সের মতোন ইনটেলিজেন্স নেটওয়ার্ক।
ভারতের প্রতিবেশী পাকিস্তান ও চীন ভারতের সবচেয়ে বড় শত্রু যারা প্রতিনিয়ত ভারতে নাশকতার পরিকল্পনা করে, এছাড়া ভারতের আরেক প্রতিবেশী বাংলাদেশের উপরেও নজর রাখা হয় কারন পাকিস্তানের ইনটেলিজেন্স নেটওয়ার্ক আইএসআই বাংলাদেশেও তার ঘাঁটি তৈরি করতে পারে।
১৯৬৮ সালে র এর গঠন হওয়ার পর থেকে র ভারতের নিরাপত্তা ব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে গেছে। র এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর কারনে আজ প্রতিটি ভারতবাসী শান্তিতে ঘুমোতে পারে। তবে বর্তমান ভারতের মতো প্রাচীন ভারতেও গুপ্তচর ব্যবস্থার প্রচলন ছিল। আজ র যতটা শক্তিশালী তেমনি অতীতেও ভারতের ইনটেলিজেন্স নেটওয়ার্ক যথেষ্ট মজবুত ছিল। মহান ছত্রপতি শিবাজি মহারাজের সময়কালের আগেও গোয়েন্দা সংস্থা বিশেষ করে রাজনীতির পরিভাষা রচনা করেছিলেন মহান আচার্য শ্রী বিষ্ণুগুপ্ত চানক্য। যেসময় পশ্চিমা দেশগুলোর উন্নত ভারতীয় সভ্যতা সম্পর্কে কোনও ধারনাই ছিলনা তারও তিনশো বছর আগে আচার্য চানক্য রাজনীতি ও গুপ্তচরবৃত্তিতে ভারতের দক্ষতা বিশ্বের সামনে তুলে ধরেছিলেন। সেসময়কার মজবুত ইনটেলিজেন্স নেটওয়ার্ক ভারতকে বহুবার বিপদের হাত থেকে রক্ষা করেছিল।
একটা সময় ভারতের সীমানা আফগানিস্তান অবধি ছিল। আচার্য চানক্যের অখন্ড ভারতের স্বপ্ন সফল করার পেছনে এক চালাক গুপ্তচর জিভাসিদ্ধির অনেক ভূমিকা ছিল। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য যখন শুধু চন্দ্রগুপ্ত ছিল অর্থাৎ মগধের সিংহসনে চন্দ্রগুপ্তের বসার আগেই আচার্য চানক্য অখন্ড ভারতের স্বপ্ন দেখেছিলেন। সেসময় মগধের শাসক ছিল নন্দ বংশের অত্যাচারী শাসক ধননন্দ। ধনন্দের শাসন কালের সময়েই গ্রীসের আলেকজান্ডার দি গ্রেট একের পর এক প্রদেশ দখলের পর ভারতের দিকে অগ্রসর হয়। আচার্য চানক্য জানতেন যদি আলেকজান্ডারকে প্রতিরোধ করা না যায় তাহলে সে ভারতবর্ষ দখল করে ফেলবে। সেসময় ভারতবর্ষ ষোলোটি মহাজনপদে বিভিক্ত ছিল যার মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী ছিল মগধ। চানক্য ঠিক করেন ষোলটি মহাজনপদকে সংযুক্ত করবে তবেই আলেকজান্ডারকে প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে। চানক্য জানতেন একমাত্র মগধই পারে ষোলো মহাজনপদকে একত্রিত করতে কারন সেসময় ভারতের রাজনীতিতে মগধের প্রভাব ছিল সর্বাধিক।
চানক্য ষোল মহাজনপদকে সংযুক্ত করার প্রস্তাব নিয়ে যান মগধের শাসক ধনন্দের কাছে। কিন্ত ক্ষমতার অহঙ্কারে পূর্ন ধননন্দ চানক্যকে রীতিমতো অপমান করে রাজসভা থেকে বের করে দেন। এরপর যা হয় তা ইতিহাস, আচার্য চানক্য প্রতিজ্ঞা করেন ধননন্দকে মগধের সিংহাসন থেকে সরানোর। চানক্য সাধারন চন্দ্রগুপ্তকে প্রশিক্ষন দিয়ে শক্তিশালী যোদ্ধা তৈরি করেন। চন্দ্রগুপ্ত পরে ধননন্দকে পরাজিত করে মগধের সিংহাসনে বসেন এবং মৌর্যবংশের স্থাপনা করেন।
গুরু চানক্যের আদেশ অনুযায়ী চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য অখন্ড ভারত গঠনের কাজ শুরু করেন। কিন্তু চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের অখন্ড ভারতের স্বপ্নে সবচেয়ে বড় বাধা ছিল অমাত্য রাক্ষস। মগধের শাসক ধনন্দের মন্ত্রী ছিল অমাত্য রাক্ষস। তিনি ধননন্দের মৃত্যু মেনে নিতে পারেনি। অমাত্য রাক্ষস গোপনে মগধ থেকে পালিয়ে গিয়ে সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করে। চানক্য জানতেন অমাত্য রাক্ষসকে আটকানো না গেলে অখন্ড ভারত গঠন কখনও সম্ভব হবেনা। অমাত্য রাক্ষসের কাছে মগধ সবচেয়ে প্রিয় ছিল এবং তিনি খুবই দক্ষ মন্ত্রী ছিলেন। চানক্য নিজেও চাইতেন অমাত্য রাক্ষস যেন চন্দ্রগুপ্তের মন্ত্রী হন, তবে সবার প্রথমে দরকার ছিল অমাত্য রাক্ষসের বিশ্বাস অর্জন করা যে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যও মগধের সমৃদ্ধি ও উন্নতি চায়। আচার্য চানক্য অমাত্য রাক্ষসকে প্রতিরোধের জন্য গুপ্তচরবৃত্তির সূচনা করেন। তিনি সেসময় ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ গুপ্তচর জিভাসিদ্ধিকে অমাত্য রাক্ষসের বিরুদ্ধে নিয়োগ করেন। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের মতোন জিভাসিদ্ধিকেও প্রশিক্ষন দিয়ে তৈরি করেছিলেন চানক্য নিজেই। সুরক্ষার জন্য গোটা মগধ জুড়ে গুপ্তচরদের ছড়িয়ে দেন চানক্য। চানক্যের গুপ্তচররা রাধুনি, ব্যবসায়ী, রক্ষক, কুমোড় সহ বিভিন্ন পেশার ছদ্মবেশে ছিল, এমনকী সাধুর ছদ্মবেশেও গুপ্তচরদের নিয়োগ করেছিলেন চানক্য কারন তিনি জানতেন সাধু, সন্ন্যাসী সবচেয়ে নিরাপদ তাদের কেউ তেমন সন্দেহ করবেনা।
জিভাসিদ্ধিকেও সাধুর ছদ্মবেশেই নিয়োগ করেন চানক্য। তবে অমাত্য রাক্ষসের উপর নজরদারি করা যথেষ্ট কঠিন ছিল কারন অমাত্য রাক্ষস নিজেও চানক্যের সমান বুদ্ধিমান ও পারদর্শী ছিলেন। এই জন্য তার উপর নজর রাখতে চানক্য নিজের সর্বশ্রেষ্ঠ গুপ্তচর জিভাসিদ্ধিকে নিয়োগ করেন। দায়িত্ব পেয়েই জিভাসিদ্ধি তার লোকেদের মাধ্যমে রটিয়ে দেন মগধে বাইরে থেকে একজন খুব উচ্চস্তরের জ্যোতিষী আসছেন। অমাত্য রাক্ষস জ্যোতিষশাস্ত্রে খুবই বিশ্বাস করতো যার কারনে তিনি তার দুজন অনুচরকে দিয়ে ওই জ্যোতিষকে তার গোপন স্থানে নিয়ে আসার আদেশ দেয়, জিভাসিদ্ধি এটাই চাইছিলো। তবে অমাত্য রাক্ষস প্রথমে জিভাসিদ্ধিকে পরীক্ষা করেন। তিনি জিভাসিদ্ধিকে জানান তার ব্যাপারে এমন কিছু তথ্য জানাতে যা একমাত্র সে ছাড়া কেউ জানেনা। অমাত্য রাক্ষস জানতোনা জিভাসিদ্ধি সব প্রস্ততি নিয়েই এসেছে। কিছুক্ষন চোখ বন্ধ করে জিভাসিদ্ধি জানায় নন্দ মহলে সাত নং বন্ধ ঘরে একটি রহস্য লুকিয়ে আছে, এখানে একজন ব্রাহ্মনকে হত্যা করা হয়েছে। এই কথা শুনেই চমকে যায় অমাত্য রাক্ষস এবং সাথে সাথে জিভানন্দের উপর তার বিশ্বাস হয়ে যায়। এভাবেই অমাত্য রাক্ষস জিভানন্দের জালে ফেঁসে যায়।
অমাত্য রাক্ষস জিভানন্দকে জানায় সে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যকে হত্যা করতে চায়, এই খবর সাথে সাথে চানক্যকে পাঠিয়ে দেয় জিভানন্দ। একদিন অমাত্য রাক্ষস জিভানন্দকে জানায় চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হবে তার জন্য সঠিক সময় জানাতে। জিভানন্দ আবারও সতর্ক করে দেয় আচার্য চানক্যকে। নির্দিষ্ট দিনে অমাত্য রাক্ষস তার একজন অনুচরকে সন্ন্যাসীর পোষাকে বিষযুক্ত প্রসাদ নিয়ে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের রাজসভায় পাঠায়। সন্ন্যাসী চন্দ্রগুপ্তকে আশীর্বাদ দিয়ে প্রসাদ দেয় কিন্তু চানক্য সেই প্রসাদ প্রথমে সন্ন্যাসীকে গ্রহন করার নির্দেশ দেয়। বাধ্য হয়ে প্রসাদ খেয়ে সেখানেই মারা যায় ওই সন্ন্যাসী। এভাবে অমাত্য রাক্ষসের প্রথম ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দেয় চানক্য। তবে অমাত্য রাক্ষস দমে যায়নি সে পুনরায় নতুন পরিকল্পনা শুরু করে। তবে এসবের মধ্যে পর্বতীয় প্রদেশের রাজা প্রবর্তক চানক্যের অখন্ড ভারতের স্বপ্নে বাধা দিচ্ছিল। রাজা প্রবর্তক চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের সাথে সন্ধি করতে রাজি ছিল কিন্তু তার বদলে চন্দ্রগুপ্তের অর্ধেক রাজত্বের দাবি করে যা চানক্য মেনে নেয়নি। এদিকে জিভাসিদ্ধি তার অনুচরের মাধ্যমে চানক্যকে খবর পাঠায় অমাত্য রাক্ষস এক অসাধারন রূপবতী নারীকে নিযুক্ত করেছে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যকে হত্যার জন্য, আসলে এই নারী একজন বিষকন্যা ছিল। আচার্য চানক্য এক বিশেষ পরিকল্পনা করেন, তিনি মগধে রাজা প্রবর্তককে আমন্ত্রন জানান। রাজা প্রবর্তককে এমন সময়ে আমন্ত্রন জানানো হয় যেসময় ওই বিষকন্যাও মগধে উপস্থিত ছিল। রাজা প্রবর্তক ওই বিষকন্যার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে ওই কন্যাকে দাবী করে বসে। বিষকন্যার বিষের প্রভাবে রাজা প্রবর্তক মূর্ছিত হয়ে যায়, বিষকন্যাও নিজে আত্মহত্যা করে।
কিছুদিন প্রচুর অসুস্থ থাকার পর মৃত্যু হয় রাজা প্রবর্তকের। এভাবে চানক্য এক তীরে দুই শিকার করেন প্রথমত বিষকন্যার হাত থেকে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যকে রক্ষা করেন এবং দ্বিতীয়ত অখন্ড ভারতের পথে বাধা সৃষ্টি করা রাজা প্রবর্তককে রাস্তা থেকে সরিয়ে দেন। এরপরেও অনেকবার অমাত্য রাক্ষস চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যকে হত্যা করবার পরিকল্পনা করেছিল কিন্তু প্রতিবার জিভানন্দের অসাধারন দক্ষতায় চানক্য সব কিছু জেনে যেত। বারবার পরাজয়ের পর অমাত্য রাক্ষস বুঝে যায় তিনি তার পরিকল্পনায় সফল হবেননা এবং তিনি এটাও বুঝতে পারেন চানক্য তার সম্পর্কে ভালোভাবেই জানে তবুও তাকে গ্রেফতার করেনি। আচার্য চানক্য চাইছিলেন অমাত্য রাক্ষস যেন চন্দ্রগুপ্তের রাজসভায় আসে কারন তার মতো বিচক্ষন মন্ত্রী চন্দ্রগুপ্ত পাবেনা। এরপরে অমাত্য রাক্ষস চন্দ্রগুপ্তের কাছে আত্মসমর্পন করেন এবং আজীবন চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের মন্ত্রী হয়ে মগধের উন্নতিতে ও অখন্ড ভারত গঠনে সহায়তা করেন। এভাবে তৎকালীন ভারতবর্ষে ইনটেলিজেন্স নেটওয়ার্ক তৈরির মাধ্যমে ভারতকে সুরক্ষিত করেছিলেন আচার্য চানক্য। মহান ছত্রপতি শিবাজি মহারাজও আচার্য চানক্যের মতোন অসাধারন ইনটেলিজেন্স নেটওয়ার্ক তৈরি করেছিলেন।
