আফ্রিকার শক্তিশালী জেনারেল দি গ্রেট হ্যানিবাল। জানুন বিস্তারিত
২১০ বিসি সালটা রোমান ইতিহাসের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ন কারন এই বছর এক রোমান মিলিটারি কম্যান্ডার পাবলিয়াস সিপিওকে স্পেনের উত্তর পূর্বে এব্রো নদীর তীরে পাঠানো হয়েছিল। পাবলিয়াসকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল এব্রো নদী অতিক্রম করে যদি কার্থেজেনিয়ান সেনা রোমান সাম্রাজ্যে আক্রমনের চেষ্টা করে তবে তাদের প্রতিরোধ করা। পাবলিয়াস সিপিওর জন্য এই মিশন তার নিজের জীবনের থেকেও দামী ছিল কারন কার্থেজেনিয়ান জেনারেল হ্যানিবালের উপর প্রতিশোধ নিতে চাইছিলো পাবলিয়াস। হ্যানিবালের সাথে রোমান সাম্রাজ্যের চরম শত্রুতা ছিল। ২১৮ বিসিতে হ্যানিবাল তার বিশাল হাতির বহর যুক্ত সেনাবাহিনী নিয়ে আল্পস পর্বত অতিক্রম করে রোমান সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরে আক্রমন করেছিলো। ২১৬ বিসিতে ক্যানের যুদ্ধে হ্যানিবাল একটি রোমান লিজিয়নকে পরাজিত করেছিল। এজন্য রোমান জেনারেলরা হ্যানিবালের সাথে যুদ্ধ করতে ভয় পেত। একজন বিখ্যাত রোমান জেনারেল ফ্যাবিয়াস ম্যাক্সিমাস হ্যানিবালের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবার জন্য একটি রননীতি তৈরি করেছিল। ফ্যাবিয়াস সরাসরি হ্যানিবালের সাথে যুদ্ধ করেনি বরং ফ্যাবিয়াস তার সেনাবাহিনীকে লুকিয়ে রাখতো। প্রয়োজনে হ্যানিবালের সেনাবাহিনীর উপর ছোট ছোট ঝটিকা আক্রমন করে পালিয়ে যেত। এই রননীতিকে ফ্যাবিয়াস স্ট্রাটেজি বলা হয় বা আধুনিক যুগে এটাই গোরিলা যুদ্ধ নামে পরিচিত।
ভারতেও এক বিখ্যাত মারাঠা পেশোয়া বাজিরাও এই স্ট্রাটেজি ব্যবহার করতো যুদ্ধে। পাবলিয়াস সিপিও জানতো হ্যানিবালের সাথে সরাসরি যুদ্ধ করা সম্ভব নয়। সেসময় রোমান সাম্রাজ্যের সমস্ত জেনারেলই হ্যানিবালের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ফ্যাবিয়াস স্ট্রাটেজি ব্যবহার করতো। পাবলিয়াসের হ্যানিবালের সাথে ব্যাক্তিগত শত্রুতাও ছিল। ২১৮ বিসিতে হ্যানিবাল যখন আল্পস পর্বত অতিক্রম করে রোমান সাম্রাজ্যে আক্রমন করে তখন তার কিছুসময় পর রোমান সেনেট পাবলিয়াসের বাবাকে স্পেনে পাঠায় কার্থেজেনিয়ান কলোনির উপর আক্রমন করতে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়েও জাপান সরাসরি ব্রিটেনের উপর আক্রমন না করে এশিয়া জুড়ে ব্রিটিশ উপনিবেশগুলোর উপর আক্রমন করছিলো। ২১১ বিসিতে স্পেনে লড়াই করতে করতে পাবলিয়াসের বাবার মৃত্যু হয়। এজন্য পাবলিয়াস হ্যানিবালকেই দায়ী মনে করতো এবং সে এর প্রতিশোধ নেবে মনস্থির করে ফেলে।
এব্রো নদীর তীরে পাবলিয়াস হ্যানিবালকে পরাস্ত করবার জন্য বিভিন্ন উপায় ভাবতে শুরু করে। হঠাৎই পাবলিয়াস খবর পায় এব্রো নদীর অপরদিকে কার্থেজেনিয়ান সেনাবাহিনী নেই, হ্যানিবালের সেনাবাহিনী স্পেনের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে আছে তারা এখনও রোমান সাম্রাজ্য আক্রমনের জন্য পূর্ন মনস্থির করেনি। এব্রো নদীর অপরপাড়ে একটি বড় কার্থেজেনিয়ান শহর ছিল নিউ কার্থেজ। একপ্রকার স্পেনে কার্থেজেনিয়ান কলোনির রাজধানী ছিল এই শহর। নিউ কার্থেজ থেকে পুরো স্পেনকে নিয়ন্ত্রন করতো কার্থেজেনিয়ানরা। এখানেই সমস্ত যুদ্ধবন্দীদের রেখেছিল কার্থেজেনিয়ানরা। এই শহর এতটাই বড় ছিল যে এখান থেকে কার্থেজিনিয়ান সেনা তাদের সিংহভাগ রসদ পেতো। পাবলিয়াস ঠিক করে নিউ কার্থেজ আক্রমন করবে। যদিও পাবলিয়াসেরকে আদেশ দেওয়া ছিল এব্রো নদীর তীরেই অপেক্ষা করতে কিন্তু তবুও নদী অতিক্রম করে নিউ কার্থেজ আক্রমন করে পাবলিয়াস। এখানে কার্থেজেনিয়ান সেনাবাহিনী না থাকায় খুব সহজেই শহর দখল করে নেয় পাবলিয়াস এবং শহরে সমস্ত যুদ্ধবন্দীদের মুক্ত করে তার সেনাবাহিনীতে যুক্ত করে। পাবলিয়াসের এই অভিযানের পরেই রোমে পাবলিয়াসের সম্মান বহুগুন বৃদ্ধি পায় কারন এইপ্রথম কোনও রোমান জেনারেল কার্থেজেনিয়ান কলোনির উপর আক্রমন করেছিলো। ধীরে ধীরে পুরো স্পেন রোমান সাম্রাজ্যের অধীনে চলে আসে। কিন্ত এরপরেও হ্যানিবালের সাথে সরাসরি যুদ্ধ করতোনা কোনও রোমান জেনারেল, হ্যানিবাল সেসময় ইতালিতে ছিল। হ্যানিবালকে ইতালি থেকে বের করার ক্ষমতা ছিলনা কোনও রোমান জেনারেলের কাছে। এজন্য পাবলিয়াস ঠিক করে হ্যানিবালের ঘর আফ্রিকাতে সরাসরি আক্রমন করবে তবেই হ্যানিবাল ইতালি থেকে বেরোবে। এই প্রস্তাব যখন পাবলিয়াস রোমান সেনেটে দেয় তখন প্রথমে সেনেট রাজি হয়নি কিন্তু পরে পাবলিয়াসের সাফল্য দেখে সেনেট তাকে আফ্রিকা অভিযানের অনুমোদন দেয়।
২০৮ বিসিতে পাবলিয়াস তার সেনা নিয়ে যুদ্ধজাহাজে রওনা হয় আফ্রিকা অভিমুখে। কার্থেজেনিয়ানদের রাজধানী কার্থেজের নীচের দিক দিয়ে রাজধানী অভিমুখে অভিযানের পরিকল্পনা করে পাবলিয়াস। কিন্তু কার্থেজেনিয়ান সেনাবাহিনী তার আগেই পাবলিয়াসের সম্পূর্ন সেনাবাহিনীকে ঘিরে ফেলে। এরকম অবস্থায় পাবলিয়াস অন্য একটি পরিকল্পনা করে। পাবলিয়াস তার কিছু প্রতিনিধিকে কার্থেজেনিয়ান জেনারেলদের সাথে সাক্ষাৎ করে সন্ধি করবার প্রস্তাব পাঠায়। এটা আসলে পাবলিয়াসের একটি বড় চাল ছিল। পাবলিয়াসের উদ্দেশ্য ছিল প্রতিনিধির রূপে গুপ্তচর পাঠিয়ে কার্থেজেনিয়ান সেনাবাহিনীর অবস্থান জানা। গুপ্তচররা পাবলিয়াসকে এসে জানায় পুরো কার্থেজেনিয়ান সেনাবাহিনী দুটি ভাগে বিভক্ত একটি ভাগে রয়েছে কার্থেজেনিয়ানদের নিজস্ব সেনাবাহিনী যারা খুবই শক্তিশালী এবং আরেকটি ভাগে রয়েছে নুমিডিয়ানস যারা কার্থেজেনিয়ানদের বন্ধু কিন্তু তাদের বাহিনী ততটা শক্তিশালী নয়। পাবলিয়াস তার কিছু সেনাকে নির্দেশ দেয় রাতের অন্ধকারে নুমিডিয়ানসদের ঘাঁটিতে আগুন লাগিয়ে দিতে। যেহেতু নুমিডিয়ানসদের ঘাঁটি ততটা সুরক্ষিত ছিলনা তাই খুব সহজেই সেখানে আগুন লাগিয়ে দেয় রোমান সেনারা। ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের কারনে নুমিডিয়ানস সেনারা কার্থেজেনিয়ান ঘাঁটিতে চলে যায়, ভীড়ের মধ্যে নুমিডিয়ানসদের সাথে কিছু রোমান সেনাও ছিল। তারা কার্থেজেনিয়ান ঘাঁটিতে পৌঁছে সেখানেও গোপনে আগুন লাগিয়ে দেয়। এই পুরো ঘটনায় কোনওরকম যুদ্ধ ছাড়াই পাবলিয়াস জিতে যায় এবং সে হ্যানিবালের রাজধানী কর্থেজের অভিমুখে যাত্রা শুরু করে।
২০২ বিসিতে কার্থেজের কিছু দূরে এসে উপস্থিত হয় পাবলিয়াসের সেনাবাহিনী। পথ মধ্যে সমস্ত কার্থেজেনিয়ান শহর রোমান সেনারা দখল করে নেয়। ততদিনে হ্যানিবালও আক্রমনের খবর পেয়ে ইতালি থেকে কর্থেজ চলে এসেছিল। কিন্ত পাবলিয়ান সরাসরি হ্যানিবালের উপর আক্রমন না করে ফ্যাবিয়াস স্ট্রাটেজি ব্যবহার করে গোরিলা আক্রমন শুরু করে। বেশ কিছু মাস পর অবশেষে জামা নামক জায়গায় উভয়পক্ষের সেনাবাহিনী সামনাসামনি আসে। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে পাবলিয়াসের সেনাবাহিনীর পীছু করতে করতে হ্যানিবালের সমস্ত সেনবাহিনী দুর্বল হয়ে পড়েছিল। যার জন্য যুদ্ধে পাবলিয়াস জিতে যায় এবং হ্যানিবাল বাধ্য হয় আত্মসমর্পন করতে। ২১০ বিসি থেকে ২০২ বিসি পর্যন্ত আট বছর ধরে পাবলিয়াসের নেতৃত্বে হ্যানিবালের বিরুদ্ধে পাবলিয়াস যেসমস্ত লড়াই করেছিল ইতিহাসে এসব লড়াইকে দ্বিতীয় পিউনিক যুদ্ধ বলা হয়। এই যুদ্ধের পর পাবলিয়াস সিপিও এর নাম হয় আফ্রিকানাস। রোমানরা এরপর কার্থেজেনিয়ানদের থেকে এতবেশী ক্ষতিপূরন আদায় করে যে ভবিষ্যতে আর কখনও কার্থেজেনিয়ানরা রোমান সাম্রাজ্যে আক্রমন করেনি। দ্বিতীয় পিকনিকের যুদ্ধ শেষে রোমে পাবলিয়াসের সম্মান ব্যাপক বেড়ে যায়। যেখানে সমস্ত রোমান জেনারেলরা হ্যানিবালকে ভয় খেত সোখানে পাবলিয়াস হ্যনািবালকে আত্মসমর্পন করতে বাধ্য করায়। এজন্য রোমান ইতিহাসে পাবলিয়াসের নাম স্বর্নাক্ষরে লেখা রয়েছে। পাবলিয়াস সরাসরি হ্যানিবালকে পরাস্ত করার জন্য প্রথমে হ্যানিবালের তিনটি শক্তিকে ভাঙে অর্থ, রসদ ও জোটসঙ্গী। স্পেন দখল করার মাধ্যমে হ্যানিবালের অর্থ ও রসদ সরবরাহ বন্ধ করে পাবলিয়াস, এরপর নুমিডিয়ানসদের ঘাঁটিতে আগুন লাগিয়ে তাদেরও দূর করে হ্যানিবালের থেকে। এভাবে দি গ্রেট হ্যানিবালকে পরাজিত করে পাবলিয়াস সিপিও।