সত্যিই কি সম্রাট শাহজাহান তাজমহল নির্মাণকারী শ্রমিক ও কারিগরদের হাতের আঙ্গুল কেটে দিয়েছিলেন?
প্রেমে পড়লে অনেকেই অনেক কিছু করতে হয় তা তো আমরা জানি। প্রেমে পড়ার পর অনেকে অনেক রকমের প্রমিসও করে থাকেন। কেউ কেউ চাঁদ তারা পেরে আনার কথা বলে, তো আবার কেউ বিভিন্ন ধরনের গিফ্ট যেমন জুয়েলারি, বিভিন্ন ধরনের দামি পোশাক ইত্যাদি দেওয়ার কথা বলে। তবে প্রেমের বিখ্যাত নজির হল তাজমহল, যেটি সম্রাট শাহজাহান তার প্রেমের জন্য তৈরি করেছিলেন।
মুঘল সম্রাট শাহজাহানের নির্দেশে তার ভালোবাসা, তার প্রয়াত স্ত্রী- এর স্মৃতির উদ্দেশ্যে তাজমহল নির্মাণ করা হয়েছিল। প্রায় কুড়ি হাজার শ্রমিক ও কারিগরের পরিশ্রমের ফলে দীর্ঘ ২২ বছর ধরে তৈরি করা হয়েছিল এই সৌধটি। ১৬৫৩ সালে তাজমহল নির্মাণের কাজ সমাপ্ত হয়। শোনা যায়, অবিকল একই রকম দেখতে আর কোনো সৌধ যাতে তৈরি না হয় সেই কারণে, তাজমহল যে সমস্ত শ্রমিক ও কারিগরেরা মিলে তৈরি করেছিলেন তাদের হাত বা হাতের আঙ্গুল কেটে নেওয়া হয়। ভারতীয় গণমাধ্যম ছাড়াও ব্রিটিশ গণমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানে এই বিষয়ের উল্লেখ পাওয়া যায়।
সত্যিই কি সম্রাট শাহজাহান তাজমহল নির্মাণকারী শ্রমিক ও কারিগরদের হাত বা হাতের আঙ্গুল কেটে দিয়েছিলেন? যে জনশ্রুতি শোনা যায়, সেই দাবির সপক্ষে ঐতিহাসিক কোনো প্রমাণ আছে কি?
১৯৭১ সালে রাঁচি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ থেকে প্রকাশিত জার্নাল অফ হিস্ট্রিকাল রিসার্চের ১৪ তম সংস্করণে এই জনশ্রুতিকে ‘শহুরে কিংবদন্তি’ বা রূপকথা হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। তাজমহলের ভ্রমণ বিষয়ক ওয়েবসাইট ইনক্রেডিবল ইন্ডিয়াতে তিনটি যুক্তির ভিত্তিতে দাবিটিকে ভুল প্রমাণ করা হয়।
প্রথমত, প্রায় ২০ হাজার মানুষের আঙ্গুল কাটা হয়ে থাকলে তার কোনো না কোনো প্রত্নতাত্ত্বিক চিহ্ন পাওয়া যেত। কিন্তু তা পাওয়া যায়নি।
দ্বিতীয়ত, সেইসময় তাজমহল নির্মাণের উল্লেখ পাওয়া যায় এমন কোনো বই অথবা সেই সময় ভারতে ভ্রমন করা বিদেশি পর্যটকদের কাছ থেকেও এমন কোনো বর্ণনা পাওয়া যায় না।
তৃতীয়ত, সম্রাট শাহজাহানের সময়কালকে মুঘল সাম্রাজ্যের নির্মাণশৈলীর সুবর্ণ যুগ বলা হতো। সম্রাট শাহজাহান শুধু তাজমহল নয়, আগ্রায় মতি মসজিদ,
দিল্লিতে লাল কেল্লা ও জামে মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। এছাড়াও শাহজাহানাবাদ নামে একটি শহর প্রতিষ্ঠা করেন। হাতকাটার জনশ্রুতি সত্যি হলে এমন নির্মাণশৈলী তৈরি করার জন্য কারিগর পাওয়া মুশকিল হয়ে যেত। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। বরং যে সমস্ত শ্রমিকেরা তাজমহল নির্মাণ করেছিলেন তাদের জন্য তাজমহলের কাছেই বাড়ি তৈরি করে দিয়েছিলেন সম্রাট শাহজাহান। যেটি বর্তমানে তাজগঞ্জ পরিচিত।
তবে উল্লেখিত ওয়েবসাইটটি জানায় আসলে সম্রাট শাহজাহান তাজমহল নির্মাণকারী শ্রমিক ও কারিগরদের সাথে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন। এই কারণে সেই সমস্ত শ্রমিকেরা অন্য কোনো সম্রাটের অধীনে কাজ করার সুযোগ হারায়। এই জন্যই শ্রমিকের হাত কেটে ফেলার জনশ্রুতিটি শোনা যায়।
তাজমহলের রক্ষণাবেক্ষণ করে থাকে খুদ্দক ই রোজা কমিটি। এই কমিটি চেয়ারম্যান হাজি তাহের উদ্দিন তাহেরের বক্তব্যের সাথেও এর মিল পাওয়া যায়।
তার কথা অনুযায়ী সম্রাট শাহজাহান ও কারিগরদের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছিল। যেখানে সম্রাট শাহজাহান কারিগরদের বলেছিলেন যাতে দ্বিতীয়বার তাজমহলের মতোন কোন সৌধ নির্মাণ করা না হয়, এরপর থেকে যখনই ওই কারিগরদের তাজমহল দূরের কথা জিজ্ঞাসা করা হতো, তখনই তারা বলতেন আমাদের হাত কেটে নেওয়া হয়েছে। সেই অর্থেই এই জনশ্রুতিটি প্রচলিত। এই চুক্তিটি ‘অ্যাগ্রিমেন্ট হ্যান্ডকাট’ নামে পরিচিত।