মরা মাছও মাত্র কয়েক সেকেন্ডে জমে যায়। বিশ্বের শীতলতম স্থান
আমাদের দেশে গরম সাধারনত সবচেয়ে বেশী পড়ে রাজস্থানের জয়শলমীরে। প্রচন্ড গ্রীষ্মে এখানে তাপমাত্রা থাকে ৪৮-৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আবার কাশ্মীর, হিমাচল প্রদেশে ঠান্ডায় তাপমাত্রা নেমে যায় শূন্যের নীচে। পশ্চিমবঙ্গে স্থানবিশেষে সাধারনত ৬-৭ ডিগ্রি তাপমাত্রায় মানুষ কাবু হয়ে যায়। কিন্তু জানেন কী পৃথিবীতে এমনও একটি দেশ আছে আছে যেখানে তাপমাত্রা -৬৭ ডিগ্রিতে পৌঁছে যায় কিন্তু তারপরেও সেখানে মানুষ বাস করে? দেশটি হচ্ছে ভারতের অন্যতম বন্ধু দেশ রাশিয়া যার ঠান্ডার সামনে হিটলারের অপ্রতিরোধ্য নাজি সেনাও হার মেনেছিল।
রাশিয়ার শাখা প্রজাতন্ত্রের ইয়াকুস্টকে বিশ্বের শীতলতম রাজধানী ও ওমিয়াকনকে বিশ্বের শীতলতম গ্রাম বলা হয়। এখানে তাপমাত্রা বছরের বেশীরভাগ সময়ই -৩০ ডিগ্রির নীচে থাকে। এখানে -৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা হলে মনে করা হয় প্রচুর ঠান্ডা পড়েছে একমাত্র তখনই স্কুল ছুটি দেওয়া হয়! বিশ্বের সবচেয়ে শীতলতম স্থান সম্পর্কেই বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।
রাশিয়ার ইয়াকুটিয়া এমনই একটি জায়গা যেখানে যেখানে গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা থাকে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস কিন্তু শীতকালে তাপমাত্রা থাকে -৬৪.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অর্থাৎ ইয়াকুটিয়াকের বার্ষিক তাপমাত্রা রেঞ্জ ১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত হয়। কোন জায়গার গ্রীষ্মকালীন ও শীতকালিন তাপমাত্রার পার্থক্যকে বার্ষিক তাপমাত্রা রেঞ্জ বলে। ইয়াকুটিয়ার দৈনিক তাপমাত্রা পার্থক্যও ২৫-৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস হয়ে থাকে। কোন জায়গার দিনের সর্বোচ্চ ও রাতের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা পার্থক্যকে দৈনিক তাপমাত্রা পার্থক্য বলে। তবে গিনেস বুক অফ বিশ্বরেকর্ড অনুযায়ী দৈনিক তাপমাত্রা পার্থক্য অনুযায়ী আমেরিকার লোমা অঞ্চল বিশ্বের প্রথম, এখানে দৈনিক তাপমাত্রা পার্থক্য -৫৭.২ ডিগ্রি।
রাশিয়ার একবারে পূর্বপ্রান্তে অবস্থিত ইয়াকুটিয়া শাখা প্রজাতন্ত্রের অন্তর্ভুক্ত বিশ্বের সবচেয়ে বড় প্রশাসনিক উপকেন্দ্র। ইয়াকুটিয়া এতটাই বড় প্রদেশ যে এটা আয়তনে প্রায় ভারতের সমান। রাশিয়ার এই প্রদেশটি রাশিয়ার ১৮ শতাংশ সুতরাং গোটা রাশিয়া কত বড় সেটা একবার চিন্তা করুন। ইয়াকুটিয়া যদি আলাদা দেশ হত তাহলে ভারত ও আর্জেন্টিনার মাঝখানে এটা বিশ্বের অষ্টম বৃহত্তম দেশ হত। এটি এতটাই বড় প্রদেশ যে এর পূর্ব থেকে পশ্চিমে যেতে তিনবার টাইমজোন পরিবর্তন করতে হয়। রাশিয়ার এই বিশাল প্রদেশ প্রাকৃতিক সম্পদের ভান্ডার। এই অঞ্চলকে রাশিয়ার গুপ্তধনের সিন্ধুক ও বলা হয়। প্রাচীন সাইবেরিয়ান লোক কথা অনুযায়ী ধনসম্পদের দেবতা একবার পৃথিবী প্রদক্ষিন করছিল হাতে ধনসম্পদের বাক্স নিয়ে। যখন তিনি ইয়াকুটিয়া অঞ্চলের উপর দিয়ে যাচ্ছিলেন তখন অতিরিক্ত ঠান্ডায় তার হাত জমে যেতে থাকে। তখন তিনি ঠান্ডার থেকে রেহাই পেতে দুই হাত ঘসতে থাকে ফলে ধনসম্পদের বাক্স নীচে পড়ে যায়। যদিও এটা গল্পগাথা কিন্তু এই অঞ্চল বিশ্বের অন্যতম বিশাল খনিজ সম্পদের কেন্দ্র।
রাশিয়ার মোট হীরের ৮২ শতাংশ, সোনার ১৭ শতাংশ, ইউরেনিয়ামের ৬১ শতাংশ, অ্যান্টিমনির ৮২ শতাংশ, লোহা ও কয়লার ৫ শতাংশ, টিনের ২৮ শতাংশ ও পারদের ৮ শতাংশ এই অঞ্চল থেকেই পাওয়া যায়। বিশ্বের কোন ভূভাগ বা সমুদ্র যদি দুই বছরের বেশী সময় ধরে শূন্য ডিগ্রি তাপমাত্রায় থাকে তাহলে সেই বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে পুরু বরফের আচ্ছাদন তৈরি হয়ে যায়, এইসব অঞ্চলকে পার্মাফ্রস্ট বলে। ইয়াকুটিয়ার বেশীরভাগ অঞ্চলই পার্মাফ্রস্টে আচ্ছাদিত, যার নীচে প্রাচীন বিশ্বের কত রহস্যময় প্রানীর জীবাশ্ম রয়েছে তা হয়ত সময়ই বলবে। একসময় প্রাচীন ম্যামথের বিচরন কেন্দ্র ছিল এই অঞ্চল, যার কারনে বিশ্বের একমাত্র ম্যামথ মিউজিয়াম এখানেই রয়েছে। ইয়াকুটিয়ার রাজধানী ইয়াকুস্টককে বিশ্বের সবচেয়ে শীতল রাজধানী বলা হয়। গত জানুয়ারিতে এখানের তাপমাত্রা ছিল -৬২.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস! শীতকাল জুড়ে বরফের কুয়াশা ঘিরে থাকে এই শহরকে কারন ঘর গরমের কাজে ব্যবহৃত গ্যাস থেকে, রান্নার ফলে ও গাড়ি থেকে নির্গত গরম হাওয়া অত্যাধিক ঠান্ডায় শীতল বাষ্পে পরিনত হয়ে কুয়াশা তৈরি করে। এবার মনে হতে পারে ইয়াকুটিয়ায় এত ঠান্ডা কেন পড়ে? ভৌগলিক ভাবে ইয়াকুটিয়ার ৪০ শতাংশ অঞ্চল আর্কটিক এলাকার অন্তর্ভুক্ত। বিশ্বের সবচেয়ে শীতলতম স্থান হচ্ছে ওমিয়াকন যা ইয়াকুটিয়ারই একটি অঞ্চল। ইয়াকুট রূপকথা অনুযায়ী ঠান্ডার দেবতা ও পার্মাফ্রস্টের দেবতা চেস খান এই অঞ্চলে বাস করে, তাদের ঠান্ডা নিশ্বাসের কারনে এই অঞ্চল এত শীতল। ঠান্ডার দেবতা নীলাভ সাদা আচ্ছাদন পড়ে এবং শিং দেওয়া টুপি পড়ে। তবে রূপকথা যাই বলুক না কেন ভৌগলিক কারন অনুযায়ী আর্কটিক অঞ্চলে অবস্থিত হওয়ার জন্য এই অঞ্চলে সবসময় ঠান্ডা বিরাজমান রয়েছে।
আর্কটিক শব্দটি এসেছে আর্কটোস নামে গ্রীক শব্দ থেকে যার অর্থ ভাল্লুক। সোজা কথায় সুমেরু অঞ্চলকেই আর্কটিক অঞ্চল বলে। মহাকাশের উত্তরকোনে এক বিশেষ নক্ষত্রমন্ডলের আকৃতি ভাল্লুকের মতোন, তাই সেখান থেকে এই অঞ্চলের নাম আর্কটিক অঞ্চল। এই সুমেরু অঞ্চলের বরফাচ্ছাদিত সমুদ্রকে আর্কটিক মহাসাগর বলা হয়। এই আর্কটিক সাগরের কাছে আটটি দেশের অংশ রয়েছে রাশিয়া, আমেরিকা, ডেনমার্ক, নরওয়ে, সুইডেন, ফিনল্যান্ড, কানাড ও আইসল্যান্ড। সুতরাং স্বাভাবিক ভাবেই রাশিয়ার এই অঞ্চল ঠান্ডা। সমুদ্র থেকে দূরবর্তী স্থান বলে সামুদ্রিক হাওয়া ও আদ্রতার প্রভাব পড়েনা এখানে। এই অঞ্চলে কোন উঁচু পাহাড় না থাকায় উত্তর মেরু থেকে সরাসরি আসা ঠান্ডা হাওয়া আটকানোর কোন উপায় নেই যার কারনে উত্তর মেরুর থেকেও বেশী ঠান্ডা এখানে।
ওমিয়াকনে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা -৬৮ ডিগ্রি থেকে -৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত হয়ে যায়। এই তীব্র ঠান্ডায় যখন মানুষের হাইপারথার্মিয়া রোগ হওয়ার সম্ভবনা থাকে তখন এখানে বছরের পর বছর মানুষ বাস করে। তবে এখানকার জনজীবন খুবই কষ্টের। রেন ডিয়ারের চামড়া দিয়ে তৈরি জুতো ও পোষাক এখানকার মানুষদের প্রধান সম্বল। শরীরের একটু অংশ খোলা থাকলেই তা প্যারালাইজড হয়ে যাবার সম্ভবনা রয়েছে। বছরের বেশীরভাগ সময়ই বরফাচ্ছাদিত হওয়ার কারনে এখানকার মানুষদের প্রধান খাদ্য মাংস, মাছ, ঘোড়ার লিভার। কারন এখানে শাক সব্বজি হয়না বললেই চলে। ঘোড়ার রক্তের আইস কিউব এখানকার একটি জনপ্রিয় খাবার। সবসময় গ্যাসের প্রয়োজন ঘরে না হলে ঠান্ডায় মৃত্যু হবে মানুষের। যার কারনে এখানে জনবসতি খুব কম।
ভারতের মতোন আয়তনের এই বিশাল ভূভাগে মাত্র দশ লাখের মতোন লোক বাস করে। অর্থাৎ প্রতি তিন বর্গ কিলোমিটারে মাত্র একজন লোক বাস করে। যদি এটা ভারতের সাথে তুলনা করা হয় তাহলে ২০১১ সালের জনগননা অনুযায়ী দিল্লিতে প্রতি বর্গ কিলোমিটারে প্রায় দশহাজার লোক বাস করে সুতরাং বুঝতেই পারছেন এখানকার অবস্থা সম্পর্কে। ওমিয়াকনের অর্থ হচ্ছে বরফে জমে যাওয়া লেক। পৃথিবীর সবচেয়ে শীতলতম এই গ্রামের জনবসতি মাত্র ৫০০ জন। শীতকালে মাত্র চার-পাঁচ ঘন্টার জন্য সূর্য দেখা যায়, বাকী সময় অন্ধকারেই থাকে এই অঞ্চল। রাশিয়ার ইয়াকুটিয়া অঞ্চলে গাড়ির ইঞ্জিন সবসময় চালু রাখতে হয় কারন ইঞ্জিন বন্ধ হলেই পেট্রোল জমে যাবে। পেন ব্যবহার করা সম্ভব নয় এখানে কারন কালি জমে যাবে, সেজন্য এখানে মানুষ গ্রানাইটের পেন্সিল ব্যবহার করে। এখানে মরা মাছও মাত্র এক মিনিটে জমে যায়। পৃথিবীর সবচেয়ে শীতলতম এই অঞ্চলে জনজীবন কতদিন টিকে থাকে সেটাই এখন বড় প্রশ্ন কারন বিশ্বজুড়ে আবহাওয়া পরিবর্তনের প্রভাব এই অঞ্চলের উপরও যথেষ্ট পড়েছে। প্রতিবছর এখানে গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা যথেষ্ট বাড়ছে।