বিধ্বংসী কামান পরিচালনা করতে আশি জন লোক প্রয়োজন হত। জানুন বিস্তারিত
২৩ মার্চ, ১৯১৮ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় প্যারিসের এক জায়গায় হঠাৎই তীব্র বিস্ফোরন হয় যাতে আট জন লোকের মৃত্যু হয়। কিন্তু তদন্ত করেও এটা খুঁজে পাওয়া যায়নি যে ওই ঘটনার সাথে কারা জড়িত ছিল। এর ঠিক ছয়দিন পর ২৯ মার্চ সেন্ট গেরভিয়াস গীর্জায় তীব্র বিস্ফোরন হয়। এই ঘটনায় ৯১ জন লোকের মৃত্যু হয় এবং প্রায় একশোর বেশী লোক আহত হয়। দুটি ঘটনাই হয় কামান থেকে ছোঁড়া গোলা বিস্ফোরনে কিন্তু অনেক খুঁজেও সেই কামানটিকে পাওয়া যায়নি। লোকে এই ঘটনাকে জুলস গ্যাব্রিয়েল ভার্নের লেখা কল্পবিজ্ঞানের বই ফ্রম দি আর্থ টু মুনে লেখা কামানের সাথে তুলনা করতে শুরু করে। এই বইয়ে লেখা কাল্পনিক কামানের গোলা পৃথিবী থেকে চাঁদে আঘাত করতে পারতো। ১৯১৮ সালেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়, জার্মানদের পরাজয় হয়। এরপরই এই কামানের রহস্য উদ্ধার হয়। এই কামান তৈরি করেছিল জার্মানির ক্রপ নামে একটি অস্ত্র নির্মান সংস্থা। জার্মানি এর নাম দিয়েছিল উইলহেলাম গান, এর রেঞ্জ ছিল ১২৮ কিলোমিটার। এই কামানে তিন ফুট লম্বা গোলা ব্যবহার করা হত যা ৪২ কিলোমিটার পর্যন্ত উচ্চতায় যেতে পারতো। এই গান পরিচালনার জন্য আশি জন লোক লাগত এবং ট্রেনে করে এটিকে নিয়ে যাওয়া হত। ক্রপ এরকম তিনটি সুপার কামান তৈরি করেছিল। যুদ্ধের সময় ব্রিটেন ও ফ্রান্সের সেনা অনেক চেষ্টা করেছিল এই কামান ধ্বংস করতে কিন্তু তারা ব্যার্থ হয়। কিন্ত একটি কামান ফায়ারিং এর সময় বিস্ফোরনের কারনে নিজে থেকেই ধ্বংস হয়ে যায় যাতে পাঁচজন জার্মান সেনার মৃত্যু হয়। ১৯১৮ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর বাকী দুটি কামানের কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। বলা হয় জার্মানরা ওই দুটি কামান কোন গোপন জায়গায় লুকিয়ে রেখে দিয়েছে।
দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টার পরও বাকী দুটি সুপার গান না পাওয়া যাওয়ায় মোটামুটি এই ব্যাপারটা সবার মাথা থেকে সরেই গিয়েছিল। কিন্তু একজন ব্যাক্তি তখনও আরও শক্তিশালী সুপার গান তৈরির চেষ্টা করছিলো। ব্যাক্তিটির নাম ডঃ জেরাল্ড বুল। কানাডার অসাধারন মেধা সম্পন্ন এই ব্যাক্তি মাত্র ২৩ বছর বয়সেই দেশের সবচেয়ে কনিষ্ঠ ছাত্র ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করে কানাডার জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। তিনি স্বপ্ন দেখতেন ৩০০ মাইল রেঞ্জ বিশিষ্ট সুপার গান তৈরির। ১৯৬৫ সালে যখন তাঁর বয়স ৩৭ বছর তখন হঠাৎই তার কাছে এক জার্মান মহিলা আসেন দেখা করতে৷ ওই মহিলাটি তাঁকে একটি নকশা দেন, নকশাটা ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ের সেই বিখ্যাত জার্মান সুপার গানের। ডঃ জেরাল্ড চমকে যান তিনিও এই গানের ব্যাপারে শুনেছিলেন আগে। ওই মহিলাটি ক্রপ সংস্থাটির মালিকের পরিবারের সদস্য ছিল। তবে নকশা পেলেও এত বিশাল সুপারগান তৈরির জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। ডঃ জেরাল্ডকে অর্থ সাহায্য করতে শুরু করে আমেরিকা, কানাডা সরকার এবং তাঁরই বিশ্ববিদ্যালয়। প্রায় একশোর বেশী ইঞ্জিনিয়ার এই প্রজেক্টে কাজ করা শুরু করে।
ডঃ জেরাল্ড ৩৬ মিটার লম্বা ৪২৪ মিলিমিটার ক্যালিবারের একটি গান তৈরি করে যাতে তিনি গোলার বদলে ২০০ পাউন্ড ওজনের মিসাইল ব্যাবহার করবে বলে ঠিক করেন যার রেঞ্জ হবে প্রায় চার হাজার কিলোমিটার! ডঃ জেরাল্ডকে আমেরিকার সাম্মানিক নাগরিকত্বও দেওয়া হয়। এই প্রজেক্ট যখন প্রায় শেষের দিকে তখন হঠাৎই কোন অজানা কারনে আমেরিকা ও কানাডা সরকার এই প্রজেক্টে অর্থ সহায়তা করা বন্ধ করে দেয়। এই ঘটনায় তীব্র ক্ষুব্ধ হয় ডঃ জেরাল্ড বুল। তাঁর স্বপ্নই ছিল সুপার গান তৈরি করা সফলতার এত কাছাকাছি এসে তাঁর স্বপ্ন পূরন না হবার এই যন্ত্রনায় নিজের উপর নিয়ন্ত্রন হারিয়ে ফেলেন তিনি।
প্রতিশোধ নেবার জন্য তিনি সেসময়ে অত্যন্ত শক্তিশালী একটি আর্টিলারি গান তৈরির করে যার রেঞ্জ ৪০ কিলোমিটার। তিনি এই আর্টিলারি দক্ষিন আফ্রিকান সেনাবাহিনীকে বিক্রি করে দেন। সেসময় দক্ষিন আফ্রিকান সেনাবাহিনীকে কোন রকম অস্ত্র বিক্রি করতে জাতিসংঘ নিষেধ করেছিলো। ডঃ জেরাল্ড তা জানতো, তা সত্বেও তিনি ইচ্ছে করেই এই কাজ করেন। এমনকী তিনি দক্ষিন আফ্রিকান সেনাবাহিনীকে এই আর্টিলারি তৈরির লাইসেন্স পর্যন্ত দিয়ে দেন। দক্ষিন আফ্রিকান সেনাবাহিনী তার প্রতিবেশী শত্রু দেশ অ্যাঙ্গেলোর বিরুদ্ধে এই আর্টিলারি ব্যবহার করে। বলা হয় আমেরিকার গুপ্তচর সংস্থা সিআইএর এক এজেন্ট ডঃ জেরাল্ডের বন্ধু ছিল সেই তাঁকে সাহায্য করেছিল এই আর্টিলারি বিক্রি করতে। এই ঘটনা যখন প্রকাশ পায় জাতিসংঘের নির্দেশে আমেরিকায় গ্রেফতার করা হয় ডঃ জেরাল্ডকে এবং তাঁকে ছয় মাসের জন্য জেলে রাখা হয়। জেল থেকে ছাড়া পেয়েই তিনি কানাডা চলে আসেন কিন্তু কানাডা সরকার অবৈধ অস্ত্র ব্যাবসার জন্য তাঁকে পঞ্চাশ হাজার ডলার জরিমানা করে। প্রথমে জেল এবং পরে জরিমানা এই ঘটনায় এতটাই ক্ষুব্ধ হয় ডঃ জেরাল্ড তিনি কানাডা ত্যাগ করে বেলজিয়াম চলে যান, সেখানে ইউনাইটেড গান পাওয়ার ওয়ার্কস নামক সংস্থার সাথে যৌথভাবে একটি সংস্থা তৈরি করেন। কিন্তু তা সত্বেও ডঃ জেরাল্ড তাঁর স্বপ্ন সুপার গান তৈরির কথা কিছুতেই ভুলতে পারছিলোনা। যার কারনে তিনি তাঁর স্বপ্নের প্রজেক্টের জন্য অর্থ সাহায্যকারী খুঁজতে শুরু করে।
১৯৭৯ সালের এই সময়ে মধ্য প্রাচ্যে ইরাক ও ইরানের যুদ্ধ শুরু হয়। ডঃ জেরাল্ড ইরাকের শাসক সাদ্দাম হোসেনের থেকে সাহায্য চাইবে ঠিক করে। যার কারনে ২০০ বিশেষ বন্দুক তিনি জর্ডানের আকাবা বন্দর হয়ে সাদ্দাম হোসেনকে উপহার পাঠান। এদিকে সাদ্দাম হোসেন সেসময় ইসরায়েলের উপর ক্ষুব্ধ ছিল কারন ইসরায়েল বায়ুসেনা ইরাকের পরমানু কার্যক্রমকে ধ্বংস করে দেয় যা সাদ্দাম হোসেনের দীর্ঘ দিনের স্বপ্ন ছিল। আবার ইসরায়েল এই সময়ে মহাকাশে স্যাটেলাইট লঞ্চও শুরু করে। যার কারনে তীব্র ক্ষুব্ধ সাদ্দাম হোসেন সাথে সাথে ডঃ জেরাল্ডের সাথে বৈঠক করে। ডঃ জেরাল্ড সাদ্দাম হোসেনকে জানায় সে দেড়শো মিটার লম্বা, ২১০০ টন ওজনের এবং এক মিটার ক্যালিবারের একটি সুপার গান তৈরি করবে যার রেঞ্জ হবে এক হাজার কিলোমিটার। এই গান স্যাটেলাইট লঞ্চ করতেও সক্ষম হবে। ডঃ জেরাল্ড এই প্রজেক্টের নাম দিয়েছিল প্রজেক্ট ব্যাবিলন। এই খবর শুনে সাদ্দাম হোসেন ভেবে নেয় এই গান দিয়ে সে ইসরায়েলে আক্রমন করবে, যার কারনে যে কোনও ধরনের সাহায্যের জন্য সাদ্দাম হোসেন রাজি হয়ে যায়।
ডঃ জেরাল্ড প্রথমে একটি প্রোটোটাইপ ছোট আর্টিলারি তৈরি করে যার নাম দেওয়া হয় বেবী ব্যাবিলন। ৪৫ মিটার লম্বা এই গান ১৯১৮ সালে জার্মানির তৈরি সুপারগানের থেকেও ঘাতক ছিল। ইরাকের মরুভূমিতে যখন এর পরীক্ষা হয় সাদ্দাম হোসেনের সেনাবাহিনীর প্রধান পর্যন্ত স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল কারন এই গানের কার্যকারিতা যতটা অনুমান করা হয়েছিল তার থেকেও ঘাতক ছিল। এরপর ডঃ জেরাল্ড বুল প্রধান প্রজেক্ট ব্যাবিলন শুরু করে। এই প্রজেক্টের জন্য সমস্ত যন্ত্রপাতি ব্রিটেন, স্পেন, নেদারল্যান্ডস, সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন সংস্থার থেকে কিনছিলো ইরাক। সেসময় ইরাকের উপর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা ছিল যার কারনে তেলের পাইপলাইন প্রজেক্টের ছদ্দবেশে জর্ডান হয়ে এসব জিনিস ইরাকে পৌঁছাছিল। ইরাক জলের মতোন পয়সা খরচ করছিলো। ইতিমধ্যেই ইরাক ইরান যুদ্ধে ডঃ জেরাল্ডের কিছু বন্দুক যথেষ্ট ধ্বংসলীলা চালিয়েছে। ডঃ জেরাল্ডের এই প্রজেক্টের খবর ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ, আমেরিকার সিআইএ এবং ব্রিটেনের এমআইসিক্সের কাছেও ছিল। ইসরায়েল ডঃ জেরাল্ডকে বহুবার বোঝায় এই প্রজেক্ট না করতে কিন্তু ডঃ জেরাল্ড শোনেনি। ইসরায়েল ইরাকে ডঃ জেরাল্ড বুলের ঘরে পর্যন্ত এজেন্ট পাঠিয়ে দেয় তাও ডঃ জেরাল্ড এই প্রজেক্ট বন্ধ করেনি উপরন্ত দ্বিগুন গতিতে কাজ শুরু করে। বাধ্য হয়ে মোসাদ তাদের অপারেশন শুরু করে।
১৯৯০ সালের ২২ মার্চ ডঃ জেরাল্ড বুল যখন কাজ শেষ করে ঘরে ফিরে আসে তখন হঠাৎই মোসাদের এক এজেন্ট সামনে থেকে তাঁর উপর পাঁচ রাউন্ড গুলি করে যাতে ঘটনাস্থলেই তাঁর মৃত্যু হয়। এই ঘটনার পর ইসরায়েলের মেসাদের ভয়ে এই প্রজেক্টে যুক্ত থাকা বাকী ইঞ্জিনিয়াররাও প্রজেক্ট ছেড়ে পালিয়ে যায়। ১৯৯১ সালে গল্ফ যুদ্ধের পর সরকারি ভাবে ইরাক এই সুপারগান তৈরিতে কথা স্বীকার করে।
জাতিসংঘের প্রতিনিধিরা এই প্রজেক্টের গুরুত্বপূর্ন অংশ নিয়ে চলে যায় এবং প্রজেক্ট ধ্বংস করে দিয়ে যায়। ২০০৩ সালে আমেরিকান সেনা ইরাকে গিয়ে ডঃ জেরাল্ডের এই অসম্পূর্ন প্রজেক্টের ধ্বংসাবশেষ পায়।