অফবিট

মানুষের মাথা শিকার করা ভারতবর্ষের এক বিশেষ উপজাতির সংস্কৃতির অংশ

প্রায় ১৩৫ কোটি জনসংখ্যার দেশ ভারতবর্ষে বিভিন্ন জাতি ও ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের মানুষ রয়েছে। ২০১১ এর জনগননা অনুযায়ী ভারতে প্রায় ৭০০ এর বেশী উপজাতি রয়েছে যা ভারতের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৮.৬ শতাংশ। এই প্রত্যেকটি উপজাতি সম্প্রদায়ের নিজস্ব নিজস্ব প্রথা রয়েছে যা ভারতের বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্যকেই বোঝায়। কিন্তু জানেনকী এইসব উপজাতি সম্প্রদায়ের মধ্যে এমনও একটি উপজাতি আছে যাদের কাজ মানুষের মাথা শিকার করা, এটা তাদের সংস্কৃতির অংশ। এই উপজাতির মানুষদের দেখা গেছে ঘরের মধ্যে মানুষের খুলির সম্ভার রয়েছে। এই উপজাতি সম্প্রদায় সম্পর্কেই বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।

উত্তর পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলোতেই বিভিন্ন উপজাতি সম্প্রদায়ের সংখ্যা বেশী দেখা যায়। তবে এখন যে উপজাতি সম্প্রদায় সম্পর্কে বলা হবে তার নাম নাগা উপজাতি, যারা সাধারনত নাগাল্যান্ড ও তার আশপাশের রাজ্য গুলোর কিছু অংশে থাকে। নাগা উপজাতি সম্পর্কে প্রথমে জানা দরকার। নাগা শব্দটির সঠিক উৎপত্তি নিয়ে দ্বিধা রয়েছে। একটি ধারনা অনুযায়ী নাগ শব্দের অর্থ সাপ, অর্থাৎ যারা সাপের পূজো করে তারাই নাগা কিন্তু আরও একটি ধারনা অনুযায়ী সংস্কৃত ভাষায় নাগা শব্দের অর্থ পর্বত, তাই যারা পর্বতে বসবাস করে তাদেরই নাগা বলা হয়। নাগাল্যান্ড রাজ্য নাগাদের মূল বসবাস স্থান হলেও, মনিপুর, আসাম, মিজোরাম, অরুনাচল প্রদেশ, মেঘালয় এবং মায়ানমারের স্যাগিং ও ক্যাচিন প্রদেশ এবং নাগা স্লেফ অ্যাডমিনিস্ট্রেডেড জোনে বেশ কিছু নাগা সম্প্রদায়ের লোক থাকে। প্রায় ৩০ লাখ নাগা জনগোষ্ঠী রয়েছে ভারত ও মায়ানমারে, যার মধ্যে নাগাল্যান্ডেই থাকে প্রায় ষোলো লাখ মানুষ৷ বর্তমানে এদের প্রধান ধর্ম খ্রীষ্টান। নাগাল্যান্ড পুরো একটি পার্বত্যময় ভূমি। ভারতীয় নাগা ও মায়নামারের নাগা সম্প্রদায়ের মধ্যে সাংস্কৃতিক ভাবে যথেষ্ট মিল রয়েছে। মধ্যযুগীয় ভারতে প্রথম নাগাদের উল্লেখ পাওয়া যায় অহম সাম্রাজ্যের সময়ে। আসামে ব্রহ্মপুত্র নদীর তীরে ১২২৮ সালে অহম সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যা ছয়শো বছর ধরে রাজত্ব করেছিল। এই অহম সাম্রাজ্যই উত্তর পূর্ব ভারতে মুঘল আক্রমনকে পরাজিত করেছিল। 

নাগারা সাধারনত বাকী বিশ্বের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকত। তবে উনিশ শতকের পর থেকে পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়। ১৮১৭ সালে বার্মা এবং পরে ব্রিটিশদের অধীনে আসে নাগারা। নাগা উপজাতি একটি খুবই বড় সম্প্রদায়, তবে বিভিন্ন নাগা গ্রামে ভিন্ন ভিন্ন ছোট ছোট সহ সম্প্রদায় থাকে যারা নাগা উপজাতিরই অংশ কিন্তু আলাদা আলাদা সংগঠন। রেংমা, লোথা, আঙ্গামি, আও, কোনিয়াক এরকম অনেক নাগা উপজাতি আছে। যারা সবই নাগা উপজাতির কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন গোষ্ঠী। এইসব নাগা সংগঠন গুলোর রীতিনীতি ভিন্ন হলেও এদের মধ্যে একটা প্রথায় মিল ছিল তা হল মানুষের মাথা সংগ্রহ। নাগা উপজাতিতে এই প্রথাকে বীরত্বের প্রতীক হিসাবে মনে করা হত। ক্রিকেট, ফুটবল, অলিম্পিক বা যে কোন প্রতিযোগিতায় যেমন খেলার শেষে বিজয়ী দলকে পুরস্কার হিসাবে ট্রফি দেওয়া হয় যা দলটির বিজয়ের প্রতীক, ঠিক তেমনি নাগা উপজাতিরা মাথা সংগ্রহকে তাদের বীরত্ব ও পুরুষার্থের প্রতীক হিসাবে মানত। নাগা উপজাতিরা তাদের শত্রুকে হত্যা করে ধারালো অস্ত্র দিয়ে তার মাথা কেটে নিয়ে আসত যাতে সম্প্রদায়ের বাকি লোকরা তাকে সম্মান করত। সেইসব মাথা তারা তাদের ছোট ছোট ঝোপের বাড়ির সামনে ঝুলিয়ে রাখত বীরত্বের নিদর্শন হিসাবে। এরপর তারা তাদের জাতীয় পোশাক পড়ে নাগা নাচ, অনুষ্ঠান করত বিজয়ের উল্লাস প্রকাশের জন্য। যার কাছে যত মাথা তার তত সম্মান। উত্তর পূর্বের বিভিন্ন রাজ্যের উপজাতিদের মধ্যে শত্রুতা ছিল একটা সময়, সেজন্য কোন উপজাতির মানুষ অন্য কোন রাজ্যে কোনও কারনে যাওয়ার সময় খুবই সতর্ক ভাবে যেত, যাতে শত্রু উপজাতির কেউ হামলা না করে দেয়। এই প্রথা নাগা উপজাতিদের মধ্যে কবে থেকে শুরু হয়েছে তার কোনও সুস্পষ্ট তথ্য নেই৷ ভারতে ইউরোপীয়ানদের আগমনের পর থেকে বিশেষ করে ব্রিটিশদের সময়ে যখন এসব অঞ্চলের সাথে যোগাযোগ স্থাপন হয় তখন ধীর ধীরে এই প্রথা কমে যায়। তবে ভারত স্বাধীন হবার পরও এই প্রথা চলছিল। ১৯৬০ সালে ভারত সরকার এই প্রথা নিষিদ্ধ করে দেয়, তবে তারপরেও এই প্রথা অল্প হলেও চলত। কোনিয়াক নাগা উপজাতি শেষ কোনও নাগা সম্প্রদায় যারা এই প্রথা পালন করত। এখন বর্তমানে এই প্রথা বন্ধ হয়ে গেছে। তবে নাগাল্যান্ডে প্রতিবছর ১-১০ ডিসেম্বরে হর্নবিল উৎসব হয়, যা নাগাল্যান্ড সরকার আয়োজন করে, এই উৎসবে সমস্ত নাগা উপজাতির প্রাচীন সব প্রথা প্রদর্শন হয়। এখানে মানুষের মাথা শিকারের প্রথাও দেখানো হয়। ২০০০ সাল থেকে শুরু হওয়া এই হর্নবিল উৎসবে দেশ বিদেশ থেকে বহু লোক আসে। নাগাল্যান্ডের রাজধানী কোহিমাতে এই অনুষ্ঠান হয়। এই অনুষ্ঠানে কিছু কিছু নাগা মানুষের গলার হাড়ে ব্রোঞ্জের মাথা দেখা যায়, কারও হারে তিনটে, কারও পাঁচটা মাথা এমন রয়েছে। আসলে তারা যে পরিবারের সেই পরিবার এককালে কতগুলো মাথা শিকার করেছে এটা তার প্রতীক।

ক্রিস্টোফার হাইমেনডর্ফ নামে একজন অস্ট্রিয়ান নৃতত্ত্ববিদ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ভারতে আসেন। তিনি অন্ধ্রপ্রদেশ, হায়দ্রাবাদ, অরুনাচল প্রদেশ এবং নাগাল্যান্ডের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর উপর গবেষনা করে তিনটি বই লেখেন। ১৯৩৯ সালে তার প্রথম বই প্রকাশিত হয় দি নেকেড নাগা, ১৯৬৯ সালে প্রকাশিত হয় কোনিয়াক নাগা, ১৯৬২ সালে প্রকাশিত হয় অ্যাপাতানিস যা অরুনাচলের উপজাতিদের সম্পর্কে ছিল৷ এরপর ১৯৭৬ সালে তিনি আবারও ভারতে আসেন এবং নাগাল্যান্ডে যান। এই বছর তিনি লেখেন দি রিটার্ন অফ নেকেড নাগা। নাগা সম্প্রদায় সম্পর্কে অনেক তথ্য এসব বইয়ে পাওয়া যায়, মানুষের মাথা শিকার করার প্রথা সম্পর্কেও এখানে লেখা আছে। তবে এই প্রাচীন প্রথা ছাড়াও নাগাল্যান্ড ভারতের অত্যন্ত সুন্দর একটি প্রদেশ। নাগাল্যান্ডকে উৎসবের শহরও বলা হয়। প্রকৃতি যেন তার সমস্ত সৌন্দর্য এখানে উজার করে দিয়েছে। ১ ডিসেম্বর, ১৯৬৩ ষোলোতম রাজ্য হিসাবে ভারতে যুক্ত হয় নাগাল্যান্ড। পুরো নাগাল্যান্ড জুড়ে প্রায় একশোর উপর জনজাতি থাকে। তবে এসব শুনে কেউ যদি ভাবে নাগাল্যান্ডে শিক্ষার দিক থেকে পিছিয়ে তাহলে সেটা ভুল ধারনা, নাগাল্যান্ডে শিক্ষার হার ৮৫ শতাংশ যা ভারতের বেশ কিছু রাজ্যের থেকেও বেশী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *