অফবিট

ভারতবর্ষের একমাত্র হিন্দু সম্রাট যে আরব জয় করেছিলেন

ভারতবর্ষের ইতিহাসে অনেক মহান রাজা ও অনেক মহান সম্রাট রাজত্ব করেছে। তৎকালীন সময়ের গ্রন্থ, শিলালিপি কিংবা মাটি খুঁড়ে পাওয়া স্থাপত্যকার্য থেকে আমরা তাদের ইতিহাস জেনেছি, কিন্তু ভারতবর্ষের ইতিহাসে এমন এক কিংবদন্তি রাজা ছিল যার সাম্রাজ্য পুরো এশিয়া মহাদেশ জুড়ে বিস্তৃত ছিল। এনার নাম মহারাজ চক্রবর্তী সম্রাট বিক্রমাদিত্য। কিন্তু এনার ব্যাপারে সুস্পষ্ট তেমন কোন তথ্যই ইতিহাসে পাওয়া যায়না। বলা হয় নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্রমাদিত্য সম্পর্কে সম্পূর্ণ তথ্যই ছিল কিন্তু বখতিয়ার খলজি নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস করে লাইব্রেরি জ্বালিয়ে দেয় যার কারনে বিক্রমাদিত্য সম্পর্কে অনেক তথ্যই অজানা থেকে যায়। গুপ্ত সাম্রাজ্যের শাসক দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত বা বিক্রমাদিত্যের সঙ্গে অনেকে বিক্রমাদিত্যের শাসনকালকে মিশিয়ে কিন্তু দুজন আলাদা ব্যাক্তি। গুপ্তসম্রাট সমুদ্রগুপ্তের পুত্র ছিল দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্য কিন্তু কিংবদন্তি বিক্রমাদিত্যের শাসনকাল আরও পুরোনো ছিল। ৩২ সিংহাসন, বিক্রম বেতালের গল্প এই বিক্রমাদিত্যের সাথেই যুক্ত। ভারতের ইতিহাসে কিংবদন্তি বিক্রমাদিত্য সম্পর্কেই বিস্তারিত আলোচনা করা হবে। বিক্রমাদিত্যের ইতিহাস কাল্পনিক নাকী সত্যি সে ব্যাপারেও আলোকপাত করা হবে।

প্রাচীন ভারতের উজ্জয়নীর মহান শাসক এই বিক্রমাদিত্যের আরেকনাম বিক্রমসেন। শকদেরকে পরাজিত করে বিক্রমাদিত্য বিক্রমা সমবাত নামক ক্যালেন্ডারও চালু করেছিল যা আজও নেপালে মানা হয়। ৫৭ বিসিইতে(BCE) তিনি শকদের পরাজিত করেছিলেন। বিক্রমা সমবাত অনুসারে এখন ২০৭৯ সাল। বলা হয় তার মহান পরাক্রমে অনুপ্রানিত হয়েই দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্য উপাধি নিয়েছিলেন, এছাড়াও ভারতে আরও চোদ্দ জন রাজার নাম পাওয়া যায় যারা বিক্রমাদিত্য উপাধি নিয়েছিলেন। ওনার জন্মকাল সম্পর্কে বলা হয় কলিযুগের ৩০০০ বছর পর অর্থাৎ ১০২ বিসিইতে ওনার জন্ম হয়েছিল উজ্জয়নীতে এবং তিনি একশো বছর রাজত্ব করেছেন। হিন্দু ধর্ম অনুসারে সময়কে চার ভাগে ভাগ করা হয়েছে সত্য যুগ, ত্রেতা যুগ, দ্বাপর যুগ ও কলি যুগ।

হিন্দু যুগ সময় অনুযায়ী কলি যুগের সূচনা হয়েছে আজ থেকে প্রায় ৫১২৪ বছর আগে অর্থাৎ এই হিসাবে বিক্রমাদিত্যের জন্ম হয়েছিল আজ থেকে প্রায় ২১২৪ বছর আগে। বিক্রমাদিত্য শব্দটির সন্ধিবিচ্ছেদ করলে হয় বিক্রম + আদিত্য। আদিত্য শব্দের অর্থ সূর্য, যিনি সূর্যের মতোন প্রতাপশালী তাকেই বিক্রমাদিত্য বলা হয়। তিনি খুবই উদার ও প্রজাপালক শাসক ছিলেন, তিনি প্রায়ই ছদ্মবেশে রাজ্যে ঘুরে বেড়াতেন প্রজাদের সমস্যা বোঝবার জন্য। ওনার বাবার নাম ছিল গন্ধর্বসেন এবং মাতার নাম ছিল সোম্যা দর্শনা। ওনার এক ভাই ও এক বোন ছিল, ভর্তৃহরি ও মৈনাদেবী। মধ্যপ্রদেশে গন্ধর্বসেনের মন্দিরও রয়েছে। মহেসরা সুরী নামে এক জৈন সাধুর থেকে জানা যায় গন্ধর্বসেনকে যুদ্ধে পরাজিত করে শকরা কিছুদিন জেলে বন্দি রাখার পর জঙ্গলে গন্ধর্বসেনকে ছেড়ে দেওয়া হয়, সেখানেই হিংস্র পশুদের হাতে মৃত্যু হয় গন্ধর্বসেনের। সেই থেকেই বিক্রমাদিত্য প্রতিজ্ঞা নিয়েছিলেন তার বাবার মৃত্যুর প্রতিশোধ নেবে। বিক্রমাদিত্যের পরিবার সম্পর্কে যতটুকু জানা যায় ওনার পাঁচ স্ত্রী, দুই ছেলে ও দুই মেয়ে ছিল। সমগ্র ভারতবর্ষ জুড়েই হিন্দি, মারাঠি, তামিল, সংস্কৃত বিভিন্ন ভাষায় বিক্রমাদিত্য সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য পাওয়া যায়। যার মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হচ্ছে বিক্রম বেতালের কাহিনী যার উপর বেশ কিছু টিভি সিরিয়ালও হয়েছে। বিক্রমাদিত্য সম্পর্কে আরও একটি জনপ্রিয় গল্প আছে তা হচ্ছে সিংহাসন ৩২। বিক্রমাদিত্যের পরাক্রমে মুগ্ধ হয়ে স্বর্গের রাজা দেবরাজ ইন্দ্র একবার বিক্রমাদিত্যকে স্বর্গে আমন্ত্রন করেন। দেবরাজ ইন্দ্র বিক্রমাদিত্যের বুদ্ধিকে পরীক্ষা করবার জন্য তিনি একটি কঠিন কাজ দেন তাঁকে। দেবরাজ ইন্দ্রের সভার দুজন বিখ্যাত নর্তকী হচ্ছে উর্বশী ও রম্ভা। এদের মধ্যে কে সর্বশ্রেষ্ঠ তা নিয়েই বিরোধীতা ছিল, দেবরাজ ইন্দ্র তা নির্নয় করার দায়িত্ব বিক্রমাদিত্যকে দেয়। বিক্রমাদিত্য একটি ফুলের গুচ্ছে একটি বিছেকে লুকিয়ে রেখে সেই গুচ্ছটি তাদের দিয়ে বলে একবারও না ফেলে ফুলের গুচ্ছটি হাতে নিয়ে নাচতে হবে। রম্ভা প্রথমে নাচতে শুরু করে কিন্তু কিচ্ছুক্ষন পর রম্ভার হাতে বিছে কামড়ানোয় সে সেটা ফেলে দেয়, এরপর আসে উর্বশী। উর্বশী এত ভালোভাবে নৃত্যকলা প্রদশর্ন করে যে বিছে তাকে কামড়াতেই পারে নি। সুতরাং এইভাবে প্রমানিত হয় উর্বশী শ্রেষ্ঠ।

বিক্রমাদিত্যের এই কাজে প্রভাবিত হয়ে দেবরাজ ইন্দ্র তাঁকে বত্রিশটি মূর্তি উপহার দেয় যারা বলতে পারত। আসলে এগুলো অভিশপ্ত মূর্তি ছিল, কোন মহান রাজার বুদ্ধিমত্তাই তাদের শাপমুক্ত করতে পারত। এই ৩২ টি মূর্তি বিক্রমাদিত্য তার সিংহাসনে যুক্ত করেছিল সেই থেকেই সিংহাসন ৩২ এর প্রচার হয়। এখানে রাজা ভোজের কোথাও উল্লেখ আছে। যে অনেক পরে এগারো শতকে উজ্জয়নীর রাজা হয়েছিল। রাজা ভোজ সম্পর্কে বলা হয় তিনিও বিক্রমাদিত্যের মতোনই ন্যায় প্রিয় ছিল, তিনি খননকার্যের সময় বিক্রমাদিত্যের ৩২ সিংহাসন পেয়েছিলেন। ব্যাপারটা ছিল এইরকম যে রাজা ভোজের রাজ্যে চন্দ্রভান নামে একজন সত, গরীব গোয়ালা ছিল যে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে যে কোনও সমস্যার সঠিক বিচার করত একটি ঢিবির উপর দাঁড়িয়ে। এটা দেখে রাজা ভোজ খুবই অবাক হয়েছিলেন এবং এই বিষয়ে চন্দ্রভানকে জিজ্ঞেস করায় সে বলে সে নাকী কিছু জানেনা, ঢিবির উপর দাঁড়ালেই সে সব কিছু বুঝতে পারে। রাজা ভোজ সেই ঢিবি খনন করলে সেখানে এই সিংহাসনটা খুঁজে পান তিনি। সিংহাসনে পরিচ্ছন্ন করে তাতে বসতে গেলে ৩২ টি মূর্তি বলে ওঠে এটা মহান রাজা বিক্রমাদিত্যের সিংহাসন এখানে বসতে গেলে পরীক্ষা দিতে হবে৷ প্রতিদিন একটি করে পুতুল রাজা বিক্রমাদিত্য সম্পর্কে একটি করে গল্প বলতো এবং শেষে একটি প্রশ্ন করত, এভাবে প্রতিটি পুতুলের প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিয়েছিল রাজা ভোজ এবং তার পরেই সিংহাসনে বসার অনুমতি পেয়েছিলেন তিনি।

বিক্রমাদিত্যকে কেন্দ্র করে সবচেয়ে জনপ্রিয় গল্প হচ্ছে বিক্রম বেতাল বা বেতাল পঁচিশ। এর প্রধান বিষয় ছিল এক সাধু বিক্রমাদিত্যকে একবার প্রানে বাঁচিয়েছিল এবং তার ঋন পরিশোধ করবার জন্য সে বিক্রমাদিত্যকে নির্দেশ দিয়েছিল জঙ্গলের একটি বিশেষ গাছ থেকে একটি বেতালকে ধরে আনতে কিন্তু কোন কথা বলা যাবে না কারন কথা বললেই বেতাল আবার আগের জায়গায় ফিরে যাবে। বেতাল অর্থাৎ একটি বিশেষ অশরীরি শক্তি। বিক্রমাদিত্য বেতালকে ধরে কিন্তু বেতাল শর্ত দেয় সে তাকে একটি করে গল্প বলবে এবং গল্পের শেষে একটি প্রশ্ন থাকবে, যদি বিক্রমাদিত্য সঠিক উত্তর দিতে না পারে তাহলে তার মাথা ফেটে সেখানেই মারা যাবে। এভাবে পঁচিশ বার বেতাল একটি করে গল্প বলে এবং বিক্রমাদিত্য প্রতিবারই সঠিক উত্তর দেয়, ফলে বেতাল বারবার পূর্বের গাছে ফিরে যায়। একাধিক জৈন গ্রন্থ ও তামিল গ্রন্থেও বিক্রমাদিত্যের নাম পাওয়া যায়। তামিল সূত্র অনুযায়ী বিক্রমাদিত্যের শরীরে ৩২ টি দাগ ছিল, তিনি চক্রবর্তী সম্রাট হবার জন্য কাঞ্চিপুরমের কামঅক্ষি দেবীর কাছে নিজের মাথা কেটে অর্পন করবার সংকল্প করেছিলেন, তখন দেবী দর্শন দিয়ে তাকে বলেন তার ভক্তিতে তিনি খুশী হয়েছেন এবং তিনি তাঁকে মহান চক্রবর্তী সম্রাট হবার আশীর্বাদ দেন।

ভারতের ইতিহাসে মহান সম্রাট হিসাবে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য, অশোক, মহারানা প্রতাপ, বাপ্পা রাওয়াল, ছত্রপতি শিবাজি সহ একাধিক রাজার নাম পাওয়া যায় কিন্তু বিক্রমাদিত্য সম্পর্কে ততটা উল্লেখ করা হয়না। বরং বিক্রমাদিত্যকে একজন কাল্পনিক রাজা হিসাবে তুলে ধরা হয়। কিন্তু বাস্তবে বিক্রমাদিত্য ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্রাট ছিল যার সাম্রাজ্য ইন্দোনেশিয়া থেকে শুরু করে রাশিয়া, চীন হয়ে আরব পর্যন্ত পুরো এশিয়া মহাদেশ জুড়ে বিস্তৃত ছিল। বিক্রমাদিত্যের ভাই ভর্তৃহরির নাম বারবার বহু হিন্দু শাস্ত্রে পাওয়া যায় যিনি প্রথমে শাসক ছিলেন পরে সংসার ত্যাগ করে মহান সন্ন্যাসী হন, সেখান থেকেই বিক্রমাদিত্যেরও তথ্য পাওয়া যায়। একসময় মানুষ রামায়ন ও মহাভারতকেও কাল্পনিক বলেছিল কিন্তু রামসেতু এবং সমুদ্রের নীচে পাঁচ হাজার বছরের পুরোনো ভগ্ন দ্বারকা নগরীর ধ্বংসাবশেষ পাওয়া যাওয়ায় তা সবাইকে চুপ করিয়ে দিয়েছে। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংসের সাথে সাথে কিংবদন্তি শাসক বিক্রমাদিত্য সম্পর্কে অনেক তথ্যই হারিয়ে যায়। বিক্রমাদিত্যই প্রথম কোন ভারতীয় হিন্দু সম্রাট যিনি আরব বিজয় করেছিলেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *