ঘানায় গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক তৈরি করতে ভারতীয় গোয়েন্দারা যা করেছিল
পশ্চিম আফ্রিকার একটি দেশ ঘানা, যে দেশটি সবসময় অর্থনৈতিক সমস্যা ও রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যেই থাকে। ১৯৫৭ সালে ভারত ও ঘানার মধ্যে নতুন ভাবে কুটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে ওঠার প্রক্রিয়া শুরু হয়, যার নেপথ্যে ছিল ইনটেলিজেন্স ব্যুরো বা আইবি। ১৯৫৭ সালে লন্ডনে কমনওয়েলথ প্রধানমন্ত্রীদের বৈঠকে যান তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু। তার সাথে লন্ডনে যান রামেশ্বর নাথ কাও বা আর এন কাও। রামেশ্বর নাথ কাওই পরে ভারতের ইনটেলিজেন্স সংস্থা র এর প্রধান হন। তিনি সেসময় জওহরলাল নেহরুর নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন। লন্ডনে জওহরলাল নেহরুর সাথে বৈঠক হয় ঘানার প্রধানমন্ত্রী কোয়ামে নকরোমার সাথে। এই বৈঠকে ঘানার প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর কাছে অনুরোধ করেন ঘানার ইনটেলিজেন্স সংস্থাকে মজবুত করতে সাহায্য করার জন্য। সেসময় ঘানার ইনটেলিজেন্স সংস্থা খুবই দুর্বল ছিল, বলতে গেলে সংস্থা না থাকারই সমান ছিল। ঘানার প্রধানমন্ত্রীর এই অনুরোধের কারনে আর এন কাও এর হাতে আসতে চলেছিল এমন এক দায়িত্ব যা ভবিষ্যতে পশ্চিম আফ্রিকার দেশটির সাথে ভারতের কুটনৈতিক সম্পর্ক মজবুত করবে।
আইবির উপর দায়িত্ব দেওয়া হয় ঘানায় ইনটেলিজেন্স নেটওয়ার্ক তৈরি করার জন্য। আইবির প্রধান বি এন মুল্লিক এর সাথে ঘানার প্রধানমন্ত্রীর সেক্রেটারির কথা হয় এই বিষয়ে। অক্টোবর, ১৯৫৭ সালে ঘানার প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুকে একটি চিঠি লিখে সরকারি ভাবে তিনি অনুরোধ করেন ভারত সরকারের সহয়তার জন্য। তিনি অনুরোধ করেন দুজন ব্যাক্তিকে পাঠাবেন যাদের আইবি প্রশিক্ষন দেবে ঘানায়। জওহরলাল নেহরু জবাবে জানান ভারত সরকার ঘানাকে পূর্ন সহযোগীতা করবে। এরপর আইবির সাথে একটি বৈঠক করেন জওহরলাল নেহরু, সেখানে বি এন মুল্লিক একটি পরিকল্পনা তৈরি করেন ঘানার জন্য। ঘানার ইনটেলিজেন্স নেটওয়ার্ক তৈরিকে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়। ঠিক করা হয় প্রথমে বি এন মুল্লিক নিজে যাবেন ঘানায়, সেখানে দুই, তিন সপ্তাহ থেকে পুরো পরিস্থিতি দেখবেন। এরপর ঘানার দুই, তিনজন দক্ষ অফিসারকে ভারতে প্রশিক্ষন দেওয়া হবে। পরবর্তী ধাপে একজন বিশেষ ভারতীয় অফিসার ঘানায় গিয়ে ঘানার অফিসারদের প্রশিক্ষন দেবে। একজন ভারতীয় অফিসার এক বছর ঘানায় থাকবে প্রশিক্ষন দেওয়ার জন্য। এই সময়ে ঘানায় হওয়া সমস্ত অপারেশন এই ভারতীয় অফিসারের নেতৃত্বেই হবে। বি এন মুল্লিক প্রথমে রামেশ্বর নাথ কাওকে বলেন ঘানায় গিয়ে পুরো পরিস্থিতি দেখে আসতে, তারপর তিনি যাবেন।
১৯৫৮ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে আর এন কাও ঘানায় পৌঁছান। কিন্তু ঘানায় পৌঁছে তিনি একটি অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ্য করেন যে সেসময় ঘানার নিরাপত্তার দায়িত্বে আছে ইংল্যান্ড। ঘানা সরকারের পদক্ষেপকে ইংল্যান্ড সমর্থন করছে কিন্তু কোথাও যেন ইংল্যান্ড অখুশী ভারতের ঘানাকে সাহায্য করার বিষয়ে। তাছাড়া ইংল্যান্ড ঘানার সহযোগী হওয়া সত্বেও ঘানা ইংল্যান্ডের বদলে ভারতের কাছে কেন সাহায্য চাইছে এই ব্যাপারটাও অবাক করে আর এন কাওকে। ঘানাতে নিজের কাজ সম্পন্ন করে আর এন কাও ভারতে ফিরে আসেন এবং বি এন মুল্লিককে সব তথ্য জানান। এবার পরিকল্পনা অনুযায়ী বি এন মুল্লিক এর ঘানায় যাবার কথা ছিল দুই তিন সপ্তাহের জন্য কিন্তু বিশেষ কিছু কারনে বি এন মুল্লিকের কোনওদিন ঘানা যাওয়াই হয়নি। ফলে পরিকল্পনার প্রথম ভাগ পূর্ন হয়নি, সরাসরি দ্বিতীয় ভাগের কাজ শুরু হয়৷ ঘানা থেকে দুজন অফিসার ভারতে আসে। একজন ছিল পল ইয়াংকি যিনি ঘানা পুলিশের প্রধান ছিলেন এবং অন্যজন বেন ফোর্জ যিনি ঘানা পুলিশের উপপ্রধান ছিলেন। এই দুই অফসারকে প্রশিক্ষনের দায়িত্ব দেওয়া হয় আর এন কাওকে। এই দুই অফিসার ঘানার জেমা উপজাতির লোক ছিল, যারা অত্যন্ত দক্ষ ছিল।
ঘানার প্রধানমন্ত্রী কোয়ামে নকরোমা নিজে এই দুজনকে নির্বাচন করেছিল ভারতে প্রশিক্ষনের জন্য। আর এন কাও এর কাজ অত্যন্ত দায়িত্বের ছিল কারন তার উপরই দায়িত্ব ছিল ভারত ও ঘানার কুটনৈতিক সম্পর্ক মজবুত করার। আর এন কাও বিস্তারিত প্রশিক্ষন দেওয়া শুরু করেন, এই কাজে তাঁকে সহায়তা করেন আইবির আরও একজন অফিসার এইচ জে ক্রিপলানি। এই দুই অফিসার ভারতে প্রশিক্ষন শেষ করে ঘানায় ফিরে যায় তাদের উপর দায়িত্ব দেওয়া হয় ঘানা ইনটেলিজেন্সে নতুন প্রার্থী নিয়োগ করা। এবার পুরো পরিকল্পনার তৃতীয় বা শেষ ভাগের জন্য ভারতীয় সরাষ্ট্র মন্ত্রক ও বিদেশ মন্ত্রক আর এন কাওকে নির্বাচন করেন ঘানায় গিয়ে প্রশিক্ষন দেবার জন্য। কিন্তু এরই মধ্যে আইবি একটি খবর পান যে ঘানা দেশের নিরাপত্তার জন্য একটি বিশেষ দল তৈরি করছে যাতে ইংল্যান্ড, কানাডা ও পাকিস্তান থাকবে। পাকিস্তান নাম শুনেই আইবি সরাসরি ঘানার সাথে যোগাযোগ করে এই বিষয়ে কারন ভারত যেখানে ঘানাকে সাহায্য করছে সেখানে পাকিস্তান কি করে থাকতে পারে! ঘানা থেকে খবর আসে এই তথ্য সম্পূর্ন ভুল। কিন্তু ১৯৫৮ সালের মে মাসে সংবাদমাধ্যমে ঘানার প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া খবর অনুযায়ী সত্যি করেই একটি বিশেষ দল তৈরি করা হচ্ছে যেখানে পাকিস্তান আছে। সেই বিশেষ সদস্যের দলের প্রধান ছিল ইংল্যান্ডের স্যার রবার্ট হ্যাজকিন, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ফজিল মুকিম খান এবং রয়েল কানাডিয়ান মাউন্টেন পুলিশের এল বিংগাম। তবে আর এন কাও জানান পাকিস্তানের উপস্থিতির কারনে ভারতের পরিকল্পনায় প্রভাব পড়বেনা। এরই মধ্যে ঘানা সরকার অনুরোধ করে আর এন কাওকে এক বছর নয় বরং দুই বছরের জন্য ঘানায় পাঠাতে। বি এন মুল্লিক ঘানা সরকারের এই অনুরোধ প্রত্যাখান করেন কারন তিনি জানতেন আইবির জন্য রামেশ্বর নাথ কাও কতটা গুরুত্বপূর্ন। তার মতো গুরুত্বপূর্ন ব্যাক্তির দুই বছর না থাকা ভারতের নিরাপত্তা ব্যাবস্থার জন্য বড় ঝুঁকি।
অবশেষে ২৫ অক্টোবর, ১৯৫৮ আর এন কাও ও তার স্ত্রী মালিনী কাও ঘানায় পৌঁছান। ঘানার বিদেশ সেক্রেটারি মিঃ গ্রান্ট তাদের অভ্যর্থনা জানান। তার সাথে পল ইয়াংকি ও বেন ফোর্জও ছিলেন আর এন কাওকে অভ্যর্থনা জানাতে। দুদিন পর কাজ শুরু করতে গিয়ে আর এন কাও দেখেন ঘানার ইনটেলিজেন্স সংস্থার তেমন কিছুই উন্নতি হয়নি।
ঘানার প্রধানমন্ত্রী একটি বাড়িও দিয়েছিল ইনটেলিজেন্স সংস্থা তৈরি করার জন্য কিন্তু সেখানে দুটো চেয়ার, একটি ফোন ছাড়া বিশেষ কিছুই নেই। আর এন কাও ওই দুই অফিসারকে নিয়ে একদম প্রথম থেকে শুরু করেন। ঘানার প্রধানমন্ত্রী একুশ জন লোককে নির্বাচন করে ইনটেলিজেন্স ব্যুরোর জন্য কিন্তু তারা কেউই পুলিশ বিভাগ থেকে ছিলনা, এটা অবাক করে আর এন কাওকে। তবে ঘানার প্রধানমন্ত্রী যথেষ্ট সাহায্য করছিলেন প্রতি পদক্ষেপে। কিছুদিন পর প্রধানমন্ত্রী কোয়ামে নকরোমার সাথে দেখাও হয় আর এন কাওয়ের। প্রধানমন্ত্রী কোয়ামে নকরোমা আর এন কাওকে জানান ঘানায় ইউনাইটেড আরব রিপাবলিক ঘানায় তাদের গতিবিধি চালাচ্ছে এবং ভবিষ্যতের জন্য আমেরিকা ও ব্রিটিশ এজেন্সির উপর নজরদারি রাখতে তিনি শক্তিশালী ইনটেলিজেন্স সংস্থা তৈরি করতে চাইছেন। একবছর ধরে ঘানায় যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করে ভারতে ফিরে আসেন আর এন কাও। এরপর আইবি কে শঙ্করন নাইয়ারকে ঘানায় পাঠায় পুরো কাজ সম্পন্ন করার জন্য।
কে শঙ্করন নাইয়ারও যথেষ্ট দক্ষতার সাথে কাজ করেছিলেন। আর এন কাও এতটাই দক্ষ ভাবে নিজের দায়িত্ব সামলেছিলেন যে ঘানার জাতীয় সুরক্ষায় পাকিস্তান থাকা সত্বেও পাকিস্তান ঘানার ইনটেলিজেন্স সংস্থায় কোনও হস্তক্ষেপ করতে পারেনি। ঘানায় ইনটেলিজেন্স নেটওয়ার্ক সম্পন্ন করে কে শঙ্করন নাইয়ার ভারতে ফিরে আসেন। পাঁচ বছর পর ভারতে আর এন কাও এবং কে শঙ্করন নাইয়ারের সাথে সাক্ষাৎ হয় ঘানার প্রধানমন্ত্রী কোয়ামে নকরোমার, সেসময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। কোয়ামে নকরোমা দুজনকেই ধন্যবাদ জানান ঘানার ও ভারতের সম্পর্ক মজবুত করার জন্য। র এবং আইবির মতে সংস্থা থাকতে কারও ক্ষমতা নেই ভারতের দিকে চোখ তুলে তাকানোর।