কীভাবে কলকাতাকে ছাড়িয়ে মুম্বাই ভারতের অর্থনৈতিক রাজধানী হয়ে উঠেছিল?
হুগলী নদীর পূর্ব পাড়ে অবস্থিত পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতাকে সিটি অফ জয়, সিটি অফ প্যালেসেস, ভারতের সাংস্কৃতিক রাজধানী সমেত একাধিক নামে ডাকা হয়। ব্রিটিশ শাসনে ১৭৭২ সাল থেকে ১৯১১ সাল পর্যন্ত কলকাতা ভারতের রাজধানীও ছিল। শুধু তাই নয় কলকাতা এতটাই সমৃদ্ধ শহর ছিল যে কলকাতাকে ভারতের অর্থনৈতিক রাজধানীও বলা হত। বর্তমানে যেমন মুম্বাইকে ভারতের অর্থনৈতিক রাজধানী বলা হয় ঠিক তেমনি এই সম্মান কলকাতার ছিল একটা সময়। কলকাতা শহরের বহু পুরোনো। প্রত্নতত্ত্ববিদদের কথায় প্রায় দুই হাজার বছর আগেও কলকাতা শহরে জনবসতি ছিল। কিন্তু আধুনিক কলকাতার ইতিহাস জানা যায় ১৬৯০ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আসার পর থেকে। প্রাচীন ইতিহাসে বলা হয়েছে দিল্লির সুলতান, মুঘল, পর্তুগীজ, ফরাসি ও ব্রিটিশদের আসার আগেও কলকাতা একটি বানিজ্য কেন্দ্র ছিল। কলকাতা অঞ্চলের উৎপত্তি মৌর্য ও গুপ্ত সাম্রাজ্যের সময় বলে মনে করা হয়। মহাভারতেও বঙ্গের উল্লেখ পাওয়া যায়। এই শহরের নাম কলকাতা কীভাবে হল তা নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মত রয়েছে। সবচেয়ে জনপ্রিয় মতটি হল অতীতে এই শহরের নাম ছিল কালীক্ষেত্র অর্থাৎ হিন্দুধর্মের পরম পূজনীয়া দেবী কালীর এলাকা। এই কালীক্ষেত্র নামটিই পরে কালিকাতা হয়েছে বলে মনে করা হয়। আবার কালীঘাট থেকে কলকাতা নামটি এসেছে বলে মনে করা হয়। এরকম ভাবে কলকাতা নামকরনের পেছনে অনেক মতবাদ রয়েছে। ব্রিটিশরা এই শহরের নাম দেয় ক্যালকাটা যা পরবর্তীকালে হয় কলকাতা।
১৬৯০ সালের ২৪ আগস্ট জব চার্নক নামে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এক এজেন্ট হুগলী নদীর কাছে সুতানটি আসেন। জব চার্নক ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কারখানা তৈরি করার জন্য স্থানীয় জমিদারের কাছ থেকে কালিকাতা, সুতানটি ও গোবিন্দপুর তিনটি গ্রাম ভাড়া নেন। এই তিনটি গ্রামজুড়েই আধুনিক কলকাতা শহর গড়ে উঠেছে। ১৬৯৯ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এখানে শহর নির্মান শুরু করে। ব্রিটিশরা তখন এই অঞ্চলের নাম রাখে ক্যালকাটা, ১৭৭২ সালে ব্রিটিশরা ক্যালকাটাকে ভারতের রাজধানী ঘোষনা করে যার কারনে এখানে ব্রিটিশদের প্রভাব আরও বৃদ্ধি পায়। কলকতা শহরের গভর্নর রিচার্ড ওয়েলেসলি এই শহরকে সিটি অফ প্যালেসেস হিসাবে তৈরি করান। ব্রিটিশ শাসনে কলকাতায় পশ্চিমা সংস্কৃতির বিস্তার ঘটা শুরু হয়। উনবিংশ ও বিংশ শতকে বাংলাতে সমাজ সংস্কার আন্দোলন শুরু হয় একে বাংলার নবজাগরন বা বাংলার রেনেসাঁও বলা হয়। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ন কেন্দ্র ছিল এই কলকাতা শহর। ব্রিটিস শাসনে কলকাতা ভারতের মুখ্য অর্থনৈতিক কেন্দ্র হিসাবেও গড়ে ওঠে।
১৭৭২ সালে ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী হওয়ার পর থেকেই কলকাতা ভারতের অর্থনৈতিক রাজধানী হয়ে ওঠার যাত্রা শুরু হয়। ব্রিটিশ শাসনের আগেই কলকাতা একটি বানিজ্যকেন্দ্র ছিল, তবে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এখানে কলকারখানা তৈরি করায় বানিজ্যিক দিক দিয়ে কলকাতার গুরুত্ব আরও বেড়ে যায়। কলকাতা ভারতের রাজধানী হওয়ার পর ব্রিটিশ গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস মুর্শিদাবাদ থেকে সমস্ত গুরুত্বপূর্ন সরকারি দপ্তর কলকাতায় নিয়ে আসে। ১৮০৬ সালে কলকাতাতেই ভারতের প্রথম জয়েন্ট স্টক ব্যাঙ্ক তৈরি করা হয়। ১৮৪০ সালে বোম্বেতে জয়েন্ট স্টক ব্যাঙ্ক তৈরি করা হয়েছিল। ব্যাঙ্ক অফ বেঙ্গলও কলকাতাতেই তৈরি করা হয়েছিল প্রথমে। সেসময় ভারতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন অর্থনৈতিক কেন্দ্রগুলোর একটি ছিল এই ব্যাঙ্ক অফ বেঙ্গল। তৎকালীন সময়ে বাংলা বলতে অবিভক্ত বাংলাকে বোঝানো হত অর্থাৎ বাংলাদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা, বিহার সহ আসামের কিছু অংশ নিয়ে বেঙ্গল প্রদেশ ছিল। এই জন্য ব্যাঙ্ক অফ বেঙ্গলের আওতায় একটি বিশাল ভূভাগ ছিল। ভারতের রাজধানী হওয়ার কারনে এবং ব্যাঙ্ক অফ বেঙ্গল থাকার কারনে কলকাতার গুরুত্ব বহুগুন বৃদ্ধি পেয়েছিল। ব্যাঙ্ক অফ বেঙ্গলে ব্রিটিশ শাসনে বেশীরভাগ অর্থ জমা থাকতো।
১৮৯৫ সালের তথ্য অনুযায়ী ব্যাঙ্ক অফ বেঙ্গলে ১৮৪ লাখ টাকা জমা ছিল যেখানে ব্যাঙ্ক অফ বোম্বেতে ৭৬ লাখ টাকা জমা ছিল। সেসময় ব্যাঙ্কিং এর ক্ষেত্রেও কলকাতা বোম্বের থেকে অনেক আগে ছিল। বোম্বেতে সেসময় খুব কম ব্যাঙ্কই ছিল যেখানে কলকাতাতে প্রচুর ছোট ছোট ব্যাঙ্ক ছিল এদের লোন অফিস বলা হত। তৎকালীন ভারতে কলকাতাতে ৪৫ থেকে ৫০ শতাংশ ভারতীয় সংস্থার কেন্দ্র ছিল যেখানে বোম্বেতে মাত্র ১৩ থেকে ১৫ শতাংশ সংস্থা ছিল। তবে বিংশ শতকের শুরু থেকেই ভারতের অর্থনৈতিক রাজধানী হিসাবে কলকাতার পতন শুরু হয় এবং বোম্বে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে কলকাতার থেকে এগিয়ে যায়। কলকাতার অর্থনৈতিক রাজধানী হিসাবে পতনের পেছনে অনেক কারন রয়েছে। ১৯১২ সালে ব্রিটিশরা ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে সরিয়ে দিল্লিকে করে যার জন্য কলকাতার গুরুত্ব কমতে শুরু করে। ১৯১৪ সালে শুরু হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, এইসময় কলকাতা বন্দরের তুলনায় বোম্বে বন্দর বেশী গুরুত্বপূর্ন হয়ে পড়ে। ব্রিটিশরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় মধ্যপ্রাচ্যে ও পূর্ব আফ্রিকাতে অভিযানের জন্য বোম্বে বন্দরকে একটি গুরুত্বপূর্ন সামরিক ঘাঁটি হিসাবে ব্যবহার করা শুরু করে। তাছাড়া প্রাকৃতিক কারনেও কলকাতা বন্দর অপেক্ষা বোম্বে বন্দর বেশী উপযোগী ছিল। সমুদ্র থেকে নদীপথে আশি মাইল দূরে অবস্থিত কলকাতা বন্দরে আসা বড় বড় মালবাহী জাহাজের জন্য একটু সমস্যার ছিল কিন্ত সেই তুলনায় সুয়েজ খালের কাছে অবস্থিত বোম্বে বন্দরে ইউরোপ থেকে সহজেই বড় বড় মালবাহী জাহাজ আসতে পারতো। বোম্বের সাথে পাঞ্জাব ও দক্ষিন ভারতের রেলপথে সংযোগ তৈরি হওয়ায় বোম্বে বন্দর বানিজ্যিক ভাবে অত্যন্ত বেশী গুরুত্বপূর্ন হয়ে ওঠে। পাঞ্জাবের সাথে করাচির রেল সংযোগ না থাকায় পাঞ্জাবের কাছে করাচি বন্দর থাকলেও বোম্বে বন্দর বেশী গুরুত্বপূর্ন ছিল। বোম্বেতে তুলো, স্টক এক্সচেঞ্জ ও বুলিয়ন বাজারের মতো তিনটি গুরুত্বপূর্ন আর্থিক কেন্দ্র ছিল কিন্ত সেই তুলনায় কলকাতায় মাত্র একটি গুরুত্বপূর্ন অর্থনৈতিক কেন্দ্র ছিল পাট শিল্প। কলকাতায় স্টক এক্সচেঞ্জ থাকলেও বোম্বের স্টক এক্সচেঞ্জ বেশী গুরুত্বপূর্ন ছিল।
১৯৩৭ সালে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া তাদের মুখ্য কার্যালয় কলকাতা থেকে বোম্বেতে নিয়ে আসে। দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের মুখ্য কার্যালয়ের উপস্থিতি কোন রাজ্যের অর্থনৈতিক রাজধানী হওয়ার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ন বিষয়। উনবিংশ শতাব্দীতে কলকাতার তুলনায় বোম্বেতে ভারতীয়দের প্রাধান্য বেশী ছিল। যেমন কলকাতার বেশীরভাগ ব্যাঙ্ক ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রনাধীন ছিল, এমনকী ব্যাঙ্ক অফ বেঙ্গলেও বেশীরভাগ সময় ধরে কোনও ভারতীয় ছিলনা। সেই তুলনায় বোম্বেতে বেশীরভাগ ব্যাঙ্কে ভারতীয়দের প্রভাব ছিল।
কলকাতার ব্যাঙ্কে ব্রিটিশ ও ইউরোপীয়ানদের সঞ্চয় বোম্বের ব্যাঙ্কগুলোর তুলনায় অন্তত দ্বিগুন ছিল। যার জন্য ভারত স্বাধীন হওয়ার সময়ে কলকাতার তুলনায় অর্থনৈতিক ভাবে বোম্বে বেশী গুরুত্বপূর্ন হয়ে ওঠে ভারতীয়দের কাছে। এতসব সত্ত্বেও ১৯৪০ সাল পর্যন্ত কলকাতা ভারতের অর্থনৈতিক রাজধানী হিসাবেই ছিল কিন্তু ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর পরিস্থিতি খারাপ হওয়া শুরু হয়। ১৯৪২ সালে জাপানের সেনাবাহিনী বার্মা দখলের পর কলকাতা আক্রমন করে, এই সময় কলকাতা বন্দরের বানিজ্য ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলের নেতৃত্বে বাংলা থেকে বেশীরভাগ চাল ইংল্যান্ডে পাঠানো হতে থাকে যুদ্ধের সেনাদের জন্য যার জন্য বাংলাতে ভয়ানক দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় যাতে ৪০ লাখ ভারতীয়র মৃত্যু হয়।
১৯৪৩ সালে বাংলার এই মর্মান্তিক দুর্ভিক্ষ কলকাতার আশেপাশে গ্রামগুলোর ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয় যার প্রভাব পড়ে কলকাতার অর্থনৈতিক পরিকাঠামোয়। ১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতার সময়ে বাংলাকে বিভক্ত করে পূর্ববঙ্গ পাকিস্তানে চলে যায়। অনেক গুরুত্বপূর্ন পাটকেন্দ্র পূর্ববঙ্গে ছিল যার জন্য কলকাতার পাটকল গুলো পর্যাপ্ত কাঁচামালের সঙ্কটে পড়ে। তাছাড়া ১৯৪৭ সালের সময় থেকে বাংলাতে রাজনৈতিক অস্থিরতা, ধর্মীয় উত্তেজনা ও শরনার্থী সমস্যা বৃদ্ধি পায় যা কলকাতার ব্যবসায়িক পরিকাঠামোকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ১৯৬০ ও ১৯৭০ এর দশকে বিদ্যুৎ বিপর্যয়, শ্রমিকদের বিক্ষোভ সহ নকশাল আন্দোলন শুরু হয় পশ্চিমবঙ্গে। যার জন্য কলকাতার পরিকাঠামো বড় আকারে ক্ষতিগ্রস্থ হয় এবং আর্থিকভাবে কলকাতা বোম্বের তুলনায় পিছিয়ে পড়ে। ১৯৭১ সাল কলকাতার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ন ছিল কারন পূর্ব পাকিস্তান পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বাংলাদেশ গঠনের কারনে পুনরায় ধর্মীয় উত্তেজনা, হিংসার কারনে দলে দলে শরনার্থী বাংলাদেশ থেকে কলকাতায় এসে আশ্রয় নেয় যা কলকাতা শহরের জন্য একটি বড় সমস্যার কারন ছিল। এসব কারনে একসময় ভারতের অর্থনৈতিক রাজধানী হিসাবে পরিচিত থাকা কলকাতার আর্থিক অবনতি ঘটে এবং বোম্বে ভারতের নতুন অর্থনৈতিক কেন্দ্র হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। তবে কলকাতা এখনও ভারতের সাংস্কৃতিক রাজধানী হিসাবে রয়েছে।