জাপানে পরমানু বোম্ব ফেলা সত্ত্বেও আমেরিকাকে তাদের সবথেকে বড় বন্ধু দেশ বলা হয়?
মানব ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ানক যুদ্ধ বলা হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে। এইসময় জাপানের সাথে প্রশান্ত মহাসাগরে আমেরিকার যুদ্ধ হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকার নৌবাহিনীর কাছে পরাজিত হয় জাপানি নৌবাহিনী। জাপানের নৌবাহিনীর গড়ে দশটির মধ্যে আটটি যুদ্ধজাহাজ আমেরিকার নৌবাহিনী ধ্বংস করে দিয়েছিল। মানব ইতিহাসে প্রথম পরমানু বোম্ব জাপানের হিরোশিমা ও নগাসাকি শহরের উপর ফেলেছিল আমেরিকা। যার জন্য বহু জাপানি নাগারিকের মৃত্যু হয়েছিল। এই পরমানু বোম্বের তেজস্ক্রিয়তার প্রভাবে পরবর্তীকালে বহু বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম হয় জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে। কিন্তু এসব সত্বেও জাপানের সাথে বর্তমানে আমেরিকার মজবুত কুটনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। ৮৪ শতাংশ জাপানিজ চায় আমেরিকার সাথে তাদের কুটনৈতিক সম্পর্ক থাকুক।
ইতিহাসে এমন ঘটনা খুব কমই দেখা যেখানে একসময় প্রবল শত্রু থাকা দুটি দেশ পরস্পর বন্ধু হয়ে গেছে। আমেরিকার মতোই জাপানের সাথে চীনের শত্রুতা ছিল আঠারো শতক ও উনিশ শতক ধরে। কিন্তু আজও চীন জাপানি অত্যাচারের কথা ভোলেনি। চীনের রাজনীতিতে জাপান বিরোধীতা রয়েছে। কিন্তু অতীতের ক্ষত ভুলে গিয়ে আমেরিকা ও জাপানের মধ্যে কুটনৈতিক সম্পর্ক সত্যিই একটি বিরল দৃষ্টান্ত।
জাপানে অতীতে রাজতন্ত্র ছিল। একটা সময় রাজতন্ত্রে জাপানে রাজার পরেই ছিল তোকুগাওয়া নামে একটি গোষ্ঠীর স্থান। এই তোকুগাওয়া গোষ্ঠী মূলত জাপানের সামরিক দিক দেখত। তোকুগাওয়া গোষ্ঠীর সর্বোচ্চ সামরিক কর্মকর্তাকে সোগুন বলা হত, রাজাই সোগুনকে নিয়োগ করতো, সোগুনের নীচে ছিল ড্যামিউ যারা জমির মালিক ছিল তাদের কাছে ছিল সামুরাই গোষ্ঠী যারা বাকী নির্দিষ্ট এক একটি অঞ্চল নিয়োগ করতো, এভাবে পুরো জাপানের প্রশাসনিক ব্যবস্থা চলতো। রাজা প্রধান হলেও মূলত সোগুনই জাপানকে নিয়ন্ত্রন করতো, এতটাই ক্ষমতা ছিল সোগুনের।
১৬০০ সালে জাপানের তৎকালীন সোগুন সাকোকু নামে একটি নীতি প্রচলন করে। এই নীতি অনুযায়ী জাপানিরা কোনও নাগরিক দেশের বাইরে যেতে পারতোনা, খ্রীষ্টান ধর্মের কেউ জাপানে প্রবেশ করতে পারতোনা এবং বিদেশীদের জাপানে প্রায় প্রবেশাধিকার ছিলনা অর্থাৎ জাপান তার সংস্কৃতি রক্ষা করার জন্য একপ্রকার জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ছিল। আঠারো শতকে আমেরিকা লক্ষ্য করে চীনের সাথে বানিজ্যের জন্য জাপান তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ন কারন জপাানে আমেরিকার জাহাজগুলো কয়লা পাবে। এজন্য ১৮৫৩ সালে আমেরিকার নৌবাহিনীর কম্যান্ডার ম্যাথিউ প্যােরি জাপান আসে এবং জাপানের রাজাকে আমেরিকার সাথে বানিজ্যের প্রস্তাব দেয়। বলা হয় সেসময় জাপানের রাজবংশের কিছু ব্যক্তিই আমেরিকার সাহায্য চায় দেশে সোগুনদের প্রভাব কমিয়ে পুনরায় রাজার হাতে সমস্ত নিয়ন্ত্রন ফেরাতে। আমেরিকার প্রভাবে ১৮৬৮ সালে সোগুনদের হটিয়ে জপাানের শাসক মেজির কাছে জাপানের পূর্ন নিয়ন্ত্রন চলে আসে। মেজি জাপানের দরজা বিদেশীদের জন্য খুলে দেয়। মূলত আমেরিকার সাহায্যে জাপানের আধুনিকরন শুরু হয়, জাপানের সাথে আমেরিকার বানিজ্যে উভয়পক্ষেরই লাভ হয়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ১৯১৪ সাল থেকে ১৯১৮ সাল পর্যন্ত জাপান মিত্রশক্তির হয়ে লড়াই করে। যুদ্ধ শেষে চীনে থাকা জার্মান ঘাঁটিগুলোর নিয়ন্ত্রন জাপানকে দিয়ে দেওয়া হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ১৯১৫ সালে জাপান চীনের কাছে ২১টি শর্ত রেখেছিল যা চীন মানেনি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়ে যাবার পর ১৯১৯ সালে জাপান আরও আগ্রাসী হয়ে ওঠে। জাপান সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করার পাশাপাশি চীনের মাঞ্চুরিয়া অঞ্চলের অনেকাংশ দখল করে নেয়। ১৯৩০ এর দশক আসতে আসতে চীনের পূর্ব উপকূল জাপানের নিয়ন্ত্রনে চলে যায়। আমেরিকা ও পশ্চিমা দেশগুলো জাপানের এই সামরিক আগ্রাসনের বিপক্ষে ছিল কারন চীন তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ন বানিজ্যিক কেন্দ্র ছিল।
১৯৩৯ সালে জাপান চীনের পুরো মাঞ্চুরিয়া অঞ্চল এবং প্রায় বেশীরভাগ উপকূল ভাগ দখল করে নেয় কিন্তু আমেরিকা, ব্রিটেন ও অস্ট্রেলিয়া এসব অঞ্চল জাপানের বলে স্বীকৃতি দেয়নি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ১৯৪০ সালের ২৬ জুলাই আমেরিকা রপ্তানি নিয়ন্ত্রন আইন অনুযায়ী জাপানে তেল, লোহা ও স্টিল রপ্তানি বন্ধ করে দেয়। এই ঘটনায় জাপানের আর্থিক ক্ষতি হয়, এর বদলা নিতে ১৯৪১ সালের ৭ ডিসেম্বর জাপান হাওয়াইতে আমেরিকার নৌবাহিনীর পার্ল হারবার বন্দরে আক্রমন করে। এরপরেই আমেরিকা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেয়। বলা হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকার অংশ নেওয়ার কোনও ইচ্ছেই ছিলনা কিন্তু পার্ল হারবারের কারনে আমেরিকা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেয়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যে জাপান জার্মানির বিরুদ্ধে মিত্রশক্তির হয়ে লড়াই করেছিল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সেই জাপান জার্মানির পক্ষে মিত্রশক্তির বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করে। ১৯৪৫ সালের ৬ ও ৯ আগস্ট আমেরিকা জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরে লিটল বয় ও ফ্যাটম্যান পরমানু বোম্ব ফেলে। এরপরেই জাপান আত্মসমর্পন করে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়। আমেরিকা জাপানে পরমানু বোম্ব ফেলে কারন সোভিয়েত ইউনিয়ন মাঞ্চুরিয়া, কোরিয়া দখল করে নিয়েছিল এবং জাপান দখল করতে উদ্যত হয়েছিল এই অবস্থায় সোভিয়েত ইউনিয়নের আগে জাপানকে আত্মসমর্পন করানো প্রয়োজন ছিল। এই জন্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে একই পক্ষে থাকা সত্ত্বেও সোভিয়েত ইউনিয়নকে পরমানু হামলার বিষয়ে আগে থেকে জানায়নি আমেরিকা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পরবর্তী সাত বছরের জন্য জাপান আমেরিকার অধীনে চলে যায়।
১৯৪৭ সালের ৩ মে আমেরিকা জাপানে নতুন সংবিধান আনে। সংবিধান অনুযায়ী জাপানকে গনতান্ত্রিক দেশ করা হয়। জাপানের শাসক হিরোহিটোকে শুধুমাত্র প্রতীকী নেতা রাখা হয়। জাপানের প্রশাসনিক ব্যবস্থার পরিবর্তন করা হয়। সেসময় জাপানের সংবিধানে আর্টিকেল ৯এ বলা হয় জাপানি নাগরিকরা কখনও যুদ্ধে যেতে পারবেনা এবং জপাান স্থল, বায়ু ও নৌসেনা গঠন করতে পারবেনা। জাপানের নিরাপত্তার দায়িত্ব আমেরিকা নিয়ে নেয়। আমেরিকা জাপানের আর্থিক বিকাশের জন্য ব্যাপকভাবে কাজ শুরু করে। ১৯৪৫ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত জাপানকে আর্থিকভাবে শক্তিশালী করবার জন্য আমেরিকা বানিজ্যে ছাড় দেয়, আর্থিক সহায়তা করে এবং আধুনিক প্রযুক্তি দেয়। এর কারনে ১৯৬০ থেকে ১৯৮০ এর দশকে জাপানের অভূতপূর্ব আর্থিক বিকাশ হয়। জাপান বিশ্বের দ্বিতীয় আর্থিক শক্তিশালী দেশ হয়ে ওঠে। জপানের গাড়ি শিল্প আমেরিকার থেকেও বিখ্যাত হয়ে যায়। আমেরিকাতে গাড়ি উৎপাদন প্রায় বন্ধ হয়ে যায় কারন জাপান থেকে আমেরিকার মানুষ কম খরচে গাড়ি কিনতো। জপানি কারেন্সি ইয়েনের মান আমেরিকান কারেন্সি ডলারের থেকে অনেক কম ছিল যার জন্য জাপান থেকে জিনিস কেনা আমেরিকানদের জন্য অনেক সস্তা ছিল। এই জন্য আমেরিকার পরামর্শে জাপান তাদের কারেন্সি ইয়েনের মূল্য বৃদ্ধি করে। এর ফলে জাপানেরও কিছু রপ্তানি কমে যায় তবে আমেরিকা জাপানকে তাদের কারখানা আমেরিকাতে তৈরি করবার জন্য অনুমতি দেয়। জাপানের এই পদক্ষেপে আমেরিকাতেও কর্মসংস্থান হয় এবং জাপানেরও আর্থিক লাভ হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কোরিয়ার যুদ্ধে কোরিয়া দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায়। দক্ষিন কোরিয়াতে আমেরিকার নিয়ন্ত্রন ছিল এবং উত্তর কোরিয়াতে সোভিয়েত ইউনিয়নের, সেসময় আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে শীতল যুদ্ধও চলছিলো। আমেরিকা চিন্তা করে ভবিষ্যতে উত্তর কোরিয়া যদি জাপান আক্রমন করে তাহলে জাপান আত্মরক্ষা করতে পারবেনা। এইজন্য আমেরিকা জাপানকে নির্দেশ দেয় নিজেদের আত্মরক্ষার জন্য সেনাবাহিনী গঠন করতে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপান পরমানু শক্তিকে কাজে লাগিয়ে শক্তি উৎপাদন শুরু করে যাতে আমেরিকা জাপানকে সহায়তা করে। এজন্য জাপান ১৯৪৫ সালের পরমানু হামলার জন্য আমেরিকার থেকে কোনও ক্ষমা দাবী করেনি কারন জাপানের ভয় ছিল এর ফলে তাদের দেশেই পরমানু শক্তি ব্যবহারের বিরুদ্ধে কথা হবে। জাপান এটাও জানে যদি আমেরিকাকে তারা ক্ষমা চাওয়ার জন্য বলে তাহলে তাদের উপরও প্রশ্নচিহ্ন উঠবে। জাপান ১৯৩০-৪০ এর দশকে এশিয়াতে বিশেষ করে চীনের উপর অনেক অত্যাচার করেছে। ১৯৪২ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানি সেনাবাহিনী ২৫,০০০ চীনের সাধারন নাগরিককে হত্যা করেছিল। এসব ঘটনার জন্য জাপানের সরকারকে সিঙ্গাপুরে গিয়ে বিশ্বের কাছে ক্ষমা চাইতে হতে পারে। আসলে কুটনৈতিক সম্পর্ক জাতীয় স্বার্থের উপর নির্ভর করে। ভূরাজনীতিতে জাতীয় স্বার্থ অনুযায়ী বন্ধু ও শত্রু নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নির্ধারিত হয়। জাপান জানে তাদের আর্থিক বিকাশ ও নিরাপত্তার জন্য আমেরিকার মতো শক্তিশালী বন্ধু দেশ দরকার। এজন্য জাপানের ৮৪ শতাংশ জনগন আমেরিকাকে তাদের বন্ধু মনে করে। প্রাক্তন আমেরিকার রাষ্ট্রপতি প্রথম আমেরিকান রাষ্ট্রপতি হিসাবে হিরোশিমা শহরে গিয়েছিলেন এবং প্রাক্তন জাপনি রাষ্ট্রপতি শিনজো অ্যাবেও পার্ল হারবারে এসে বক্তৃতা দিয়েছিলেন পুরোনো ঘটনার জন্য। বর্তমানে চীনের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে জাপান আমেরিকার স্ট্রাটেজিক বন্ধু।