অফবিট

কুড়ি লাখ কোটি টাকার সোনা সামনে পেয়েও ফিরিয়ে দিয়েছিলেন এক সাফাই কর্মী। ব্যাঙ্ক অফ ইংল্যান্ডের অজানা ইতিহাস

নেটফ্লিক্সের সবচেয়ে জনপ্রিয় ওয়েব সিরিজ গুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে মানি হেইস্ট। ওয়েব সিরিজটির বিভিন্ন চরিত্র গুলোর মধ্যে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ ছিল প্রফেসরের চরিত্রটি যা বিশ্বজুড়ে খ্যাতি পেয়েছে। মানি হেইস্ট একটি স্প্যানিশ সিরিয়াল যাকে নেটফ্লিক্স কিনে নেয়। এই ওয়েব সিরিজটির জন্য নেটফ্লিক্সের শেয়ার মূল্য বেড়ে গেছে। মানি হেইস্টের একটি গল্প হচ্ছে একদল লোক প্রফেসরের নেতৃত্বে ব্যাঙ্ক অফ স্পেনে প্রবেশ করে এবং সোনা গলিয়ে চুরি করে নিয়ে যায়। সিরিজটিতে একটি বিখ্যাত কথা ছিল যে সোনার আসল মূল্য কিছু নয় এটা বিভিন্ন দেশের জন্য একটি ইনশিওরেন্সের মতোন। মানি হেইস্ট একটি কাল্পনিক কাহিনী কিন্তু বাস্তবে এরকমই একটি ঘটনা রয়েছে। তবে এটা কোনও চুরির ঘটনা নয় বরং খুবই অদ্ভুত একটি ঘটনা। বাস্তবের প্রেক্ষাপট ব্যাঙ্ক অফ ইংল্যান্ড। যেসময়ের ঘটনা তখন সোনা জমা রাখার বিষয়ে ব্যাঙ্ক অফ ইংল্যান্ড প্রথম ছিল, এখন অবশ্য দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। কি করে এক ব্যাক্তি ব্যাঙ্ক অফ ইংল্যান্ডের সোনা জমা রাখার স্থানে পৌঁছে গিয়েছিল? তার কথাই বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করা হবে।

প্রথমে জানা দরকার কোন কোন দেশের কাছে কত পরিমান সোনা মজুত আছে। এই মহূর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশী সোনা আছে নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাঙ্কে। এখানে ৮,১৩৫ টন সোনা আছে। ব্যাঙ্ক অফ ইংল্যান্ডে ৫,১৩৪ টন সোনা রয়েছে, জার্মানির কাছে ৩,৩৬২ টন, ইটালির কাছে ২,৪৫১টন, ফ্রান্সের কাছে ২,৪৭৬ টন, রাশিয়ার কাছে ২,২৯৮ টন, চীনের কাছে ১,৯৪৮ টন সোনা আছে। পৃথিবীর এইসব দেশ গুলোর কাছে বেশী সোনা মজুত আছে। ভারতের কাছে ৬৮৬ টন সোনা আছে। তবে কোন দেশের কাছে কত সোনা মজুত আছে তা বিচার করে সেই দেশ ধনী না গরীব তা বিচার করা সম্ভব নয়। এখানে সোনার হিসাব করা হয়েছে ব্যাঙ্কে যে সোনা মজুত আছে তার উপর ভিত্তি করে। কোন দেশের কাছে প্রকৃত কতটা সোনা আছে তার হিসাব এখানে দেওয়া নেই। প্রতিবছর সোনার বানিজ্যে ভারত বিশ্বের প্রথম পাঁচ দেশের মধ্যে থাকে। ভারতবর্ষে সোনার গয়না ব্যবহারের চল আছে। যেকোন অতি সাধারন মানুষের কাছেও একটা হলেও সোনার গয়না রয়েছে। এছাড়াও ভারতের মন্দির গুলোতে কয়েক বিলিয়ন ডলারের সোনা মজুত আছে। সব মিলিয়ে এই মহূর্তে ভারতের কাছে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশী সোনা মজুত আছে।

ব্যাঙ্ক অফ ইংল্যান্ড তৈরি হয় ১৬৯৪ সালে, একটি ভাড়া বাড়িতে তখন সোনাতেই লেনদেন হত। ১৭৩৪ সালে ব্যাঙ্ক অফ ইংল্যান্ডের নিজস্ব ভবন তৈরি হয়। সেইসময়ও যখন প্রযুক্তি এতটা উন্নত ছিলনা তখনও এই ব্যাঙ্কের নিরাপত্তা ব্যবস্থা যথেষ্ট মজবুত ছিল। এই ব্যাঙ্কে মোট আটটি ভল্ট আছে, প্রত্যেকটি ভল্টের চাবি প্রায় একফুট করে লম্বা সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে ভল্টগুলো কতটা মজবুত। সময়ের সাথে সমস্ত আধুনিক প্রযুক্তি এই ব্যাঙ্কে ইনস্টল করা হয়েছে কারন ইংল্যান্ডের সবচেয়ে বেশী সোনা মজুত আছে। ৫,১৩৪ টন সোনা এখানে চার লাখ ইঁটের আকারে রাখা আছে। প্রত্যেকটি ইঁটের ওজন বারো কিলোগ্রাম। মাটির নীচে আটটি ভল্টে এসব সোনা রয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে এই সোনার দাম ২০০ বিলিয়ন পাউন্ড বা কুড়ি লাখ কোটি টাকা। ব্যাঙ্ক অফ ইংল্যান্ডের তিনশো বছরের ইতিহাসে কারও সাধ্য হয়নি এখানে চুরি করার, এবিষয়ে রীতিমতো গর্ব করে তারা। তবে ব্যাঙ্ক অফ ইংল্যান্ডের ইতিহাসে এমন একটি ঘটনা আছে যা গোটা ব্যাঙ্ককে দেউলিয়া করে দিত। এই ঘটনাটা ব্যাঙ্কের ওয়েবসাইটেও রয়েছে। ব্যাঙ্ক অফ ইংল্যান্ড অবস্থিত থ্রেডনিডল স্ট্রিটে। এর আশেপাশে অনেক অফিস রয়েছে। একদিন ব্যাঙ্ক অফ ইংল্যান্ডের ডিরেক্টরের কাছে একটি চিঠি আসে তাতে একজন অচেনা ব্যাক্তি লেখে যে সে ব্যাঙ্ক অফ ইংল্যান্ডের ভল্টে রয়েছে, তার আশেপাশে প্রচুর সোনা আছে। ডিরেক্টর এই চিঠিকে কোন পাত্তাই দেয়নি কারন তার ধারনা ছিল ব্যাঙ্ক অফ ইংল্যান্ডের এই কোঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা এড়ানোর সুযোগ কারো নেই। এর কিছুদিন পর আবারও চিঠি আসে। চিঠিতে এবার লেখা থাকে যদি বিশ্বাস না হয় তার কথা তাহলে একটি নির্দিষ্ট দিনে, একটা সময় যেন ভল্টের সামনে চলে আসে। এবার ডিরেক্টর একটু অবাক হয়ে যায়। সে নিজে ব্যাঙ্কের সব নিরাপত্তা ব্যবস্থা বারবার পরীক্ষা করে দেখে সব ঠিক আছে। এর কিছুদিন পর আবারও একটি চিঠি আসে যাতে একটি নির্দিষ্ট দিনে কিছু লোককে নিয়ে, নির্দিষ্ট সময়ে ভল্টের সামনে আসতে বলা হয়। সেই নির্দিষ্ট দিনে ডিরেক্টর কিছু লোককে নিয়ে কিছুটা অবিশ্বাসে কিছুটা চাপা উত্তেজনায় উপস্থিত হয় ভল্টের সামনে৷ ব্যাঙ্কের বাকি কাউকে কিছু জানানো হয় নি কারন ব্যাঙ্কের সম্মানের প্রশ্ন জড়িয়ে আছে এখানে।

ব্যাঙ্ক অফ ইংল্যান্ডের ডিরেক্টর শুধুমাত্র কিছু বিশ্বাসযোগ্য লোককে নিয়েই উপস্থিত হয়েছিল সেখানে নির্ধারিত সময়ের আগেই। দেখা যায় নির্দিষ্ট সময়ে ভল্টের মধ্যে থেকে একজন লোক বেড়িয়ে আসছে। যা দেখে উপস্থিত প্রত্যেকে অবাক হয়ে যায় কারও মুখে যেন কোনও শব্দ নেই উত্তর দেবার। ডিরেক্টর সোজা সেই লোকটিকে প্রশ্ন করে সে কে এবং সেখানে কি করে উপস্থিত হল? জবাবে লোকটা জানায় সে একজন সাফাই কর্মী, সে থ্রেডনিডল স্ট্রীটে আশেপাশের সমস্ত অফিসে সাফাই কর্মীর কাজ করে। কাজের সূত্রে তাকে ম্যানহোলের নীচেও নামতে হয়। একদিন ম্যানহোলের নীচে নেমে পরিষ্কার করতে করতে পাশে একটি সূড়ঙ্গ দেখতে পায়। সেখানে ঢুকে পরিষ্কার করতে করতে সে এখানে এসে উপস্থিত হয়। এখানে ঢুকেই সে বুঝতে পারে সে ব্যাঙ্ক অফ ইংল্যান্ডের ভল্টে এসে উপস্থিত হয়েছে। সে এরপরেও আরও দুবার এসেছে এখানে যার জন্য তার সব রাস্তা চেনা এবং এইজন্যই সে ডিরেক্টরকে চিঠি লিখেছিল। ব্যাঙ্ক অফ ইংল্যান্ডের কর্মীরা বুঝতে পারে তারা মজবুত ভল্ট সহ, ব্যাঙ্কের শক্তিশালী নিরাপত্তা ব্যবস্থা সবই করেছে কিন্তু তারা মাটির নীচের ব্যবস্থার উপর জোর দিতেই ভুলে গেছে। এরপর ব্যাঙ্ক অফ ইংল্যান্ডের ডিরেক্টর ওই লোকটাকে ৮০,০০০ পাউন্ড পুরস্কার দেয় লোকটার সততার জন্য। কারন লোকটা চাইলে এখান থেকে সোনা চুরি করতে পারতো কিন্তু লোকটা একটা ইঁটও চুরি করেনি। মানি হেইস্টে প্রফেসরকে অনেক পরিকল্পনা করে ব্যাঙ্ক অফ স্পেনে চুরি করার মাস্টার পরিকল্পনা করতে হয়েছিল কিন্তু এখানে ওই ব্যাক্তি সুড়ঙ্গের মাধ্যমে কুড়ি লাখ কোটি টাকার সোনার কাছে পৌঁছেও চুরি করেনি। হয়ত ভাগ্যই ব্যাঙ্ক অফ ইংল্যান্ডকে দেওলিয়া হওয়ার হাত থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *