ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে মহীয়সী নারী বেগম হজরতের ভূমিকা
“Lucknow was the focal point of the fight for freedom and Begum Hazrat Mahal was a brave and resourceful leader.” বলেছেন ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার। ১৮৫৭ সালে লক্ষ্ণৌ হয়ে উঠেছিল বিদ্রোহের প্রাণকেন্দ্র। সেই বিদ্রোহের ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে দাড়িয়েছিলেন এই সাহসী নারী। তিনি ছিলেন প্রথমদিকে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামী নারীদের মধ্যে একজন। কে এই মহীয়সী নারী?
ইতিহাসের পাতায় ধোঁয়াশা আছে হজরত মহলের ছোটবেলা নিয়ে। মনে করা হয় যে ১৮২০ সালে ফৈজাবাদের এক আফ্রিকান বংশোদ্ভূত দাস পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন বেগম হজরত মহল। তবে এখনও পর্যন্ত জানা সম্ভব হয় নি তাঁর জন্মতারিখ । তখন তাঁর নাম ছিল মোহম্মদি খানম। তাঁর পিতা ছিলেন মীর গুলাম হুসেন। তাঁর গায়ের রঙ কালো হলেও মুখশ্রী এবং অঙ্গসৌষ্ঠবের বিচারে অত্যন্ত সুন্দরী নারী ছিলেন তিনি। অনুমান করা হয় যে তাঁর পিতা-মাতা দাস হিসেবে যে মালিকের অধীনে কাজ করতেন, সেখানে থেকেই নাচের প্রাথমিক পাঠ নিয়েছিলেন তিনি এবং সম্ভবত নর্তকী হিসেবে সে সময়ে কিছুটা খ্যাতিও অর্জন করেছিলেন। আর্থিক সঙ্কটের কারণে, তাঁর পিতা নর্তকী হিসেবে কিশোরী মোহাম্মদি খানমকে বিক্রয় করে দেন অওধ রাজদরবারে।
তিনি রাজদরবারে আসার পর আরও পারদর্শিনী হয়ে ওঠেন নাচে। ওই সময় ওয়াজেদ আলী এক নাচের আসরে মুগ্ধ হন তাঁর সৌন্দর্য এবং নৃত্যের প্রতি। তিনি তখন থেকে অন্দরমহলে ‘মাহাক পরি’ বা সৌন্দর্যের পরি নামে পরিচিতি লাভ করেছিলেন। ওয়াজেদ আলীর আত্মজীবনীমূলক কবিতা ও চিত্র সঙ্কলন ‘ইশক-নামা’ থেকে জানা যায়। নবাবের বেশ দুর্বলতা ছিল এই ‘কালো মেয়ে’র প্রতি। তিনি তাঁর সৌন্দর্যের প্রশংসাও করেছেন।
১৮৪৪ খ্রিষ্টাব্দে মোহম্মদি খানমকে বিবাহ করেন ওয়াজেদ আলী। বিয়ের পর তাঁকে বেগম হজরত মহল নাম দেওয়া হয়েছিল। ১৮৪৫ খ্রিষ্টাব্দের ২০ আগষ্ট (বৃহস্পতিবার ৫ ভাদ্র ১২৯২) তাদের একমাত্র পুত্র বিরজিস কদরের জন্মগ্রহণ করেন।
অওধের নবাব হিসেবে ১৮৪৭ খ্রিষ্টাব্দে দায়িত্ব গ্রহণ করেন ওয়াজেদ আলী শাহ, বৃদ্ধি পায় হজরত মহলের প্রভাব প্রতিপত্তি। নৃত্যশিল্পী নিজে ছিলেন, তাই উচ্চতর পৌঁছেছিল লখনৌর দরবারের সঙ্গীতচর্চা ।
১৮৫৬ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশরা দখল করে নেয় ওয়াজেদ আলী শাহের রাজ্য। ওই বছরের ৭ ফেব্রুয়ারি ব্রিটিশদের এই আদেশ কার্যকর হয়। ব্রিটিশরা একটি মাসোয়ার বরাদ্দ করেছিল তাঁর। ওই ঘটনা ঘটার পর, হারানো রাজ্য ফিরে পাওয়ার আশায় ওয়াজেদ আলী শাহ ব্রিটিশদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে কলকাতা তৎকালীন ভারতে রাজধানীতে আসার উদ্যোগ নেন। তিনি মনে করেছিলেন যে – তিনি যদি কাউন্সিলের কর্মকর্তাদের মন গলাতে ব্যর্থ হন তাহলে, রানি ভিক্টোরিয়ার কাছে ইংল্যান্ডে গিয়ে আবেদন করবেন। লখনৌ ১৩ই মার্চ ১৮৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ত্যাগ করেন। ৬ মে শুরু করেন অস্থায়ীভাবে কলকাতার মেটিয়াবুরুজে জীবনযাপন। রাজ্য ফিরে পাওয়ার জন্য ওয়াজেদ আলীর মা বেগম আউলিয়া এবং তাঁর সহযোগীরা যান লণ্ডনে এবং তারা উদ্যোগ নেন রানি ভিক্টোরিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করার। ওই সময় লখনৌতে থেকে যান হজরত মহল এবং সজীব রাখেন লখনৌর রাজদরবারকে।
২৯ মার্চ ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দের (রবিবার, ১৭ চৈত্র ১২৬৩), মঙ্গলপাণ্ডের নেতৃত্বে কলকাতার বারকাপুরে বিদ্রোহ করে ইষ্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির ভারতীয় সেনারা। এরপরে ভারতের বিভিন্ন সেনানিবাসে ছড়িয়ে পড়েছিল এই বিদ্রোহ। উল্লেখ্য, ইতিহাসের পাতায় এই বিদ্রোহটি সিপাহি বিপ্লব নামে পরিচিত। যার ফলে ব্রিটিশ-জনমত ভারতীয়দের বিরুদ্ধে চলে যায়। অন্যদিকে জুন মাসের প্রথম দিকে লখনৌতে বেগম হজরত মহল, তাঁর ছেলে বিরজিস কদরকে নতুন নবাব হিসাবে ঘোষণা করে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। ওই সময় মাত্র ১৪ বছর বয়স ছিল তাঁর পুত্র বিরজিস কদরের। যদিও এর সঙ্গে কোনো সম্পর্ক ছিল না ওয়াজেদ আলীর। ওয়াজিদকে জোর করে যদি বিদ্রোহীরা নেতা হিসাবে ঘোষণা দেন, সেই ভয়ে তাঁর অস্থায়ী বাসস্থান মেটিয়াবুরুজের থেকে তাঁকে গ্রেফতার বন্দী করে গৃহবন্দি করা রাখা হয়েছিল ফোর্ট উইলিয়ামে। বেগম হজরত মহল তৈরি করেন স্থানীয় বিদ্রোহী এবং তাঁর অনুগত সৈন্যদের নিয়ে একটি প্রতিরক্ষা বাহিনী। ৩০ জুন ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দে (মঙ্গলবার, ১৭ আষাঢ় ১২৬৪), লখনৌ শহরের অদূরে যুদ্ধে ব্রিটিশ বাহিনীর সাথে বেগম হজরত মহলের সৈন্যদলের যুদ্ধ হয়। সেই যুদ্ধে পরাজিত হয় ব্রিটিশ বাহিনী। যার ফলে স্বাধীন রাজ্য হিসেবে হজরত মহল লখনৌকে ঘোষণা করেন।
প্রাথমিক সাফল্যের পর থেকে একের পর এক তাঁর পুত্র বিরজিস কদরের নামে ঘোষণা জারি করেন বেগম। শপথ নেন ভারতে মাটিতে ব্রিটিশদের আর ঘাঁটি গড়তে না দেওয়ার। সেই সঙ্গে সাধারণ মানুষের কাছে তুলে ধরেন তাদের নানা ছল-চাতুরি কথা। একটি বিশেষ দল গঠন করা হয়েছিল হজরত মহলকে সাহায্য করার উদ্দেশ্যে। ওই সময় প্রধানমন্ত্রী পদের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন শরাফ-উদ-দৌলা এবং অর্থমন্ত্রী পদের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন ওয়াজিদ আলি শাহ-র বিশ্বস্ত রাজা বালকৃষ্ণ। সেনাপতি পদের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন রাজা জয়লাল সিংহকে। যাঁরা বিদ্রোহী সৈন্যদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে উমরাও সিংহ, রঘুনাথ সিংহ, রাজমুণ্ড তেওয়ারি ও ঘামাণ্ডি সিংহকে প্রধান করা হয়েছিল সেনাবাহিনীর বিভিন্ন শাখার। মুঘল বাদশা বাহাদুর শাহ জাফরকে তাঁর সম্রাট বলে মেনে নিলেন রাজা বিরজিস কদর। তীরন্দাজ গুরু বখশ, নবাব আলি খানদের নিয়ে পরিকল্পনায় বসলেন তিন মূর্তি—রাজা জয়লাল সিংহ, মৌলবি আহমদুল্লাহ শাহ ও মাম্মু খান। ওই সময়ে ৩৬ হাজার সৈন্য সংখ্যা ছিল হজরত মহলের অধীনস্থ।
১৮৫৭ সালের শেষ দিকে বদলাতে শুরু করেছিল পরিস্থিতি। যে স্থানগুলোয় বিদ্রোহ শুরু হয়েছিল, সেগুলোকে দখল করে নেয় ইংরেজরা। বিদ্রোহী সেনাদের মনোবল ভেঙে ফেলতে কোম্পানি শুরু করে অকথ্য অত্যাচার। ওই সময় লখনৌর কাছে আলমবাগ প্যালেসে জেমস উট্রাম-এর নেতৃত্বে ইংরেজদের একটা ঘাঁটি তৈরি করেছিল। বহু বার বিপ্লবী বাহিনী আক্রমণ করলেও সেই ঘাঁটি দখল করতে সক্ষম হয়নি। এই দিকে কলিন ক্যাম্পবেল উন্নত সামরিক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আক্রমণ করেন অওধ। বেগম হাতির পিঠে সামনে থেকে লড়াই চালিয়ে যান। তাঁর সাথে যুক্ত হন ইংরেজদের ত্রাস বিপ্লবী আহমদুল্লাহ এবং নানাসাহেব।
শত চেষ্টার পরেও পরাজিত হতে হয়েছিল বেগমকে। যুদ্ধে আহমদুল্লাহ নিহত হন ইংরেজ বাহিনীর হাতে। নানাসাহেবও দুর্ভাগ্যের শিকার হন। ওই সময় অর্থের লোভে বেগমের সাথে বিশ্বাসঘতকতা করেন রাজা লালমাধব সিংহ ও বেণীমাধব। যার ফলে ভেঙে পড়ে বেগমের সেনার মনোবলও। তবুও তিনি প্রায় এক বছর ধরে প্রতিরোধের লড়াই চালিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি চাইলেই কোম্পানির শর্ত মেনে নিয়ে তাঁর ভবিষ্যৎ জীবন কাটাতে পারতেন নবাবের মতো পেনশনভোগী হয়ে। কিন্তু তা তিনি করেন নি। ওই রাজ্যে পরাধীন ভাবে তিনি জীবন কাটাতে চান না বলে, বিপদের ঝুঁকি নিয়ে নেপালের কাঠমান্ডুতে আশ্রয় নেন তিনি এবং তাঁর পুত্র বিরজিস কদরকে সাথে নিয়ে। এমনকি লখনউ ছেড়ে নেপাল যাওয়ার পথেও রাজ্য উদ্ধারের চেষ্টা চালিয়েছিলেন।
৭ এপ্রিল ১৮৭৯ সালে নেপালের কাঠমাণ্ডুতে মৃত্যুবরণ করেন এই মহীয়সী নারী। একাধিক তথ্য বিশ্লেষণ করে লেখা এই নিয়ে দ্বিমত থাকতে পারে। পাশাপাশি সেইসময় সঠিক ছবি দেওয়ার চেষ্টা করা হল, কারণ তাঁর ছবি নিয়েও অনেক মতামত রয়েগেছে।