চীনকে হারানো সম্ভব নয়। বিকল্প ছক?
রাজেশ রায় :— যেকোনও প্রতিযোগিতা জিততে হলে সবসময় যে বিপক্ষের সব পদক্ষেপ নকল করতে হবে তা নয়। কারন বিপক্ষ যাতে শক্তিশালী সেটা আপনার দুর্বলতাও হতে পারে। এর জন্য দরকার সময় নষ্ট না করে আপনি নিজে যাতে শক্তিচালী সেটা ব্যবহার করা। জিওপলিটিক্স ও ঠিক তাই। বর্তমানে আমেরিকার ও চীনের মধ্যে খানিকটা আধিপত্যের লড়াই চলছে। চীন তার বিআরআই বা বেল্ট রোড ইনিশিয়েটিভ প্রজেক্টের মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ জুড়ে ব্যাপক ইনফ্রাস্ট্রাকচার তৈরি করছে, এই প্রজেক্টের অধীনে রাস্তা, বন্দট, বিমানবন্দর তৈরি তো হচ্ছেই সাথে সাথে ডিজিটাল ইনফ্রাস্ট্রাকচার ও তৈরি হচ্ছে। চীন ছোট ছোট দেশ গুলোকে প্রচুর লোন দিচ্ছে যখন দেশ গুলো সেই বিপুল অর্থ শোধ করতে পারছে না তখন বাধ্য হয়ে দেশ গুলোতে নিজের প্রভাব বাড়াচ্ছে চীন। এতে সমস্যা হচ্ছে যে ওই দেশ গুলোট সাথে বাকী যে দেশ গুলোর সম্পর্ক আছে তারাও ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। চীন চায় এভাবে বিশ্বে তার আধিপত্য বিস্তার হোক। বিভিন্ন সময়ে বিশ্বে বড় বড় শক্তিগুলো তাদের আধিপত্য বিস্তার করেছে। যেমন আঠারো-উনিশ শতক জুড়ে ব্রিটেনের প্রভাব গোটা বিশ্বে ছিল। এই জন্য বলা হত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে কোনওদিন সূর্য অস্ত যায় না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে এখনও অবধি বিশ্বে আমেরিকার আধিপত্য রয়েছে। আমেরিকার মুদ্রা ডলার যথেষ্ট শক্তিশালী। চীন চায় তার ইনফ্রাস্ট্রাকচারের মাধ্যমে বিশ্বে প্রভাব বিস্তার করতে। চীনকে আটকানোর জন্য দরকার একটি নির্দিষ্ট পরিকল্পনা। যদি কেউ ভেবে থেকে বিআরআই প্রজেক্টকে আটকানোর জন্য ওরকমই কোন প্রজেক্ট শুরু করা উচিত, তাহলে সেটা সবচেয়ে বড় ভুল কারন আগেই বলেছি বিপক্ষকে নকল করে লাভ হবে না। এই সেক্টরে চীন শক্তিশালী এটা মানতেই হবে, যতক্ষন না প্রতিপক্ষের শক্তি সম্পর্কে অবগত না হওয়া যায় ততক্ষন তাকে হারানো সম্ভব নয়। তাহলে বিকল্প উপায় কী হতে পারে?
আমেরিকা জানিয়েছে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশ গুলো চীনের ফাঁদে পা দেয় কারন তাদের দরকার ইনফ্রাস্ট্রাকচার ও কারিগরি সহায়তা, চীন তাদের সেটাই দেয়। আমেরিকার লক্ষ এই সব দেশ গুলোকে যদি সেটাই দেওয়া হয় আরও ভাল শর্তে তাহলে হয়ত চীনের প্রভাব কমতে পারে। চীন এইসব দেশ গুলোতে ব্রিজ, পাওয়ার প্ল্যান্ট, রেল, বন্দর সহ ফাইভজি নেটওয়ার্ক ও তৈরি করছে, এটাই ডিজিটাল ইনফ্রাস্ট্রাকচার। এর মাধ্যমে এইসব দেশে চীনা সংস্থা গুলোর প্রভাব বাড়ছে। ইতিমধ্যেই চীনের লোনের ফাঁদে পড়েছে পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, লাওসের মতন দেশ। চীনের অর্থনীতি নির্ভর করে রপ্তানির উপর। চীন এর জন্য ইনফ্রাস্ট্রাকচার নির্মানের মাধ্যমে সেইসব দেশ গুলোর বাজার দখল করছে যাতে চীনা পন্য বিক্রি করা যেতে পারে। বিআরআই প্রজেক্টে সবচেয়ে বেশী প্রজেক্ট ও বিনিয়োগ পাকিস্তানেই হচ্ছে, এরপর আছে ইন্দোনেশিয়া ও কাজাখিস্তান। অন্যদিকে এই মহূর্তে সবচেয়ে বেশী চীনা লোন রয়েছে পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া ও ভিয়েতনামের উপর।
২০২১ সালের জুন মাসে আমেরিকান রাষ্ট্রপতি জো বাইডেন বিথ্রিডব্লু বা বিল্ড ব্যাক বেটার ওয়ার্ল্ড প্রজেক্ট। এখনে ব্যাক বা ফিরে আসার অর্থ করোনা মহামারীতে যে গোটা বিশ্বে অর্থনৈতিক সংকোচন হয়েছিল সেখান থেকে বেড়িয়ে আসা। এর জন্য জি-৭ দেশ গুলো ইনফ্রাস্ট্রাকচার ও অর্থনৈতিক সাপোর্ট করবে নিম্ন আয়ের দেশ গুলোকে। বিথ্রিডব্লুর প্রধান লক্ষ হচ্ছে পরিবেশ, স্বাস্থ্য, ডিজিটাল টেকনোলজি ও ইনফ্রাস্ট্রাকচার। বিআরআই প্রজেক্টের সাথে এট পার্থক্য হচ্ছে, আমেরিকা জানিয়েছে বিথ্রিডব্লুতে কোন প্রজেক্ট করতে গেলে সেটা স্থানীয় মানুষদের অর্থনৈতিক বিকাশ ঘটাতে পারবে কীনা, পরিবেশের উপর কেমন প্রভাব ফেলবে তা দেখা হবে। ধরুন কোন দেশে রাস্তা নির্মান করা হবে আদবেও সেই রাস্তার দরকার আছে কীনা তা দেখা হবে। এই সমস্ত কীছু বিশ্লেষনের পরই কাজ শুরু হবে। চীনের বিআরআই এর আওতায় এসব কীছুই দেখা যায় না এর জন্য ইতিমধ্যেই ৩৫ টি প্রজেক্ট বাতিল হয়ে গেছে৷ বিথ্রিডব্লুতে দেশটির সরকারের সাথে যৌথভাবে নজর রাখা হবে যাতে দুর্নীতি না হয়। চীনের বিআরআইতে ইতিমধ্যেই প্রচুর দুর্নীতি ধরা পড়েছে। বিথ্রিডব্লুতে দেশ গুলোর সাথে স্ট্রাটেজিক সম্পর্ক গড়ে তোলা হবে। অনেক দেশে দুর্লভ আর্থ ধাতু, তেল, প্রাকৃতিক গ্যাস পাওয়া যায়, সেসবের নিরাপত্তা আমেরিকা দেবে এই প্রজেক্টে।
আমেরিকা, জাপান ও অস্ট্রেলিয়া যৌথ ভাবে ব্লু ডট নেটওয়ার্ক নামে একটি সংস্থা তৈরি করেছিল যার কাজ বিশ্ব জুড়ে বিভিন্ন ইনফ্রাস্ট্রাকচার প্রজেক্টের অনুমোদন দেওয়া। এই ব্লু ডট নেটওয়ার্ক কে বিথ্রিডব্লুর আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। বিআরআই প্রজেক্ট চীন ২০১৩ সালে লঞ্চ করে যাতে মোট ১৫০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের কথা বলা হয়েছিল প্রাথমিক ভাবে। চীন জানিয়েছে এর মাধ্যমে এনার্জি ও পন্য পরিবহন সুবিধা হবে। আসলে এর মাধ্যমে চীন নিজের পন্যের চাহিদা বাড়াতে চলেছে। বিআরআই প্রজেক্টের জন্য চীন কোন দেশে বিনিয়োগের জন্য পাঁচটি পদক্ষেপ নিয়েছে। প্রথমে সেই দেশটির সরকার এই প্রজেক্টের জন্য নতুন নীতি তৈরি করছে, এরপর চীনের সাথে বানিজ্যিক সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে, তারপর রোড, ব্রিজ, বন্দর তৈরি করা হচ্ছে কারন যোগাযোগ দরকার, এরপর চীনের সংস্কৃতি সেই দেশের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে যেমন পাকিস্তানের সমস্ত জায়গায় উর্দুর পাশাপাশি চাইনিজ ভাষার ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং সবশেষে সেই দেশটির ভাল দ্রব্য বা খনিজ চীন কম মূল্যে কীনে নিচ্ছে।
এবার দেখা যাক চীনের এই বিআরআই প্রজেক্টের এত সমালোচনা কেন হচ্ছে :– ১) এই প্রজেক্টকে লোনের ফাদ বলা হচ্ছে। ইতিমধ্যেই ৪২ টি দেশের জিডিপির ১০ শতাংশ শুধু চীনেরই লোন। ২) এই প্রজেক্টে তৈরি ইনফ্রাস্ট্রাকচারের সবচেয়ে বেশী শেয়ার প্রায় ৯৩ শতাংশই থাকে চীনের কোম্পানি গুলোর হাতে ফলে সেই দেশের প্রাইভেট সংস্থা গুলোর ক্ষতি হচ্ছে। ৩) চীন অর্থনীতির উপর জোর দেয় কিন্তু পরিবেশ কতটা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে সেটা চীন লক্ষ করে না। ৪) গত নভেম্বরে চীনের প্রেসিডেন্ট শী জিনপিং বলে চীন বিআরআইয়ে এবার শুধু দরকারী প্রজেক্টেই নজর দেবে। আসলে এই প্রজেক্টের আওতায় চীনের ৩৫ শতাংশ প্রজেক্ট ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ৫) এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার বহু দেশ চীনের লোনের ফাঁদে না পড়ার জন্য চীনা প্রজেক্টে অংশ নিচ্ছে না। এসব কারনে চীনের বিআরআই প্রজেক্টকে ব্যার্থ বলছে অনেক বিশেষজ্ঞ। বিথ্রিডব্লু এর নাম পরিবর্তনের কথা চলছে। হতে পারে নতুন নাম হবে পার্টনারশিপ ফর গ্লোবাল ইনফ্রাস্ট্রাকচার। তবে বিথ্রিডব্লুকেও ব্যার্থ বলা হচ্ছে কারন আগেই বলা হয়েছে যে যেই সেক্টরে শক্তিশালী তাকে সেভাবেই কাজ করা দরকার। বিথ্রিডব্লুতে এখনও পর্যন্ত আমেরিকা ডিজিটাল ইনফ্রাস্ট্রাকচার ও সাইবার সিকিউরিটি সেক্টরে ৩.৪৫ মিলিয়ন ডলার, সোলার এনার্জি সেক্টরে ২.৩ মিলিয়ন ডলার এবং শিশু সুরক্ষায় ৫০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের কথা ভাবছে।
২০১৩ সালে শুরু হওয়া বিআরআইয়ে এখনও পর্যন্ত ৭৫০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ হয়ে গেছে। তাহলে ভাবুন এক্ষেত্রে ফান্ডিং এ চীনের সাথে টেক্কা দেওয়াই মুশকিল। দেখুন ইনফ্রাস্ট্রাকচারে চীনের সাথে পাল্লা দেওয়া কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। আমেরিকা যেটায় শক্তিশালী সেটা করুক যেমন অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আমেরিকা যথেষ্ট শক্তিশালী। ছোট দেশ গুলো চীনের ফাঁদে পড়ে কারন তারা সহজে বিশ্ব ব্যাঙ্ক, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্ক, আফ্রিকান ব্যাঙ্ক থেকে লোন পায় না। যার জন্য বাধ্য হয়ে তারা চীনের শরণাপন্ন হয়। চীন শুধু লোন দেয়ই না বরং এসব প্রজেক্ট বানিয়েও দেয়। সুতরাং আমেরিকা সহ জি-৭ দেশ গুলোর উচিৎ এইসব ছোট দেশ গুলো যাতে সহজেই লোন পায় সেব্যবস্থা করা। তবে আমেরিকা কীছু পদক্ষেপ নিচ্ছে যেমন আমেরিকার একটি প্রজেক্ট রয়েছে পাওয়ার আফ্রিকা যাতে এই অঞ্চলে লক্ষ লক্ষ ঘরে কম খরচে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হবে। ব্লু ডট নেটওয়ার্ক তো কাজ করছেই আলাদা ভাবে। এছাড়া ইন্দো প্যাসিফিক অঞ্চলের ছোট দেশ গুলোর উন্নয়নে আমেরিকা আলাদা ভাবে কাজ করছে। তবে বিআরআই এর থেকে বিথ্রিডব্লু একটু আলাদা কারন এখানে প্রজেক্টের দায়িত্বে আছে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা কিন্তু বিআরআইয়ে দায়িত্বে আছে সরকারী সংস্থা গুলো।
আমেরিকার বক্তব্য প্রাইভেট সংস্থা থাকলে প্রতিযোগিতা বাড়বে এবং দুর্নীতি কম হবে। এবার আসা যাক কেন দেশ গুলো বিশ্ব ব্যাঙ্ক থেকে চীনের উপর ভরসা করে। বিশ্ব ব্যাঙ্ক কোনও জায়গায় বিনিয়োগ করবার আগে সেখানে টেন্ডার ডাকে। ধরুন কেনিয়াতে ২০০০ কোটি টাকার কোন প্রজেক্ট হবে সেখানে বিশ্ব ব্যাঙ্ক প্রথমে টেন্ডার ডাকবে এবং বিজেতা সংস্থাটিকে বিশ্ব ব্যাঙ্ক টাকা দেবে, ওই দেশটিকে দেবে না। তাও পুরো টাকা একবারে দেওয়া হয় না, প্রথমে ৫০০ কোটি টাকা পাঠানো হবে এরপর কাজের রিপোর্ট দেখে আবার একটু টাকা পাঠানো হবে। এভাবে ধাপে ধাপে টাকা পাঠানো হয়। কিন্তু শুনকে অবাক হবেন বিশ্ব ব্যাঙ্কেও চীনের আধিপত্য রয়েছে। শুধু ২০২০ সালেই বিশ্ব ব্যাঙ্কের মাধ্যমে চীন ২.৩ বিলিয়ন ডলারের ইনফ্রাস্ট্রাকচার তৈরি করেছে। বিশ্বের প্রথম সারির ২০ টি কনস্ট্রাকশন কনট্রাকটরের মধ্যে ১৪ টি চীনের এবং ছয়টি ইউরোপের। এখানে আমেরিকার স্থানই নেই। সুতরাং বুঝতেই পারছেন ইনফ্রাস্ট্রাকচারের ক্ষত্রে চীন কতটা আগে। এবার মনে হতে পারে চীন কেন এতটা আগে? দেখুন চাইনিজ সরকার তাদের এসব কনস্ট্রাকশন সংস্থাকে প্রচুর সাবসিডি দেয় যার জন্য এই কোম্পানি গুলো আজ এত বড় হয়েছে। এখন আমেরিকাও ঠিক করেছে তারাও তাদের সংস্থা গুলোকে এরকমই সাবসিডি দেবে। দেখুন আমেরিকাও সেই চীনের মত একই নীতি নিতে চাইছে। যেই সেক্টরে চীন এতটা আগে সেখানে নতুন করে প্রতিযোগিতা করে কী লাভ? আমেরিকা সহ জি-৭ দেশ গুলোর উচিৎ আরও বেশী ফান্ডিং জোগার করা৷ চীন কে টেক্কা দিতে হলে আগামী পাঁচ বছরে ইনফ্রাস্ট্রাকচারে ১.৪ ট্রিলিয়ন এবং আগামী দশ বছরে অন্তত ৩.৪ ট্রিলিয়ন ডলার ফান্ডিং লাগবে।