অফবিট

লাদাখে চীনের বিরুদ্ধে ডিআরডিও এর তৈরি  জোটাওয়ার ট্যাঙ্ক ব্যবহারের পথে ভারতীয় সেনাবাহিনী?

অবশেষে ভারতীয় সেনাবাহিনী দীর্ঘদিনের দাবী প্রজেক্ট জোরাওয়ার সফল হয়েছে। ডিআরডিও সম্প্রতি ভারতের নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরি হালকা ব্যাটেল ট্যাঙ্ক জনসমক্ষে এনেছে, এর নামই জোরাওয়ার। ভারতীয় সেনাবাহিনীর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন এই ট্যাঙ্ক। ভারত ও চীন সীমান্ত বা এলএসিতে এই ট্যাঙ্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন। এলএসি বা লাইন অফ অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল যথেষ্ট উচ্চতায় অবস্থিত হওয়ায় এখানে হালকা ট্যাঙ্কের প্রয়োজন। ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে থাকা টি ৯০, অর্জুন মার্ক ১ এর মতো ট্যাঙ্কগুলো অত্যন্ত ভারী হওয়ায় এগুলো এলএসিতে ততটা কার্যকর নয়। এই জন্য এতদিন এলএসিতে চীন ট্যাঙ্কের বিচারে ভারতের থেকে সুবিধাজনক অবস্থানে ছিল। সেজন্য বহুদিন ধরেই ভারতীয় সেনাবাহিনী হালকা ট্যাঙ্কের দাবী করে আসছিলো। অবশেষে এলএসিতে এবার ভারতও নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরি জোরাওয়ার ট্যাঙ্ক মোতায়েন করবে যা এলএসিতে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে আরও শক্তিশালী করবে চীনের বিরুদ্ধে। 

গত শনিবার গুজরাটের হাজিরাতে ডিফেন্স রিসার্চ এন্ড ডেভলপমেন্ট অর্গানাইজেশন বা ডিআরডিও হালকা ব্যাটেল ট্যাঙ্ক জোরাওয়ারকে পরীক্ষা করা হয়। ডিআরডিও এবং এল এন্ড টি যৌথভাবে জোরাওয়ার তৈরি করেছে। এই ট্যাঙ্কের পরীক্ষার জন্য ডিআরডিও এর প্রধান ডঃ সমীর ভি কামাট নিজে উপস্থিত ছিলেন হাজিরাতে। তিনি বলেছেন এটি খুবই স্মরনীয় দিন, মাত্র দুই, আড়াই বছর সময়ের মধ্যে এরকম ট্যাঙ্ক নির্মান করা মোটেও সহজ কাজ ছিলনা। আগামী ছয় মাস ধরে এই ট্যাঙ্কের বিভিন্ন পরীক্ষা করা হবে। এরপর ট্যাঙ্কটিকে সেনাবাহিনী পরীক্ষা করবে। 

২০২৭ সালে জোরাওয়ার ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যুক্ত হবে। পূর্ব এলএসিতে লাদাখ অঞ্চলে চীনের বিরুদ্ধে এই ট্যাঙ্ক ভারতের প্রয়োজন। ডোকলাম, গালওয়ান উপত্যকার মতোন ঘটনার পর থেকে এলএসিতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর জন্য হালকা ট্যাঙ্ক আবশ্যক হয়ে পড়েছে। উনিশ শতকে ডোগরা জেনারেল জোরাওয়ার সিং লাদাখ ও পশ্চিম তিব্বতে সামরিক অভিযান করেছিলেন। কাশ্মীরের রাজপুত রাজা গুলাব সিং এর সেনাপতি ছিলেন তিনি। লাদাখ ও বালতিস্তান তিনি জয় করেছিলেন। এই জন্য তাকে লাদাখের রাজাও বলা হয়। তাকে ভারতের নেপোলিয়নও বলা হত।

সেই জেনারেল জোরাওয়ার সিং এর সম্মানেই ডিআরডিও এই ট্যাঙ্কের নাম জোরাওয়ার রেখেছে। ভারতীয় সেনাবাহিনীতে থাকা টি ৭২, টি ৯০ ট্যাঙ্কগুলোর তুলনায় জোরাওয়ারের ওজন প্রায় অর্ধেক। হালকা ওজনের কারনে এই ট্যাঙ্কটি পাহাড়ি ভূমিতে সহজেই চলাচল করতে সক্ষম, তাছাড়া পাহাড়ি নদীও এই ট্যাঙ্কটি অতি সহজেই অতিক্রম করতে পারে। জোরাওয়ার ট্যাঙ্কের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এটি অ্যাম্ফিবিয়াস ট্যাঙ্ক অর্থাৎ এটি স্থলভাগের পাশাপাশি অগভীর জলভাগেও সহজেই যাতায়াত করতে সক্ষম। ডিআরডিও এর ট্যাঙ্ক ল্যাব ডিরেক্টর রাজেশ কুমার বলেছেন ওজনের উপর নির্ভর করে তিন ধরনের ট্যাঙ্ক তৈরি করা হয়, ১) ভারী ট্যাঙ্ক- এই ধরনের ট্যাঙ্ক নিজের ভূভাগে আক্রমন প্রতিরোধের জন্য ব্যবহৃত হয়। ২) মাঝারি ট্যাঙ্ক- এই ধরনের ট্যাঙ্ক শত্রুর বিরুদ্ধে আক্রমনে ব্যবহার হয়। ৩) হালকা ট্যাঙ্ক – এই ধরনের ট্যাঙ্ককে মিশ্র ট্যাঙ্ক বলা হয়। এইরকম ট্যাঙ্ক শত্রুর উপর আক্রমনের পাশাপাশি নিজ দেশের ভূভাগ রক্ষা করতেও সক্ষম। প্রাথমিক ভাবে ৫৯টি জোরাওয়ার ট্যাঙ্কের অর্ডার দিয়েছে ভারতীয় সেনাবাহিনী। পরবর্তীকালে আরও ৩৫৪টি ট্যাঙ্ক কেনা হবে। চীনের কাছে ইতিমধ্যেই এলএসিতে টাইপ ১৫ ট্যাঙ্ক রয়েছে। এবার ভারতের জোরাওয়ার ট্যাঙ্ক চীনের টাইপ ১৫ এর যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী হবে। 

জোরাওয়ার ট্যাঙ্কে বেলজিয়ামের জন ককেরিল সংস্থার তৈরি ১০৫ মিলিমিটার গান রয়েছে যা অ্যান্টি ট্যাঙ্ক গাইডেড মিসাইল ফায়ার করতেও সক্ষম। আমেরিকার কামিন্স নামক সংস্থার তৈরি ৭৫০ হর্স পাওয়ার যুক্ত ডিজেল ইঞ্জিন রয়েছে এই জোরাওয়ার ট্যাঙ্কে। শত্রুর মিসাইল আক্রমনের বিরুদ্ধে সুরক্ষা দিতে এই ট্যাঙ্কে একটি শক্তিশালী আর্মার রয়েছে। এই ট্যাঙ্কের আরও একটি গুরুত্বপূর্ন বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ট্যাঙ্কটির সাথে ড্রোন সিস্টেম যুক্ত করা হয়েছে। পূর্ব লাদাখ অঞ্চলে গালওয়ান উপত্যকাতে ভারত ও চীনের সেনাবাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষের পর থেকেই উভয়পক্ষই এলএসিতে সারফেস টু এয়ার মিসাইল, ট্যাঙ্ক, আর্টিলারি মোতায়েন করেছিল। চীন সেসময় হালকা ট্যাঙ্ক মোতায়েন করেছিল কিন্তু তখন ভারতের কাছে হালকা ট্যাঙ্ক ছিলনা যার জন্য প্রজেক্ট জোরাওয়ারকে শুরু করা হয়। এই মহূর্তে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে তিন ধরনের ট্যাঙ্ক রয়েছে অর্জুন মার্ক ১এ ট্যাঙ্ক যার ওজন ৬৮.৫ টন, এটা খুবই ভারী ট্যাঙ্ক, টি ৯০ ট্যাঙ্কের ওজন ৪৬ টন এবং টি ৭২ ট্যাঙ্কের ওজন ৪৫ টন। এই ধরনের ট্যাঙ্ক মূলত মরুভূমি ও সমতল ক্ষেত্রে ব্যবহারের উপযোগী কিন্তু উচ্চ পার্বত্যঞ্চলে এই ধরনের ট্যাঙ্ক ততটা কার্যকরী নয়। ভারতের কাছে নিজস্ব হালকা ট্যাঙ্ক তৈরির থেকেও রাশিয়া থেকে স্প্রুট হালকা ট্যাঙ্ক কেনার বিকল্প ছিল। কিন্তু রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে রাশিয়া তার সর্বশক্তি ইউক্রেন যুদ্ধেই নিয়োজিত করে। যার জন্য অন্যকোনও দেশের উপর নির্ভরশীল না থেকে ভারত সরকার দেশেই নিজস্ব প্রযুক্তিতে ট্যাঙ্ক তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়। ২০২২ সালের মার্চ মাসে ভারত সরকার এই প্রজেক্টের অনুমোদন দেয় যা দুই বছরের মধ্যে সম্পূর্ন হয়ে গেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *