অ্যান্টার্কটিকাতে নৌসেনা ঘাঁটি তৈরি করছে ইরান
বিশ্বের দক্ষিন মেরুতে অবস্থিত পৃথিবীর সাতটি মহাদেশের একটি মহাদেশ অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশ। ১,৪২,০০,০০০ বর্গকিলোমিটার আয়তন বিশিষ্ট অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশের বেশীরভাগ ভূভাগই বরফাচ্ছাদিত। আয়তনের হিসাবে বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম মহাদেশ অ্যান্টার্কটিকার আয়তন ইউরোপ মহাদেশের থেকেও ৪০ শতাংশ বেশী। অ্যান্টার্কটিকা পৃথিবীর সবচেয়ে শীতলতম স্থান এখানে শীতকালে তাপমাত্রা -৮৯.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা বেড়ে হয় ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অ্যান্টার্কটিকাতে বিশ্বের ৭০ শতাংশ পানীয় জলের ভান্ডার বরফের হিমবাহের আকারে রয়েছে। অত্যাধিক ঠান্ডা ও বরফের কারনে এখনে কোনও মানুষ বসবাস করেনা, শুধুমাত্র গবেষনার কাজ হয়। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশকে বিশ্বের কোনও দেশ নিজের বলে দাবী করতে পারবেনা কিন্তু সম্প্রতি ইরান অ্যান্টার্কটিকাতে তাদের অধিকার দাবী করেছে এবং এখানে একটি নৌ ঘাঁটি তৈরি করবার পরিকল্পনা করেছে। অ্যান্টার্কটিকাতে অনেক দেশেরই ঘাঁটি রয়েছে কিন্তু এগুলো সবই পরীক্ষাকেন্দ্র। এখনও পর্যন্ত এখানে কোনও দেশের সামরিক ঘাঁটি নেই। ইরানের এই সিদ্ধান্ত অ্যান্টার্কটিকার জীব বৈচিত্র্য ও বাস্তুতন্ত্রের জন্য যথেষ্ট চিন্তার কারন।
ইরানের নৌবাহিনীর প্রধান অ্যাডমিরাল শাহরাম ইরানি ঘোষনা করেছে দক্ষিন মেরুতে অবস্থিত অ্যান্টার্কটিকাতে তাদের অধিকার রয়েছে এবং ইরান সেখানে সামরিক কাজ করবে এবং পরীক্ষামূলক কাজ করবে। এর পাশাপাশি ইরান এখানে একটি নৌঘাঁটিও তৈরি করবে। যার জন্য ইরানের এই দাবীকে কেন্দ্র করে নতুন করে বিশ্বরাজনীতি উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে।
১৮২০ সালে মিখাইল লাজারেফের নেতৃত্বে একটি রাশিয়ান অভিযানের সময় অ্যান্টার্কটিকার খোঁজ পাওয়া যায় সর্বপ্রথম। এরপর পরবর্তী একশো বছর ধরে ব্রিটিশ, ফ্রান্স, নরওয়ে ও মার্কিন অভিযাত্রীরা পৃথিবীর দক্ষিন মেরুতে বারবার অভিযান করে অ্যান্টার্কটিকা সম্পর্কে আরও তথ্যের জন্য এবং বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন দেশ অ্যান্টার্কটিকাকে তাদের অংশ বলে দাবী করেছিল। এই সমস্যা সমাধানের জন্য ১৯৫৯ সালের ১ ডিসেম্বর অ্যান্টার্কটিকা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ওয়াশিংটনে সর্বপ্রথম এই চুক্তির কথা শুরু হয়েছিল।
আর্জেন্টিনা, অস্ট্রেলিয়া, বেলজিয়াম, ব্রিটেন, চিলি, ফ্রান্স, জাপান, নিউজিল্যান্ড, নরওয়ে, দক্ষিন আফ্রিকা, আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়ন এই বারোটি দেশ প্রথমদিকে এই চুক্তিতে সাক্ষর করেছিল। এই বারোটি দেশ অ্যান্টার্কটিকাতে ৫৫টি গবেষনা কেন্দ্র তৈরি করেছে। এই চুক্তিতে বলা হয় কোনওদেশ অ্যান্টার্কটিকাতে সামরিক ঘাঁটি তৈরি এবং কোনওরকম অস্ত্র পরীক্ষা করতে পারবেনা। অ্যান্টার্কটিকাতে শুধুমাত্র বৈজ্ঞানিক গবেষনার কথা বলা হয় এই চুক্তিতে। এমনকী তেজস্ক্রিয় বর্জ্যপদার্থ অ্যান্টার্কটিকাতে না আনার কথাও বলা হয় চুক্তিতে। এই চুক্তির প্রধান উদ্দেশ্য ছিল অ্যান্টার্কটিকার বরফ যাতে গলে না যায়, কারন এখানে বরফ গলে গেলে বিশ্বের গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির পাশাপাশি সমুদ্রে জলতল ৬০ মিটার বা ২০০ ফুট বেড়ে যাবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সোভিয়েত ইউনিয়ন ও আমেরিকার মধ্যে ঠান্ডা যুদ্ধ শুরু হয়েছিল। এরকম পরিস্থিতিতে অ্যান্টার্কটিকা চুক্তি ছিল শীতল যুদ্ধের সময় হওয়া প্রথম কোনও অস্ত্র নিয়ন্ত্রন চুক্তি যাতে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও আমেরিকা উভয়েই সই করেছিল। ১৯৬১ সালে এই চুক্তি কার্যকর করা হয়। এই চুক্তিতে অ্যান্টার্কটিকাতে কোনও দেশের একক অধিকারের বিষয়ে কিছু বলা হয়নি তবে চুক্তিতে বলা হয় ত্রিশ বছর পর পুনরায় চুক্তি সংশোধন করা হবে। সেইমতো ১৯৯১ সালে পুনরায় দেশগুলি একত্রিত হয় এবং এই চুক্তিতে একটি বিষয় যোগ করা হয়।
১৯৯১ সালে ঘোষনা করা হয় পরবর্তী পাঁচ দশক পর্যন্ত অর্থাৎ ২০৪১ সাল অবধি কোনও দেশ অ্যান্টার্কটিকাতে খনিজ ও তেল উত্তলোন করতে পারবেনা। ১৯৯১ সালে অ্যান্টার্কটিকার প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষা করার বিষয়েও জোর দেওয়া হয়। ২০১৯ সাল পর্যন্ত অ্যান্টার্কটিকা চুক্তিতে ৫৪টি দেশ স্বাক্ষর করেছে, যার মধ্যে ত্রিশটি দেশ এখানে স্থায়ী গবেষনা কেন্দ্র তৈরি করেছে। এখানে সবচেয়ে বেশী গবেষনা কেন্দ্র রয়েছে আর্জেন্টিনার। ভারতও অ্যান্টার্কটিকাতে তার গবেষনা কেন্দ্র তৈরি করেছে। ১৯৮১ সালে ভারত প্রথম অ্যান্টার্কটিকা কর্মসূচি শুরু করে। ১৯ আগস্ট, ১৯৮৩ সালে ভারত অ্যান্টার্কটিকা চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। ১২ সেপ্টেম্বর, ১৯৮৩ সালে ভারত পনেরোতম সদস্য হিসাবে এই চুক্তিতে যোগদান করে। এই বছরই ভারত অ্যান্টার্কটিকাতে প্রথম গবেষনা কেন্দ্র দক্ষিন গঙ্গোত্রী তৈরি করে। যদিও ১৯৯০ সালে এই কেন্দ্রটি বাতিল করে দেওয়া হয়। ১৯৮৯ সালে মৈত্রী নামে আরেকটি গবেষনা কেন্দ্র তৈরি করে ভারত অ্যান্টার্কটিকাতে। অ্যান্টার্কটিকাতে ভারতের তৈরি সর্বাধুনিক গবেষনা কেন্দ্রটি হচ্ছে ভারতী। অ্যান্টার্কটিকায় গবেষনা কেন্দ্র তৈরি করা প্রধান নয়টি দেশের মধ্যে একটি ভারত।
ইরানে পবিত্র প্রতিরক্ষা সপ্তাহ উপলক্ষে অ্যাডমিরাল শাহরাম ইরানি ইরান নৌবাহিনীর ৮৬ ফ্লোটিলা ডেস্ট্রয়ারে ঘোষনা করে খুব শীঘ্রই অ্যান্টার্কটিকাতে ইরানের পতাকা উড়বে এবং ইরান একটি গবেষনা দল পাঠাবে এখানে। অ্যান্টার্কটিকাতে বেস তৈরি করতে তলে চব্বিশ ঘন্টা সেই বেসের সাথে সংযোগ রক্ষা করা প্রয়োজন। ইরান জানিয়েছে তাদের সে সক্ষমতা রয়েছে। বেস তৈরি করবার জন্য ইরান অ্যান্টার্কটিকার পরিবেশ সম্পর্কে অধ্যায়নের জন্য একটি দল পাঠাবে সেখানে। গত বছর সেপ্টেম্বরেই ইরান ঘোষনা করেছিল তারা তাদের সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য আন্তর্জাতিক সমুদ্রে তাদের উপস্থিতি বৃদ্ধি করবে।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ইরানের সাথে কুটনৈতিক সুসম্পর্ক নেই আমেরিকার। ইরানের উপর নিষেধাজ্ঞাও জারি করেছে আমেরিকা। পারস্য উপসাগরে ইরানের জলসীমার কাছেই আমেরিকার নৌবহর মোতায়েন রয়েছে যা একেবারেই পচ্ছন্দ নয় ইরানের। এই কারনে ইরান তার নৌবাহিনীর ক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে আমেরিকার উপর চাপ বাড়াতে চাইছে। ইরান নৌবাহিনীর আরও এক কম্যান্ডার হাবিবুল্লাহ সায়েরি জানিয়েছে উত্তর মেরু থেকে শুরু করে দক্ষিন মেরু পর্যন্ত যেকোনও স্থানে ইরানের পতাকা উত্তোলন করতে তারা প্রস্তত। হাবিবউল্লাহ সায়েরি আরও জানিয়েছে ইরান কখনও অন্যদেশের জাল সীমায় প্রবেশ করবেনা এবং অন্যকোনও দেশকে তাদের জলসীমাতেও এক সেন্টিমিটার গভীরতায় প্রবেশ করতে দেবেনা। পরোক্ষভাবে হাবিবউল্লাহ এই কথাটি আমেরিকার উদ্দেশ্যেই বলেছে। কারন ইরানের কাছে একমাত্র আমেরিকান নৌবাহিনীর এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার রয়েছে। সামরিক বিশেষজ্ঞদের মতে আগামী কয়েক বছরে ইরান আমেরিকার উপকূলের কাছে আন্তর্জাতিক জলসীমাতেও তাদের যুদ্ধজাহাজ পাঠাবে। এর থেকে স্পষ্ট ইরান তাদের নৌশক্তি ক্ষমতা বাড়াতে যথেষ্ট আগ্রাসী বিশেষ করে আমেরিকার বিরুদ্ধে নৌশক্তি বৃদ্ধি করতে চাইছে ইরান।
২০০৮ সালেই আন্তর্জাতিক জলপথে ইরান তাদের নৌবাহিনীর উপস্থিতি বৃদ্ধি করতে শুরু করে। এডেন উপসাগরে ইরান ২০০৮ থেকেই তার বানিজ্যক জাহাজগুলোকে রক্ষা করার জন্য যুদ্ধজাহাজ পাঠানো শুরু করে। জীবুতির কাছে সোমালিয়া ও ইয়ামেনের মাঝে অবস্থিত এডেন উপসাগর একটি গুরুত্বপূর্ন সামুদ্রিক বানিজ্যপথ। কিন্ত সোমালিয়ার জলদস্যুদের কারনে এই অঞ্চলে বানিজ্যক জাহাজ প্রায়ই জলদস্যুদের আক্রমনের শিকার হয়। যার জন্য ইরান তাদের যুদ্ধজাহাজ এখানে পাঠানো শুরু করে। ২০০৮ সালেই ইরান প্রথমবারের জন্য লোহিত সাগর হয়ে সুয়েজ খাল হয়ে ভূমধ্যসাগরে তাদের দুটি যুদ্ধজাহাজকে পাঠিয়েছিল, এভাবে ভূমধ্যসাগরেও ইরান তাদের উপস্থিতি বোঝায়। এমনকী উত্তর ভারত মহাসাগরেও ইরানের উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে। তবে ইরানের অ্যান্টার্কটিকাতে সামরিক ঘাঁটি তৈরির সিদ্ধান্তকে অনেক বিশেষজ্ঞই সমালোচনা করেছে। কারন বলা হচ্ছে এটা অ্যান্টার্কটিকা চুক্তির বিরোধীতা যা পুরো এলাকার বাস্তুতন্ত্রের ক্ষতিসাধন করবে। ইরানের উপর আমেরিকা বহুদিন ধরেই নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে যার জন্য দীর্ঘদিন ধরেই ইরানের বহু বৈদেশিক মুদ্রা কাতার সহ অনেক দেশে আটকে রয়েছে যা ইরান ব্যবহার করতে পারেনা। কিন্তু সম্প্রতি আমেরিকান প্রশাসন ইরানকে মানবিক সহায়তার জন্য ইরানের ছয় বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রার উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে ইরান এই অর্থ দিয়ে অ্যান্টার্কটিকাতে সামরিক ঘাঁটি তৈরি করতে পারে।