অফবিট

লাদাখকে ভারতের বাকী অংশের সাথে সারাবছর যুক্ত রাখতে অবাক করা প্ল্যান নরেন্দ্র মোদী সরকারের

শ্রীনগর থেকে লে এর যাত্রাপথে জাতীয় সড়ক ১ এর উপর অবস্থিত পশ্চিম হিমালয় পর্বতমালার জোজিলা গিরিপথ। ৩,৫২৮ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত এই জোজিলা গিরিপথ শ্রীনগর ও কার্গিলের মধ্যে সংযোগ রক্ষা করে। প্রতিবছর তুষারপাতের কারনে জোজিলা পাসের জাতীয় সড়ক ১ বরফাচ্ছাদিত হয়ে প্রায় ছয় মাস বন্ধ থাকে। তুষারপাতের কারনে নভেম্বর মাসের শেষ দিক থেকে সম্পূর্ন লাদাখ উপত্যকা সড়কপথে বাকী দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। জুন মাস থেকে আবারও বরফ সরিয়ে নভেম্বরের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত পুনরায় লাদাখ পর্যন্ত রাস্তা সচল করা হয়। এই সমস্যা দূরীকরনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে ভারত সরকার জোজি লা টানেল প্রজেক্ট শুরু করেছে। ২০১৮ সালের মে মাসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এই টানেল নির্মানের সূচনা করেন। এই টানেল নির্মান সম্পূর্ন হলে সারা বছরই সড়কপথে লাদাখে যাতায়াত সম্ভব হবে, তাছাড়া প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রেও গেম চেঞ্জার হতে চলেছে এই টানেল।

পশ্চিম হিমালয় পর্বতমালার একটি গুরুত্বপূর্ন গিরিপথ জোজিলা পাস। তিব্বতীয় ও লাদাখের ভাষায় লা শব্দের অর্থ পাস বা গিরিপথ। তিব্বতীয় কিংবদন্তি অনুযায়ী জোজি শব্দ দ্বারা তিব্বতের চার ঋতুর দেবী দু ঝি লহাকে বোঝায়। আবার তিব্বতে কোথাও কোথাও দু ঝি লহাকে বিহারে বিক্রমশিলা মঠের বৌদ্ধ মহাসিদ্ধ নরোপার পত্নীও বলা হয়েছে। কালের পরিবর্তনে দু ঝি লহা শব্দটিই জোজিলা হয়ে গেছে। অতিরিক্ত তুষারপাতের কারনে জোজিলা পাসকে তুষার ঝড়ের পর্বতপথও বলা হয়। ২০০৮ সালে জোজিলা পাসে রেকর্ড মাত্রায় তুষারপাত হয়েছিল, ২০০৮ সালে এখানে ১৮ মিটার বা ৫৯ ফুট তুষারপাত হয়েছিল। ভারতের কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল লাদাখের কার্গিল জেলায় ১১,৫৭৫ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত এই জোজিলা পাসের একদিকে রয়েছে বালতাল যা সোনমার্গের দিকে অবস্থিত এবং অন্যদিকে রয়েছে দ্রাস অঞ্চলের মাতায়িয়ান। এই বালতাল থেকে অমরনাথের যাত্রা শুরু হয়। শ্রীনগর থেকে একশো কিলোমিটার দূরে অবস্থিত জোজিলা পাসের কাছে সবচেয়ে বড় দুটি শহর হচ্ছে সোনমার্গ ও কার্গিল। পৃথিবীর সবচেয়ে বিপদজনক গিরিপথ গুলির মধ্যে একটি হচ্ছে এই জোজিলা পাস। কারন এই সংকীর্ন গিরিপথের ধারে কোনও বাধা নেই যার কারনে গাড়ি নীচের গভীর খাদে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে, এছাড়া এখানে বছরের বেশীরভাগ সময় কনকনে ঠান্ডা বাতাস প্রবাহিত হয় এবং তীব্র তুষারপাত হয়। লাদাখ দুটি সড়ক মাধ্যমে ভারতের বাকী অংশের সাথে যুক্ত, একটি হচ্ছে শ্রীনগর জোজি লা পাস হয়ে এবং আরেকটি হচ্ছে লে থেকে মানালি পর্যন্ত সড়কপথে। কিন্তু শীতকালে এই দুই রাস্তাই পাঁচ থেকে ছয় মাসে বরফাচ্ছাদিত হয়ে বন্ধ থাকে, তখন লাদাখে একমাত্র বিমানে যাওয়া ছাড়া কোনও উপায় থাকেনা। জম্মু কাশ্মীর ও লাদাখ অঞ্চলে দুটি গুরুত্বপূর্ন গিরিপথ হচ্ছে ফোটু লা পাস এবং জোজিলা পাস। ফোটু লা পাসের পর জোজিলা পাস এই অঞ্চলের দ্বিতীয় উচ্চতম গিরিপথ। ফোটুলা পাসের উচ্চতা ১৩,৪৭৮ ফুট। বিআরও বা বর্ডার রোড অর্গানাইজেশন এখানে সর্বদা রাস্তা তৈরির দায়িত্বে রয়েছে। বিআরও শীতকালে ঘন বরফ পরিস্কার করে গাড়ি যাওয়ার পথ তৈরি করে, শীতকালে এখান দিয়ে গাড়ি চলাচলের সময় পথের দুধারে পুরু বরফের আচ্ছাদন থাকে। জোজিলা ও ফোটু লা পাসের মধ্যে জোজিলা পাসে সবচেয়ে বেশী তুষারপাত হয় যার জন্য জোজিলা পাস তাড়াতাড়ি বন্ধ হয়ে যায়। জোজিলা পাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার অর্থ পুরো লাদাখ উপত্যকাতেই উন্নয়ন থমকে যাওয়া। যদি লেতে কোনও প্রজেক্ট চলে তাহলে ছয় মাস প্রজেক্ট বন্ধ রাখতে হয় কারন সড়কপথে কাঁচামাল পাঠানো সম্ভব হয়না, আকাশপথে কাঁচামাল পাঠাতে গেলে খরচ অত্যাধিক বেড়ে যায়। আবার শীতকালে ছয় মাস এই পথ বন্ধ থাকলে জ্বালানি সরবরাহও সম্ভব হয়না লাদাখে। সেই জন্য এই অঞ্চলে জোজিলা টানেল শুরু হয়েছে যাতে সারাবছর লাদাখ উপত্যকার সাথে সংযোগ বজায় থাকে।

দুই লেন বিশিষ্ট জোজিলা টানেল উচ্চ পার্বত্যঞ্চলে অবস্থিত এশিয়ার সবচেয়ে দীর্ঘতম টানেল হতে চলেছে। ১৪.২ কিলোমিটার দীর্ঘ এই টানেল অটল টানেলের থেকেও দৈর্ঘ্যে বড়। সিঙ্গেল টিউব পদ্ধতিতে দুই লেন বিশিষ্ট এই টানেল তৈরি করা হচ্ছে অর্থাৎ একটি সূড়ঙ্গের মধ্যে যাওয়া ও আসার পথ তৈরি করা হচ্ছে। কাশ্মীর উপত্যকা থেকে লাদাখে যাওয়ার পথে জাতীয় সড়ক ১ এর উপরে অবস্থিত গুরুত্বপূর্ন জোজিলা পাসকে অতিক্রম করতে বর্তমানে তিন থেকে চার ঘন্টা সময় লাগে কিন্তু এই টানেল তৈরি হয়ে গেলে জোজিলা পাস অতিক্রম করতে মাত্র পনেরো মিনিট সময় লাগবে। 

১৯৯৭ সালে জোজিলা পাসে একটি টানেল তৈরির জন্য একটি জরিপ করা হয়েছিল কিন্ত সেসময় এই প্রজেক্টকে ততটা গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। ১৯৯৯ সালে কার্গিল যুদ্ধের সময় জোজিলা টানেলের গুরুত্ব অনুভব হয়। কারন এই জোজিলা পাস যে জাতীয় সড়ক ১ এর উপর অবস্থিত, সেই জাতীয় সড়ক ১ ভারত পাকিস্তান সীমান্ত এলওসি বা লাইন অফ অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোলের খুব কাছেই রয়েছে। পাকিস্তান কর্তৃক বোম্বিংএ জাতীয় সড়ক ১ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা ছিল। তাছাড়া জোজিলা পাস স্ট্র্যাটেজিক ভাবেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন। ১৯৪৭-১৯৪৮ সালে ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনারা লাদাখ দখলের জন্য জোজিলা পাস দখল করে নিয়েছিল। ১৯৪৮ সালের ১ নভেম্বর ভারতীয় সেনাবাহিনী জোজিলা পাস, কার্গিল ও দ্রাস পুনর্দখলের জন্য অপারেশন বাইসন শুরু করেছিল এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে জোজিলা পাস পুনর্দখল করেছিল ভারতীয় সেনাবাহিনী। শীতকালে ছয় মাস জোজিলা পাস বন্ধ থাকায় সমস্যায় পড়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীও। সেজন্য ২০০৫ সালে এখানে টানেল তৈরির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ২০১৩ সালে বিআরও এখানে একটি টানেল তৈরির জন্য পরিপূর্ন তথ্য দেয় ভারত সরকারকে। প্রথমে এই প্রজেক্ট পিপিপি মডেলে তৈরি করবার ঠিক ছিল কিন্তু পাঁচবার টেন্ডার ডেকেও কোনও বেসরকারী সংস্থা এই প্রজেক্টে আসেনি কারন এই টানেল নির্মান অত্যন্ত জটিল। ২০১৭ সালে চারটি বেসরকারী সংস্থা এলএন্ডটি, আইএলএফএস, জয়পি ইনফ্রাটেক এবং রিলায়েন্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার এই প্রজেক্টের জন্য বিড করে।

অক্টোবর, ২০১৮ সালে এই প্রজেক্টের দায়িত্ব দেওয়া হয় আইএলএফএসকে। এই আইএলএফএস এর আগে জম্মু ও কাশ্মীরে জাতীয় সড়ক ৪৪এ ৯.২৮ কিলোমিটার লম্বা ডঃ শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী টানেল তৈরি করেছিল যাকে চেন্নাই নাসরি টানেলও বলা হয়। কিন্তু ২০১৯ সালে আইএলএফএসের আর্থিক সংকট দেখা দেওয়ায়, ২০২০ সালে এই প্রজেক্ট দেওয়া হয় মেঘা ইঞ্জিনিয়ারিংকে এবং ১৫ অক্টোবর, ২০২০ সালে প্রজেক্টে কাজ শুরু হয়। ন্যাশনাল হাইওয়েস এন্ড ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন লিমিটেড বা এনএইচডিসিএল এই প্রজেক্টের দায়িত্বে আছে। এখন প্রজেক্টে ৩২.৭৮ কিলোমিটার রাস্তা তৈরি করা হচ্ছে যার মধ্যে ১৪.২ কিলোমিটার টানেল ও ১৮.৬৩ কিলোমিটার রাস্তা তৈরি করা হচ্ছে। জোজিলা টানেল বালতাল ও মিনামার্গকে সংযুক্ত করবে। প্রথমে এই প্রজেক্ট মোট ৬,৮০৮.৬৯ কোটি টাকা খরচের কথা হলেও পরবর্তীতে খরচ বেড়ে হয় ৮,৩০৮ কোটি টাকা। ২০২৭ এর মধ্যে এই প্রজেক্ট সম্পূর্ন হবে বলে লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। জোজিলা পাসে শীতকালে তুষারপাতের পাশাপাশি তাপমাত্রা -৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস হয়ে যায়। জোজিলা পাসের কাছাকাছি দ্রাস গ্রামকে ভারতের সবচেয়ে শীতলতম অঞ্চল বলা হয় যেখানে তাপমাত্রা মাইনাস ত্রিশ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত হয়ে যায়। এগারো হাজার ফুট উচ্চতায় এরকম তাপমাত্রায় কাজ করা সম্ভব নয় যার জন্য এই প্রজেক্টে সময় বেশী লাগছে। একটি আধুনিক টানেল হিসাবে তৈরি করা হচ্ছে জোজিলা টানেলকে। এই টানেলে ভেন্টেলেশন ব্যবস্থা সহ, সর্বদা বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা, সিসিটিভি ক্যামেরা, জরুরী আলো, রেডিও ব্যবস্থা থাকবে। এছাড়া জোজিলা টানেলে ফোন সংযোগ ব্যবস্থার পাশাপাশি অগ্নি নির্বাপক ব্যবস্থা থাকবে প্রতি ১২৫ মিটারে। এই টানেল নির্মান সম্পূর্ন হলে সোনমার্গ থেকে মিনামার্গ পৌঁছাতে মাত্র চল্লিশ মিনিট সময় লাগবে যা এখন যেতে চার ঘন্টা সময় লাগে। তাছাড়া এই টানেলের মাধ্যমে লাদাখে সৈন্য, অস্ত্র ও লজিস্টিক সরবরাহও আরও সহজ হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *