অফবিট

উরিতে সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের আগে শেষ ২৪ ঘন্টায় ঠিক কি ঘটেছিল?

দিনটা ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ভারত পাকিস্তান সীমান্ত এলওসি থেকে পাকিস্তানের ভিতর ৫০ কিলোমিটার গভীর জঙ্গলে ভারতীয় প্যারা এসএফ কম্যান্ডোদের একটি দল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সন্ত্রাসীদের গোপন প্রশিক্ষন কেন্দ্রের দিকে কড়া নজর রেখেছে। এই প্রশিক্ষন কেন্দ্র থেকেই উরিতে হামলার জন্য জঙ্গীদের প্রশিক্ষন দিয়েছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী। প্রায় ২৪ ঘন্টা ধরে এই লঞ্চপ্যাডের দিকে নজর রাখছিলো প্যারা এসএফ কম্যান্ডোরা। কম্যান্ডোরা দেখতে পায় ওই জায়গায় একটি বড় ঘর রয়েছে যেখানে সন্ত্রাসীরা থাকে এবং একটি গুদাম ঘর রয়েছে যা অস্ত্রশস্ত্রে পূর্ন। ওই প্রশিক্ষন কেন্দ্রটির চারদিকে চারটি পোস্ট রয়েছে যেখান থেকে স্নাইপাররা চারদিকে নজর রাখে। কম্যন্ডোরা আরও দেখতে পায় ওই কেন্দ্রে ভারত সরকারের ওয়ান্টেড লিস্টে থাকা অনেক সন্ত্রাসীই যাতায়াত করছে। সাথে সাথে ভারতীয় সেনারা বুঝে যায় যদি এই প্রশিক্ষন কেন্দ্রটি ধ্বংস করে দেওয়া যায় তাহলে পাকিস্তানের সন্ত্রাসী নেটওয়ার্কের মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়া যাবে। ২৪ ঘন্টা ধরে নজরদারির পর ভারতীয় কম্যান্ডোরা তাদের বেসে ফিরে আসে। বেসে ফিরেই কম্যান্ডোরা সেনাপ্রধান দলবীর সিংকে জানায় তারা অভিযানের জন্য প্রস্তত। দলবীর সিং সাথে সাথে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সাথে সাক্ষাৎ করেন অভিযানের অনুমোদনের জন্য। 

২০১৬ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর ভোর ৫:৩০ নাগাদ উরির সেনাঘাঁটিতে ঘুমিয়ে থাকা ভারতীয় সেনাদের উপর হঠাৎই পাকিস্তানের জঙ্গি সংগঠন জইশ ই মহম্মদের চার জন সদস্য গুলি চালানো ও গ্রেনেড ফেলা শুরু করে। এলওসি পেরিয়ে এসব সন্ত্রাসীরা উরিতে প্রবেশ করেছিল। মাত্র তিন মিনিটে জঙ্গীরা ১৭টি গ্রেনেড ফেলেছিল। এই ঘটনায় ১৯ জন ভারতীয় সেনা বীরগতি প্রাপ্ত হন এবং ৩০ জন আহত হন। এই অমানবিক ঘটনার প্রতিশোধের জন্যই পাকিস্তানে ঢুকে সন্ত্রাসীদের হত্যা করার পরিকল্পনা তৈরি করে ভারতীয় সেনাবাহিনী। পাকিস্তানে চূড়ান্ত অভিযানের কয়েকদিন আগে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী একটি বৈঠক ডাকেন যেখানে দলবীর সিং সহ, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালও উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে জেনারেল দলবীর সিং স্পষ্ট জানান উরি হামলার প্রতিশোধ নিতে পাকিস্তানের অভ্যন্তরে গিয়ে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক করতেই হবে, তিনি বৈঠকে তার সমস্ত পরিকল্পনার কথা জানান। এরপরেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী জেনারেল দলবীর সিংকে অভিযানের সবুজ সংকেত দিয়ে দেন। বৈঠক শেষ হতেই দলবীর সিং ৪ ও ৯ প্যারা এসএফের নির্বচিত কম্যান্ডোদের অভিযানের জন্য খবর পাঠায়। প্যারা এসএফের এই কম্যান্ডোরা যেকোনও পরিস্থিতিতে অভিযানের জন্য সবসময় প্রস্তুত থাকে। 

২৮ সেপ্টেম্বর বিকেল চারটে নাগাদা কম্যান্ডোদের অভিযানের জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়। অ্যাসল্ট রাইফেল, মেশিনগান, রকেট লঞ্চার, স্নাইপার রাইফেল সহ সমস্ত রকম আধুনিক উপকরনে সজ্জিত ভারতীয় কম্যন্ডোরা পাকিস্তানের সন্ত্রাসীদের নরকের দুয়ারে পৌঁছে দেওয়ার জন্য রওনা হয়। সম্পূর্ন ঘটনার লাইভ সম্প্রচার প্রধানমন্ত্রী নিজে বসে দেখতে থাকেন। রাত ৮:১৫ নাগাদ দশজন কম্যান্ডোর একটি দল এলওসি বা লাইন অফ অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল অতিক্রম করে পাকিস্তানে প্রবেশের উদ্দেশ্যে এক ঘন জঙ্গলে এসে উপস্থিত হয়। তবে পাকিস্তানে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক এতটা সহজ ছিলনা কারনে জঙ্গলে পাকিস্তান সেনাবাহিনী মাইন বসিয়ে রেখেছিল, তাছাড়া কত রকমের হিংস্র জীবজন্তু রয়েছে জঙ্গলে। রাত ১১:৪০ নাগাদ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নজর এড়িয়ে এলওসি পার করে জঙ্গলের মধ্যে পাকিস্তানের সন্ত্রাসী প্রশিক্ষন কেন্দ্র থেকে মাত্র পনেরো মিনিটের দূরে এসে উপস্থিত হয় ভারতীয় কম্যান্ডোরা। কিছুক্ষন পর প্রশিক্ষন কেন্দ্রের দেড়শো মিটার দূরত্বে এসে কম্যান্ডোরা নিজের নিজের অবস্থান নিয়ে নেয় এবং সন্ত্রাসীদের ঘুমানোর অপেক্ষা করতে থাকে। রাত ২টো নাগাদা প্যারা এসএফ কম্যান্ডোরা প্রশিক্ষন কেন্দ্রে অভিযানের উদ্দেশ্যে যেই রওনা হতে যাবে, হঠাৎই তাদের লক্ষ্য করে এক ঝাঁক গুলি উড়ে আসে। সাথে সাথে পূর্বের অবস্থানে ফিরে যায় ভারতীয় সেনারা, তবে সৌভাগ্যক্রমে গুলি কারও গায়ে লাগেনি। সামনের দিক থেকে বেশ কিছুক্ষন ধরে কিছু সন্ত্রাসী জঙ্গলের দিকে একে ৪৭ নিয়ে গুলি চালানোর পর তারা থেমে যায়। আসলে এটা তাদের একটা নিয়মমাফিক অনুশীলন ছিল। ক্যামোফ্লেজের কারনে তারা ভারতীয় সেনাদের দেখতে পায়নি, তারা আন্দাজে জঙ্গল লক্ষ্য করে গুলি চালিয়ে অনুশীলন করছিলো। বাধ্য হয়ে আবারও সন্ত্রাসীদের ঘুমোনোর জন্য অপেক্ষা করতে শুরু করে ভারতীয় কম্যন্ডোরা। 

সকাল ৫:৩০ নাগাদ যখন সব সন্ত্রাসীরা ঘুমিয়ে যায় ঠিক তখনই রকেট লঞ্চার থেকে অস্ত্রের গুদামে প্রথম হামলা শুরু করে ভারতীয় কম্যান্ডোরা। এরপর চেকপোস্টে থাকা সন্ত্রাসীদের স্নাইপাররা হত্যা করা হয়। বাকী সন্ত্রাসীরা যখন তাদের তাঁবু থেকে বেরিয়ে আসে তখন অ্যাসল্ট রাইফেল নিয়ে হামলা শুরু করে দেয় ভারতীয় কম্যান্ডোরা। অতর্কিত এই আক্রমনে দিশেহারা পাকিস্তানি জঙ্গীরা পালানোর সুযোগটুকুও পায়না। প্রায় আধ ঘন্টা ধরে চলা এই গুলিযুদ্ধে ভারতীয় কম্যান্ডোরা সমস্ত সন্ত্রাসীদের শেষ করে। সম্পূর্ন ঘটনা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নিজের কার্যালয়ে বসে সরাসরি লক্ষ্য করেন। সকাল ছয়টা নাগাদ ভারতীয় কম্যান্ডোরা যেই ফিরে আসার জন্য রওনা দেয় তখনই পেছন থেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাদের লক্ষ্য করে গুলি চালানো শুরু করে দেয়। আধ ঘন্টা ধরে ভারতীয় সেনাবাহিনীর এই অপারেশনের খবর পাকিস্তান পেয়ে যায় এবং সাথে সাথে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ওই প্রশিক্ষন কেন্দ্রের দিকে রওনা দেয়। তবে ভারতীয় কম্যান্ডে দ্রুত এলওসির দিকে রওনা দেয়। কিন্তু হঠাৎই এক কম্যান্ডোর পা মাইনে পড়ে যায় এবং তিনি ঝাঁপ দেন কিন্তু মাইন বিস্ফোরনে তার পা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু তাকে নিয়েই কম্যান্ডোরা এলওসির কাছে এসে পৌঁছায়। এলওসিতে আগে থেকেই দেড়শো ভারতীয় কম্যান্ডো প্রস্তত ছিল তারা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে লক্ষ্য করে গুলি চালানো শুরু করে, বাধ্য হয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পীছু হটে যায়। সেনাবেসে পৌঁছেই আহত সেনাটিকে হেলিকপ্টারে করে শ্রীনগরের সেনা হসপিটালে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেদিন প্রথম লঞ্চপ্যাড থেকে একশো কিলোমিটার দূরে আরও একটি সার্জিক্যাল স্ট্রাইক করেছিল ভারতীয় সেনাবাহিনী, সেখানেও সফলভাবে পাকিস্তানি জঙ্গীদের শেষ করে নিরাপদে দেশে ফিরে আসে কম্যান্ডোরা। সকাল ১১টা নাগাদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ভারতীয় সেনাবাহিনীর এই বিজয়গাথার কথা ঘোষনা করেন। এই ঘটনার চারমাস পর ২৬ জানুয়ারী এই সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের সাথে জড়িত কম্যান্ডোদের মেডেল দিয়ে সম্মান জানানো হয়। এভাবেই উরি হামলার প্রতিশোধ নিতে ভারতীয় সেনাবাহিনী পাকিস্তানের অভ্যন্তরে ঢুকে সন্ত্রাসীদের খতম করে নিরাপদে দেশে ফিরে এসেছিল। পাকিস্তানের পাশাপাশি গোটা বিশ্ব সেদিন ভারতীয় সেনাবাহিনীর সক্ষমতা দেখেছিল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *