পন্য পরিবহনের জন্য যুগান্তকারী পদক্ষেপ। ভারত সরকারের ডিএফসি প্রজেক্ট। রেলপথে ভারতের পন্য পরিবহন পুরো বদলে যেতে চলেছে
সম্প্রতি ভারতের রেলমন্ত্রক জানিয়েছে পন্য পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য বহু প্রতীক্ষিত পূর্ব মালবাহী করিডরের নির্মান সম্পূর্ন হয়েছে, যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে ভারতের সার্বিক উন্নয়নের মুকুটে আরও একটি পালক যুক্ত করেছে। ২০১৪ সাল থেকেই ভারত সরকার এই প্রজেক্ট তৈরির জন্য কাজ শুরু করেছিল। গত ১৬ জানুয়ারি, ২০২৪, রেলমন্ত্রক ট্যুইট করে ঘোষনা করে পূর্ব মালবাহী করিডর সম্পূর্ন রূপে পন্য পরিবহনের জন্য তৈরি হয়ে গেছে। সম্প্রতি রেলমন্ত্রক জানিয়েছিল হরিয়ানার নতুন পিলখানি থেকে পঞ্জাবের নতুন শম্ভু পর্যন্ত ট্রেন চালানো হয়েছে পরীক্ষা করার জন্য। এই রেলপথ তৈরির অর্থ পূর্ব মালবাহী করিডরের শেষ অংশ অর্থাৎ নতুন পিলখানি থেকে সাহনেওয়াল পর্যন্ত ১১৭ কিলোমিটার রেলপথ নির্মান সম্পূর্ন হয়ে গেছে। দীর্ঘদিন ধরেই সাধারন রেললাইন ধরে যাত্রীবাহী ট্রেন ও মালবাহী ট্রেনই চলাচল করে ভারতে। সাধারনত যাত্রীবাহী ট্রেনের যাতয়াতের জন্য মালগাড়িকে বহুক্ষন ধরে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। এর কারনে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পন্য পরিবহনে যথেষ্ট সময় লাগে এবং খরচও বেড়ে যায়। ২০০২ থেকে ২০০৭ পর্যন্ত দশম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় জানানো হয় ২০০১-০২ অর্থবর্ষ থেকে ২০০৬-০৭ অর্থবর্ষ পর্যন্ত ভারতে পন্য পরিবহনের পরিমান ৪৮৯ মিলিয়ন টন থেকে বেড়ে গিয়ে ৬২৪ মিলিয়ন টন হয়ে যাবে অর্থাৎ প্রতিবছর ৫ শতাংশ হারে পন্য পরিবহন বৃদ্ধি পাবে।
২০০৫ সালের এপ্রিল মাসেই ভারত সরকার ভারতের জাতীয় সড়ক নির্মান প্রজেক্ট স্বর্নালী চতুর্ভুজের পাশপাশি রেলপথে পন্য পরিবহনের জন্য একটি নির্দিষ্ট রেলপথ নির্মানের সিদ্ধান্ত নেয় যেখানে শুধু মালগাড়ি যাতায়াত করবে। এর ফলে পন্য পরিবহন আরও দ্রুত হত এবং খরচও কম হত। ২০০৫ সালের মে মাসেই ভারত সরকার পূর্ব মালবাহী করিডর ও পশ্চিম মালবাহী করিডর নির্মানের ঘোষনা করে যাকে ডিএফসি প্রজেক্ট বা ডেডিকেটেড ফ্রেড করিডর প্রজেক্টও বলা হয়। সেসময় ভারতকে ডিএফসি প্রজেক্টে জাপান সহয়তা করে।
২০০৬ সালের জানুয়ারিতে ডিএফসি প্রজেক্টের যাবতীয় সার্ভে সম্পূর্ন হয়। ৩০ নভেম্বর, ২০০৬ সালে ডেডিকেটেড ফ্রেড করিডরস কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়া লিমিটেড বা ডিএফসিসিআইএল তৈরি করা হয় ডিএফসি প্রজেক্টের জন্য। ব্রডগেজ লাইনে এই ডিফসি প্রজেক্ট তৈরির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। জাপান ইন্টারন্যাশনাল কর্পোরেশন এজেন্সি বা জেআইসিএ ২০০৭ সালের অক্টোবর মাসে ডিএফসি প্রজেক্টের যাবতীয় সমীক্ষা সম্পূর্ন করে এবং জাপান পশ্চিম মালবাহী করিডর নির্মানের জন্য অর্থায়ন করতে সম্মতি জানায়। ২০০৮ সালে রেলমন্ত্রক পূর্ব মালবাহী করিডর নির্মানের জন্য বিশ্ব ব্যাংকের সাথে যোগাযোগ করে। ২০১১ সালের মে মাসে বিশ্ব ব্যাংক লুধিয়ানা থেকে মুঘলসরাই পর্যন্ত পূর্ব মালবাহী করিডরের ১,১৮৩ কিলোমিটার রেলপথ নির্মানে অর্থায়ন করতে সম্মত হয়। ২০০৭-১২ সাল পর্যন্ত এগারোতম পঞ্চ বার্ষিকী পরিকল্পনায় রেলমন্ত্রক এই দুই করিডর নির্মানের কাজ শুরু করে।
ভারত সরকার সেসময় ২০০৮ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে এই দুই করিডর নির্মানের লক্ষ্য নিয়েছিল। কিন্ত ২০১৩ সালে এই প্রজেক্ট সম্পূর্ন হয়নি। ২০১৪ সালে নতুন কেন্দ্রীয় সরকারের নেতৃত্বে এই প্রজেক্টে গতি বৃদ্ধি করা হয়। যার কারনে দীর্ঘ প্রতিক্ষার পর পূ্র্ব মালবাহী করিডর নির্মানের কাজ সম্পূর্ন হয়ে গেছে এবং পশ্চিম মালবাহী করিডর নির্মানের কাজ প্রায় শেষের পথে। পুরো ডিএফসি প্রজেক্টে প্রায় ৮১,০০০ কোটি টাকা খরচ হচ্ছে।
পূর্ব মালবাহী করিডর:— পাঞ্জাবের লুধিয়ানা থেকে পশ্চিমবঙ্গের ডানকুনি পর্যন্ত ১,৮৩৯ কিলোমিটার লম্বা এই রেলপথ ভারতের পন্য পরিবহন ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করবে। লুধিয়ানা থেকে বিহারের শোননগর পর্যন্ত ১,৩৩৭ কিলোমিটার রেলপথ রেলমন্ত্রক সরাসরি তৈরি করেছে এবং শোননগর থেকে ডানকুনি পর্যন্ত ৫৩৮ কিলোমিটার পথ পিপিপি মডেলে তৈরি করা হয়েছে। পূর্ব মালবাহী করিডরের সম্পূর্ন ১,৮৩৯ কিলোমিটার রেলপথে ২১টি স্টেশন রয়েছে। পাঞ্জাব থেকে পশ্চিমবঙ্গ পর্যন্ত বিস্তৃত এই করিডর ছয়টি রাজ্যের মধ্যে দিয়ে গেছে যার মধ্যে সবচেয়ে বেশী রেলপথ রয়েছে উত্তরপ্রদেশে। এই করিডরের ৮৮ কিলোমিটার রেলপথ পাঞ্জাবে, ৭২ কিলোমিটার হরিয়ানাতে, ১,০৭৮ কিলোমিটার উত্তরপ্রদেশে, ২৩৯ কিলোমিটার বিহারে, ১৯৫ কিলোমিটার ঝাড়খন্ডে এবং ২০৩ কিলোমিটার পশ্চিমবঙ্গে রয়েছে। এই করিডরের পাশেই উত্তরপ্রদেশের মেরুটে একটি লজিস্টিক কেন্দ্র তৈরি করা হচ্ছে যা বেশ কয়েকটি এক্সপ্রেসওয়ের সাথে পূর্ব মালবাহী করিডরকে যুক্ত করেছে। মেরুট শহর দিয়ে দিল্লি মেরুট এক্সপ্রেসওয়ে, গঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে, দিল্লি মুম্বাই এক্সপ্রেসওয়ে, যমুনা এক্সপ্রেসওয়ে গেছে, এছাড়া ভবিষ্যতে মেরুট হরিদ্বার এক্সপ্রেসওয়ে এই শহরকে সংযুক্ত করেছে। যার কারনে মেরুটে পাশে পূর্ব মালবাহী করিডরের মাধ্যমে পন্য পরিবহন ভারতের বিভিন্ন শহরে অনেক সহজ হবে এবং খরচও কম হবে।
এই করিডরের প্রায় পুরোটাই দুই লাইন বিশিষ্ট কিন্ত লুধিয়ানা থেকে খুরজা পর্যন্ত ৩৬৫ কিলোমিটার রেলপথ একটি লাইন বিশিষ্ট কারন এখানে দুটি লাইন করার মতোন পর্যাপ্ত জায়গা পাওয়া যায়নি। প্রয়াগরাজে ৪.২ একর জায়গায় ফ্রান্সের অলস্টোম সংস্থার দ্বারা তৈরি অপারেশন কন্ট্রোল সেন্টার পূর্ব মালবাহী করিডরের সম্পূর্ন দায়িত্বে থাকবে।
পশ্চিম মালবাহী করিডর :— ১,৫০৬ কিলোমিটার লম্বা এই করিডর দিল্লির কাছে উত্তরপ্রদেশের দাদরি থেকে মহারাষ্ট্রের রায়গড় জেলায় নভি মুম্বাইয়ের জওহরলাল নেহেরু বন্দর পর্যন্ত বিস্তৃত। এই করিডরের মাধ্যমে মূলত প্রধান মালবাহী পন্যের মধ্যে রয়েছে সার, খাদ্যশস্য, লবন, কয়লা, লোহা, ইস্পাত এবং সিমেন্ট। এই রেলপথ এমনভাবে নির্মান করা হচ্ছে যাতে এই রেলপথে একশো কিলোমিটার প্রতি ঘন্টা গতিতে মালগাড়ি চলাচল করতে সক্ষম এবং এই রেলপথে একটি ট্রেন সর্বোচ্চ ৪০০ কন্টেইনার বহন করতে সক্ষম। পূর্ব মালবাহী করিডরের ৪৬ কিলোমিটার লম্বা একটি শাখা লাইন রয়েছে যা বুলন্দশহর জেলার খুর্জাকে পশ্চিম মালবাহী করিডরের গৌতম বুদ্ধ নগর জেলার দাদরিকে সংযুক্ত করেছে। দিল্লি মুম্বাই এক্সপ্রেসওয়ে সহ পশ্চিম মালবাহী করিডর দিল্লি মুম্বাই শিল্পাঞ্চলের মেরুদন্ড হতে চলেছে। হরিয়ানার গুরুগ্রাম জেলার সাঁচোলি গ্রাম এবং পালওয়াল জেলার পারোলি গ্রামে পশ্চিম মালবাহী করিডর দিল্লি মুম্বাই এক্সপ্রেসওয়ের পাশ দিয়েই গেছে। এই করিডর পাঁচটি রাজ্যকে সংযুক্ত করেছে। এই করিডরের ১৭৭ কিলোমিটার রেলপথ হরিয়ানা, ৫৬৭ কিলোমিটার রাজস্থান, ৫৬৫ কিলোমিটার গুজরাট, ১৭৭ কিলোমিটার মহারাষ্ট্র এবং ১৮ কিলোমিটার উত্তরপ্রদেশের মধ্যে দিয়ে গেছে। পশ্চিম মালবাহী করিডরের ৭০ শতাংশ কাজ হয়ে গিয়েছে। ১,৫০৬ কিলোমিটার লম্বা এই রেলপথের ১,০৪৬ কিলোমিটারের রেলপথের কাজ সম্পূর্ন হয়ে গিয়েছে এবং ৪৬০ কিলোমিটার রেলপথের কাজ চলছে।
এই পূর্ব পশ্চিম মালবাহী করিডর নির্মানের ফলে পন্য পরিবহন রেলপথে আরও বেশী হবে। যেমন ২০১৬-১৭ সালে পশ্চিমবঙ্গ থেকে পাঞ্জাবের দিকে কয়লা, স্টিল সহ প্রায় ৬৬ মিলিয়ন টনের পন্য যেত। পাঞ্জাব থেকেও ৯ মিলিয়ন টনের পন্য পশ্চিমবঙ্গের দিকে আসতো অর্থাৎ ২০১৬-১৭ সালে গড়ে ৭৫ মিলিয়ন টনের পন্য পরিবহন হত এই পথে। পূর্ব মালবাহী করিডর সম্পূর্ন হওয়ার ফলে এই পথে অন্তত ৯৫ মিলিয়ন টনের বেশী পন্য পরিবহন হবে। এছাড়া ভারত সরকার গতি শক্তি কার্গো টার্মিনালও তৈরি করছে যাতে রেলপথে পন্য নির্দিষ্ট জায়গায় নিয়ে গিয়ে সেখানে থেকে অন্য মাধ্যমে পন্য পরিবহন করা সম্ভব হয়। বেসরকারী সংস্থাগুলির সাথে এরকম একশোটি গতি শক্তি কার্গো টার্মিনাল তৈরি করা হবে যাতে পন্য পরিবহন আরও সহজ হয়। মেরুট ছাড়াও কানপুর ও লুধিয়ানাতেও লজিস্টিক পার্ক তৈরি করা হচ্ছে যাতে পন্য এনে রাখা যায়। ভবিষ্যতে এই পূর্ব পশ্চিম মালবাহী করিডর দিয়ে ৭০ শতাংশ মালগাড়ি যাতায়াত করবে। পূর্ব পশ্চিম মালবাহী করিডর তৈরি হওয়ার পর আরও চারটি করিডর তৈরির পরিকল্পনা করছে ভারত সরকার। উত্তর থেকে দক্ষিন (দিল্লি থেকে তামিলনাড়ু), পূর্ব থেকে পশ্চিম (পশ্চিমবঙ্গ থেকে মহারাষ্ট্র), পূর্ব থেকে দক্ষিন (পশ্চিমবঙ্গ থেকে অন্ধ্রপ্রদেশ) এবং দক্ষিন থেকে দক্ষিন (তামিলনাড়ু থেকে গোয়া) এই চারটি নতুন করিডর তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে ভবিষ্যতে।