ভারতের দীর্ঘতম সমুদ্র সেতু অটল সেতু। জাপান থেকে কত হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়া হয়েছে?
আরব সাগরের তীরে অবস্থিত মায়ানগরী, স্বপ্নের নগরী মুম্বাই শহর যাকে ভারতের বানিজ্যিক রাজধানীও বলা হয়। মুম্বাই শহরের কথা মনে হলেই প্রথমেই মাথায় আসে বলিউডের কথা, বিশ্বের সবচেয়ে বড় সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি এই মুম্বাইতেই অবস্থিত। ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অসংখ্য মানুষ এখানে আসেন কর্মসূত্রে যার কারনে মুম্বাই শহরের জনসংখ্যা যেমন বাড়ছে, তারসাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মুম্বাইয়ে যানজট। মুম্বাইয়ে যদিও উড়ালপুল তৈরি করা হয়েছে অনেক কিন্তু তবুও মুম্বাইয়ে দিল্লির মতোন বড় শহরের তুলনায় যানজট অনেকটাই বেশী রয়েছে। মুম্বাই শহরে অতিরিক্ত যানজটের পরিমান কম করার জন্য এবং মুম্বাইকে নভি মুম্বাইয়ের সাথে সংযুক্ত করার জন্য গত ১২ জানুয়ারী স্বামী বিবেকানন্দের জন্মতিথিতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী মুম্বাই ট্রান্স হার্বার লিঙ্কের উদ্ভোদন করেছেন গত ১২ জানুয়ারী। মূলত এটি একটি সেতু যার নাম দেওয়া হয়েছে অটল সেতু যা মুম্বাই ও নভি মুম্বাইকে সংযুক্ত করেছে। ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শ্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীর সম্মানে এই প্রজেক্টের নাম রাখা হয় শ্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী ট্রান্স হারবার লিঙ্ক বা অটল সেতু।
দক্ষিন মুম্বাই থেকে সমুদ্রের উপর দিয়ে নভি মুম্বাই পর্যন্ত নির্মিত এই অটল সেতু ভারতের সবচেয়ে দীর্ঘ সমুদ্র সেতু।
বিশ্বের বারোতম দীর্ঘ সমুদ্র সেতু অটল সেতু তৈরির কাজ শুরু হয় ২০১৮ সাল থেকে। ৭,৫০০ শ্রমিক ও ইঞ্জিনিয়ার ২১.৮ কিলোমিটার লম্বা এই সেতু নির্মান করেছে। অটল সেতুর মতো সেতু বিগত ছশ দশক ধরে স্বপ্ন ছিল মুম্বাইবাসীর। দক্ষিন মুম্বাইয়ের সেওরি থেকে নভি মুম্বাইয়ের চিরলে পর্যন্ত আরব সাগরের মধ্যে এই সুদীর্ঘ সেতু নির্মান করা হয়েছে। ২১.৮ কিলোমিটার লম্বা অটল সেতুর ১৬.১১ কিলোমিটারই আরব সাগরের মধ্যে তৈরি করা হয়েছে। ১৯৬২ সালে প্রথম পরিকল্পনা করা হয়েছিল দক্ষিন মুম্বাইকে কীভাবে নভি মুম্বাইয়ের সাথে সংযুক্ত করা যায়। ১৯৬২ সালে প্ল্যানিং অফ রোড সিস্টেম ফর মুম্বাই মেট্রোপলিটন রিজিয়ন নামে একটি প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল যাতে মুম্বাই শহরকে নভি মুম্বাই, পুনের, গোয়া, পানভেল এবং আলিবাগের সাথে সংযুক্ত করে পুরো অঞ্চলের অর্থনৈতিক বিকাশ করার। ১৯৬২ সালে প্রস্তাব হওয়ার পর ৩২ বছর সময় লেগে যায় মুম্বাই থেকে নভি মুম্বাই পর্যন্ত সেতু নির্মান সম্ভব কীনা পরীক্ষা করতে। ১৯৯৪ সালে এখানে সেতু তৈরির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এরপর আরও এক দশক এই প্রজেক্ট আটকে ছিল, ২০০৪ সালে এই প্রজেক্টের ব্যাপারে পর্যবেক্ষন করা হয় এবং ২০০৬ সালে টেন্ডার ডাকা হয়। কিন্তু এরপরেও বানিজ্যিক প্রতিযোগিতা, জমি সমস্যা সহ বিভিন্ন কারনে প্রজেক্টে আরও দেরী হয়। অবশেষে ২০১৭ সালে মুম্বাই মেট্রোপলিটন রিজিয়ন ডেভলপমেন্ট অথরিটি বা এমএমআরডিএ প্রজেক্ট শুরু করার সিদ্ধান্ত নেয়। অটল সেতু তৈরির দায়িত্বে এই সংস্থাই ছিল। জাপান এই ১৮,০০০ কোটি টাকার মেগা প্রজেক্টের ৮০ শতাংশ ঋন দেয়। জাপান ও ভারতের কুটনৈতিক সম্পর্ক খুবই মজবুত। জাপান অনেক প্রজেক্টেই নামমাত্র সুদে ঋন দেয় ভারতকে। এপ্রিল, ২০১৮ সালে দীর্ঘ প্রতিক্ষিত এই প্রজেক্টের কাজ শুরু হয় এবং ২০২৩ সালের মাঝামাঝি মোটামুটি পুরো প্রজেক্ট শেষ হয়ে গিয়েছিল। ৪ জানুয়ারী, ২০২৪ সালে অটল সেতুর করের মান প্রকাশ করা হয়। অটল সেতুতে একবার যাবার ভাড়া ২৫০ টাকা এবং একবার গিয়ে আবার ফিরত আসার মোট ভাড়া ৩৭৫ টাকা। এছাড়া অটল সেতুতে একদিনের পাস ৬২৫ টাকা অর্থাৎ একদিনে যতখুশি যাওয়া আসা যাবে এবং এক মাসের পাসের খরচ ১২,৫০০ টাকা। অটল সেতুতে ওআরটি সিস্টেম বা ওপেন রোড টোল ব্যবস্থা রয়েছে। সাধারনত কোনও জাতীয় সড়ক বা সেতুতে কর বা টোল দেওয়ার সময় টোল প্লাজা থাকে যেখানে টোল দিতে হয়, এর কারনে অনেক সময় লম্বা লাইন পড়ে গাড়ির। যদিও এখন গাড়িতে ফাস্ট ট্যাগ ব্যবহার করা হয় যাতে স্বয়ংক্রিয় ভাবেই টোল কাটা হয়ে যায়, লাইনে দাঁড়াতে হয়না। কিন্তু এখনও অনেক জায়গায় টোল প্লাজা রয়েছে। অটল সেতুতে কর দেওয়ার পুরো ব্যবস্থাই স্বয়ংক্রিয় করা হয়েছে যেখানে কোনও টোল প্লাজা থাকাবেনা এবং কর দেওয়ার জন্য লম্বা লাইন পড়বেনা গাড়ির। সিঙ্গাপুরে অনেক আগে থেকেই এই ওআরটি ব্যবস্থা রয়েছে। ছয় লেন বিশিষ্ট অটল সেতুতে প্রতিদিন গড়ে ৭০,০০০ গাড়ি যাতয়াত করতে সক্ষম। বাইক, অটো, ট্রাক্টর যাতায়াত নিষিদ্ধ অটল সেতু হয়ে। এখান দিয়ে শুধু বাস, ট্যাক্সি, গাড়ি এসব যেতে পারবে। অটল সেতুতে গাড়ির সর্বোচ্চ গতি একশো কিলোমিটার প্রতি ঘন্টা করা হয়েছে তবে সেতুতে ওঠার সময় এবং নামার সময় গাড়ির গতি ৪০ কিলোমিটার প্রতি ঘন্টা রাখার আদেশ দেওয়া হয়েছে। পুরো অটল সেতু জুড়ে এআই বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ক্যামেরা রয়েছে যাতে কোনও বিপদ ঘটলে সাথে সাথে ব্যবস্থা নেওয়া যায়।
আরব সাগরের উপর তৈরি অটল সেতুতে রাতের বেলায় আলো জ্বললে তার বিকরনে সমুদ্রের জলজ জীবনের সমস্যা হতে পারে বলে আশঙ্কা করেছিল পরিবেশবিদরা। সেজন্য অটল সেতুতে এমন ১,২১২ টি বাতি স্তম্ভ লাগানো হয়েছে যেখান থেকে আলো শুধু সেতুর মধ্যেই থাকে, সাগরে আলো যায়না। সেওড়ি থেকে সেতুতে ৮.৫ কিলোমিটার পর্যন্ত বিশেষ শব্দ প্রতিবন্ধক ইনস্টল করা হয়েছে যাতে এই এলাকায় থাকা ফ্লেমিঙ্গো পাখিদের কোনও সমস্যা না হয়। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে পনেরো মিটার উচ্চতায় সেতু নির্মানের জন্য সবচেয়ে কঠিন ব্যাপার ছিল সাগরের নীচে ৪৭ মিটার পর্যন্ত খনন করা স্তম্ভের জন্য। কারন এই এলাকার খুব কাছেই রয়েছে ভাবা অ্যাটমিক রিসার্চ সেন্টার, ওএনজিসি, জওহরলাল নেহেরু পোর্ট ট্রাস্টের মতোন সংস্থা এবং জলের তলায় পাইপলাইন, সংযোগ তার রয়েছে। এসমস্ত কিছু এড়িয়ে অটল সেতু নির্মান কারিগরি দক্ষতার এক অনন্য নিদর্শন। দক্ষিন মুম্বাই থেকে নভি মুম্বাই পর্যন্ত এই সেতু নির্মানের কারনে নভি মুম্বাই পৌঁছাতে পূর্বের তুলনায় ত্রিশ কিলোমিটার দূরত্ব কম হয়ে যায় যা অন্তত দুই ঘন্টা সময় বাঁচাবে। পুরো অটল সেতু অতিক্রম করতে ষোলো মিনিট সময় লাগবে। এই সেতু নির্মানের ফলে পরিবেশ দূষন কম হবে। কারন কম সময়ে এত দূরত্ব অতিক্রম করতে তেলও কম লাগবে। একটি তথ্য অনুযায়ী অটল সেতু নির্মানের কারনে বছরে অন্তত এক কোটি লিটার পেট্রোল কম পুড়বে যার কারনে ২৫,৬৮০ মেট্রিক টন কম কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমন হবে। যেকোনও প্রজেক্টে যখনই সময় বেশী লাগে তখনই প্রজেক্টে খরচ বেড়ে যায়। ২০১৯ এর শেষের দিকে করোনা মহামারী শুরু হয়ে যাওয়ায় এই প্রজেক্টে খরচ বেড়ে যায়। প্রথমে এই প্রজেক্টের খরচ ধরা হয়েছিল ১৪,৭১২.৭০ কোটি টাকা কিন্তু করোনা মহামারীর কারনে খরচ বৃদ্ধি পায়। অটল সেতু নির্মানে সর্বমোট ১৭,৮৪৩ কোটি টাকা বা ২.২ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে।
মুম্বাইয়ে গাড়ির সংখ্যা এক দশকে প্রচুর বৃদ্ধি পেয়েছে কিন্তু সেই তুলনায় মুম্বাইয়ের রাস্তা খুবই সংকীর্ন। মুম্বাইয়ে মোট ২০০০ কিলোমিটার রাস্তা রয়েছে যা দিল্লি ও ব্যাঙ্গালোরের মতোন বড় শহরের তুলনায় অনেক কম। ব্যাঙ্গালোর সড়ক নেটওয়ার্ক মুম্বাইয়ের পাঁচগুন বেশী, দিল্লিতে ২৯,০০০ কিলোমিটার লম্বা সড়ক নেটওয়ার্ক রয়েছে যা মুম্বাইয়ের তুলনায় অন্তত পনেরো গুন বেশী। মুম্বাইয়ের লোকাল ট্রেনে প্রতিদিন আট মিলিয়ন যাত্রী যাতায়াত করে। যার কারনে অটল সেতু মুম্বাইয়ের যানজটকে কিছুটা স্বস্তি দেবে। এছাড়া এই সেতু নির্মানের ফলে মুম্বাই ও নভি মুম্বাইয়ের অর্থনৈতিক পরিকাঠামো আরও মজবুত হবে। মুম্বাইয়ে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর রয়েছে, নভি মুম্বাইয়েও আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর তৈরি হচ্ছে যা ২০৩২ সালের মধ্যে সম্পন্ন হবে। অটল সেতু তৈরির ফলে মুম্বাই থেকেও মানুষ খুব সহজে নভি মুম্বাই বিমানবন্দরে যেতে পারবে। অটল সেতুর কাঠামো নির্মানে ১,২০,০০০ টন ইস্পাত ব্যবহার করা হয়েছে যা চারটি হাওড়া সেতুর সমান। ৮,৩০,০০০ ঘন মিটারের বেশী কংক্রিট ব্যবহার করা হয়েছে এই সেতুতে যা স্ট্যাচু অফ ইউনিটিতে ব্যবহৃত কংক্রিটের ছয়গুন। আইফেলে টাওয়ারের তুলনায় ১৭ গুন বেশী রিইনফোর্সড ইস্পাত ব্যবহার করা হয়েছে এই সেতুতে। ভূমিকম্প এবং ঘূর্নিঝড়ের মতোন প্রাকৃতিক বিপর্যয় সহ আবহাওয়ার তারতম্য, উচ্চ বাতাসের গতি এবং জোয়ার-ভাটা প্রতিরোধ করার জন্য ক্ষয়- প্রতিরোধী উপকরন ব্যবহার করে সেতুটি তৈরি করা হয়েছে। এটি ৬.৫ মাত্রা পর্যন্ত ভূমিকম্প সহ্য করতে পারে। অটল সেতুর পূর্ন জীবনকাল একশো বছর।