এলএসিতে চীনের রেলওয়ে নেটওয়ার্কের বিরুদ্ধে ভারতীয় রেলওয়ে নেটওয়ার্কের অবাক করা ছক
২০০৬ সালে চীন তার হিন্টারল্যান্ড এলাকা অর্থাৎ সমুদ্র উপকূলবর্তী বা নদীর উপকূলবর্তী এলাকাকে তিব্বতের রাজধানী লাসার সাথে সংযুক্ত করবার জন্য কিংহাই তিব্বত রেললাইন তৈরির কাজ সম্পূর্ন করে। এই রেললাইন নির্মানের ফলে চীনের মূল ভূভাগের সাথে তিব্বতকে সংযুক্ত হওয়ার পাশাপাশি চীন অরুনাচল প্রদেশের আরও কাছে রেলওয়ে নেটওয়ার্ক নিয়ে এসেছে। ২০১৪ সালে লাসা থেকে সিগাতসে পর্যন্ত রেললাইনকে জনসাধারনের ব্যবহারের জন্য শুরু করে দেয় চীন, বর্তমানে এই রেললাইনকে নেপাল পর্যন্ত বিস্তার করার কাজ করছে চীন। এই সিগাতসে শহরের কাছেই সিকিম ও তিব্বত সীমান্ত। ২০১৮ সালে চীন জিনজিয়াং প্রদেশের রুকিয়াং থেকে আকসাই চীনের কাছে হোতান পর্যন্ত ৮২৫ কিলোমিটার লম্বা রেললাইন নির্মানের কাজ শুরু করে, যা ২০২৩ সালেই নির্মান সম্পন্ন হয়ে গেছে। এই রেললাইনের মাধ্যমে হোতান ও উত্তর পশ্চিম চীনের কিংহাই প্রদেশের রাজধানী শিনিং এর মধ্যে দূরত্বকে তিন দিন থেকে কমিয়ে এক দিনে করে দিয়েছে। এই হোতানের খুব কাছে ভারতের লাদাখ অর্থাৎ চীন এই রেলপথের মাধ্যমে ইন্দো চীন সীমান্ত বা এলএসিতে আরও দ্রুত সৈন্য পরিবহন করতে পারবে।
২০২০ সালে সিচুয়ান প্রদেশের রাজধানী চেংদু থেকে লাসা পর্যন্ত আরও একটি রেলপথ তৈরি করা শুরু করেছে চীন। এই পুরো রেললাইন ভারত চীন সীমান্তের খুব কাছ দিয়ে গেছে। এই রেলপথের একটি এলাকা নিংচি থেকে অরুনাচল প্রদেশের দূরত্ব মাত্র ৪০ কিলোমিটার। চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মির ৫২ ও ৫৩তম পর্বতারোহী সেনা এই নিংচিতেই রয়েছে। লাসা থেকে নিংচি পর্যন্ত রেলপথ ইতিমধ্যেই সম্পূর্ন হয়ে গেছে। চেংদু থেকে লাসা পর্যন্ত ১,৬০০ কিলোমিটার লম্বা রেলপথ নির্মান সম্পূর্ন হলে মাত্র ১৩ ঘন্টায় চেংদু থেকে লাসা পৌঁছানো যাবে।
অরুনাচল প্রদেশ থেকে লাদাখ পর্যন্ত ভারত চীন সীমান্তে চীনের সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রন রয়েছে চীনের ওয়েস্টার্ন থিয়েটার কম্যান্ডের হাতে, এই ওয়েস্টার্ন থিয়েটার কম্যান্ডের মুখ্য কার্যালয় চেংদুতেই অবস্থিত। সুতরাং এই রেলপথ ভারতের জন্যও চিন্তার কারন। বিগত কয়েক বছরে ইন্দো চীন সীমান্তে চীন মজবুত রেলওয়ে নেটওয়ার্ক তৈরি করেছে। ভারতও এলএসির কাছে হাইওয়ে, টানেল তৈরি করেছে এবং আরও অনেক প্রজেক্টে কাজ করছে বিআরও। কিন্ত এখনও ইন্দো চীন সীমান্তে চীনের মতো তেমন রেলওয়ে নেটওয়ার্ক নির্মান করতে পারেনি ভারত। তবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে ভারত সরকার ইন্দো চীন সীমান্তে রেল যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য একাধিক প্রজেক্ট শুরু করেছে যা ভারতীয় সেনাবাহিনীকে ইন্দো চীন সীমান্তে, লাইন অফ অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল বা এলএসিতে শক্তিশালী করবে।
১৮৫৩ সালে ভারতে প্রথম ট্রেন চলাচল শুরু হয়। ভারতে বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম রেল ব্যবস্থা রয়েছে। বর্তমানে ভারতে ৭০,০০০ কিলোমিটারের বেশী রেললাইন রয়েছে যাতে ১৩,০০০ এর বেশী যাত্রীবাহী ট্রেন এবং ৮,০০০ এর বেশী মালগাড়ি যাতায়াত করে। কিন্ত তা সত্বেও ভারত চীন সীমান্তবর্তী এলাকায় রেলওয়ে নেটওয়ার্ক বহুবছর ধরে সঠিকভাবে তৈরি হয়নি। ২০০৬ সালে ক্যাবিনেট কমিটি অন সিকিউরিটি সীমান্তবর্তী এলাকায় পরিকাঠামো নির্মানের ব্যাপারে সবুজ সংকেত দেয়। ২০১০ সালে ভারত সরকার চীন, পাকিস্তান ও নেপাল সীমান্তে ২৮টি স্ট্রাটেজিক রেলওয়ে লাইন তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু পরবর্তী এক দশক ধরে এই প্রজেক্টে কাজ হয়নি। তবে এইসময়ে বিআরও বা বর্ডার রোড অর্গানাইজেশন সীমান্তবর্তী এলাকায় ব্যাপকহারে পরিকাঠামো নির্মান করেছে। যেমন বিআরও লাদাখের উমলিংলা পাসে ১৯,২০০ ফুটের বেশী উচ্চতায় বিশ্বের সবচেয়ে উচ্চতম মোটরপথ তৈরি করে যা গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে জায়গা করে নেয়। লাদেখের খারদুংলা পাসে বিশ্বের সবচেয়ে উচ্চতম ব্যেইলি সেতুও তৈরি করেছে বিআরও। ব্যেইলি সেতু হালকা স্টিলের তৈরি হয় যা আগে থেকেই তৈরি করা থাকে এবং গাড়িতে করে এক স্থান থেকে অন্যত্র সহজে পরিবহন করা সম্ভব হয়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সেনাবাহিনী সর্বপ্রথম এই ধরনের সেতু ব্যবহার শুরু করেছিল। উচ্চ পার্বত্যঞ্চলে, হীমশীতল তাপমাত্রায় বিআরও যেসব পরিকাঠামো নির্মান করছে তা ইন্দো চীন সীমান্তে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে স্ট্রাটেজিক সুবিধা দিচ্ছে। এই কারনে ২০২৩-২৪ অর্থবর্ষে বিআরও এর বাজেট ৪৩ শতাংশ বৃদ্ধি করে ৩,৫০০ কোটি টাকা থেকে ৫,০০০ কোটি টাকা করে দেওয়া হয়েছে। তবে সড়ক নির্মানের পাশপাশি ভারতের রেলওয়ে নেটওয়ার্ক আরও বৃদ্ধি করার জন্য বিশেষ করে সীমান্তবর্তী এলাকায় রেল যোগাযোগ তৈরি করার জন্য ২০২৩-২৪ এর বাজেটে ভারতীয় রেলওয়েকে ২.৪ লাখ কোটি টাকার বাজেট দেওয়া হয়েছে যা ২০১৩-১৪ অর্থবর্ষের তুলনায় নয়গুন বেশী। ২০২২ সালেই ভারত সরকার ঘোষনা করেছিল উত্তর পূর্ব ভারতে একটি মাল্টি মোডাল রেল ও সড়ক পরিবহন পথ তৈরি করবে যার মধ্যে দুটি সড়ক টানেল ও রেল টানেল ব্রহ্মপুত্র নদীর নীচে দিয়ে যাবে। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে ভারত সরকার ১৪টি স্ট্রাটেজিক রেলওয়ে লাইন তৈরির সিদ্ধান্ত নেয় যা উত্তর পূর্ব ভারতের যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত করার পাশাপাশি জরুরী অবস্থায় সেনা ও অস্ত্র পরিবহনেও সহায়তা করবে। এই ১৪টি প্রজেক্ট জম্মু ও কাশ্মীর, হিমাচল প্রদেশ, উত্তরাখন্ড, লাদাখ, অরুনাচল প্রদেশ ও আসামে তৈরি করা হবে, যাতে ৩.৫ লাখ কোটি টাকা খরচ হবে। ইতিমধ্যেই উত্তর পূর্ব ভারতে ইন্দো চীন সীমান্তের কাছে তিনটি রেলওয়ে লাইন তৈরির জন্য সার্ভে করা হয়ে গেছে, ২০৩০ এর মধ্যে এই প্রজেক্ট সম্পূর্ন হয়ে যাবে। অরুনাচল প্রদেশের ভালুকপং থেকে তাওয়াং অবধি ৩৭৮ কিলোমিটার লম্বা রেললাইন, আসামের শিলাপাথার থেকে অরুনাচল প্রদেশের বেম হয়ে উত্তর লখিমপুর পর্যন্ত ২৪৭.৮৫ কিলোমিটার লম্বা রেললাইন ও আসামের রুপাই থেকে অরুনাচল প্রদেশের পাসিঘাট পর্যন্ত ২২৭ কিলোমিটার লম্বা রেললাইন নির্মান করা হবে, এই তিনটি লাইন স্ট্রাটেজিক ভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন যার অর্থ এই তিন রেললাইনে যাত্রীবাহী ট্রেন চলার পাশাপাশি প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রয়োজনেও ব্যবহার করা হবে।
লাদাখের গলাওয়ান উপত্যকাতে ভারত ও চীনের সেনাবাহিনীর মধ্যে হওয়া সংঘর্ষের কারনে এই রেললাইন দ্রুত নির্মান করতে চাইছে প্রতিরক্ষা দপ্তর যাতে এলএসি সেনা ও অস্ত্র পরিবহন আরও তাড়াতাড়ি হয়। ভালুকপং থেকে তাওয়াং পর্যন্ত রেললাইন সেনাবাহিনীর জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন হতে চলেছে। দশ হাজার ফুট উচ্চতায় এখানে রেললাইন নির্মান করতে অনেক টানেল তৈরি করা প্রয়োজন। ২০২২ সালের তথ্য অনুযায়ী ২০১৪ সালের পর থেকে উত্তর পূর্ব ভারতে ৮৯৩.৮২ কিলোমিটার রেললাইনকে ব্রডগেজ লাইনে পরিবর্তিত করা হয়েছে, ৩৮৬.৮৪ কিলোমিটার নতুন লাইন তৈরি করা হয়েছে, ৩৫৬.৪১ কিলোমিটার ডবল লাইন তৈরি করা হয়েছে এবং ১,৫৭৮ কিলোমিটার নতুন লাইন তৈরির সার্ভে করা হয়েছে।
২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত উত্তর পূর্ব ভারতে রেলওয়ে পরিকাঠামোর জন্য যে বাজেট দেওয়া হয়েছিল তার তুলনায় ২০১৪ সালের পর থেকে বিগত নয় বছরে প্রতিবছর গড়ে ২৫৪ শতাংশ বেশী বাজেট দেওয়া হয়েছে এনএফআর বা নর্থইস্ট ফ্রন্টিয়ার রেলওয়েকে। এই তিনটি স্ট্রাটেজিক রেললাইনের পাশাপাশি উত্তর আসামের ধিমাজির মুরকংসেলেক থেকে অরুনাচল প্রদেশের পাসিঘাট পর্যন্ত ২৬ কিলোমিটার লম্বা ব্রড গেজ লাইন তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। এই রেললাইনের মাধ্যমে অরুনাচল প্রদেশের ভিতরে সেনা পরিবহন আরও সহজ হবে।
আসামের কোকরাঝার থেকে ভুটানের গেলফু পর্যন্ত রেললাইন তৈরির ব্যাপারেও পরীক্ষা করছে এনএফআর। আসাম ও ভুটানের সীমান্তে অবস্থিত এই গেলফু পর্যন্ত ৫৭.৫ কিলোমিটার এই রেললাইন তৈরি হলে ভারত ও ভুটানের কুটনৈতিক সম্পর্ক আরও মজবুত হবে এবং ভুটানে চীন সীমান্তের কাছে ভারতীয় সেনা পরিবহনও সহজ হবে আরও। এছাড়া সিকিমেও তিন ধাপে রেলওয়ে নেটওয়ার্ক তৈরি করছে ভারত সরকার। প্রথম ধাপে পশ্চিমবঙ্গের সেবক রেলওয়ে স্টেশন থেকে সিকিমের রংপো পর্যন্ত রেললাইন তৈরি করা হচ্ছে, দ্বিতীয় ধাপে রংপো থেকে সিকিমের রাজধানী গ্যাংটক পর্যন্ত রেললাইন তৈরি করা হবে এবং তৃতীয় ধাপে গ্যাংটক থেকে নাথুলা পাস পর্যন্ত রেললাইন তৈরি করা হবে যার খুব কাছেই ইন্দো চীন সীমান্ত। শুধু এই স্ট্রাটেজিক রেললাইন নির্মানই নয় বরং উত্তর পূর্ব ভারতের আটটি রাজ্যের রাজধানীকেই ব্রডগেজ রেললাইনের মাধ্যমে যুক্ত করা হবে।