অফবিট

২০ বছর পর মৃতদেহ পরিবারের হাতে দেওয়া হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে স্বৈরশাসক বেনিতো মুসোলিনীর শেষ পরিনিতি কতটা খারাপ জানেন?

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কথা এলে প্রথমেই আলোচিত হয় তৎকালীন ইউরোপের দুই স্বৈরাচারী শাসক জার্মানির নেতা অ্যাডলফ হিটলার এবং ইতালির নেতা বেনিটো মুসোলিনীর নাম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি, ইতালি ও জাপান মিলিতভাবে একটি জোট গঠন করেছিল যাকে অক্ষশক্তি বলা হত এবং এর বিপরীতে ছিল আমেরিকা, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ব্রিটেন, ফ্রান্স সহ আরও বেশ কিছু দেশের জোট মিত্রশক্তি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রথম কয়েকবছরে অক্ষশক্তি ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকার অনেকাংশ দখল করে নিয়েছিল কিন্তু শেষ পর্যন্ত ১৯৪৫ সালে অক্ষশক্তি পরাজিত হয় এবং মিত্রশক্তি জয়লাভ করে। হার নিশ্চিত বুঝেই জার্মানির আত্মসমর্পনের আগেই হিটলার আত্মহত্যা করে এবং বেনিটো মুসোলিনীরও মৃত্যু হয়। 

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার মাত্র চার বছর পরেই অর্থাৎ ১৯২২ সালে ইতালির রাজনৈতিক পরিস্থিতি খারাপ হতে শুরু করে। সেসময় ইতালিতে বেনিতো মুসোলিনী নামে এক ব্যক্তি ইতালির সরকারকে হুমকী দেয় সরকার ভেঙে দেওয়ার। মুসোলিনী এটা করেও দেখায়, সেই বছর ইতালির প্রধানমন্ত্রী হয় মুসোলিনী। রাজনৈতিক জীবনের আগে মুসোলিনী একজন সাংবাদিক ছিল। অ্যাডলফ হিটলারের মতো মুসোলিনীরও বলিষ্ঠ বক্তৃতা দেওয়ার ক্ষমতা ছিল। ইতালির মানুষ মুসোলিনীীর ভাষনে প্রভাবিত ছিল। মুসোলিনী প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যের মতোই শক্তিশালী ইতালি গঠনের স্বপ্ন দেখতো এবং নিজেকে জুলিয়াস সিজার মনে করতো। এই জন্য সরকার গঠন করেই মুসোলিনী ইতালিকে আশেপাশের সমস্ত দেশের থেকে সবচেয়ে শক্তিশালী করবার লক্ষ্যে কাজ শুরু করে। মুসোলিনী ইতালিতে ফ্যাসিস্ট সরকার গঠন করে এবং ফ্যাসিবাদ প্রচার করে। ভারত যেমন একটি গনতান্ত্রিক দেশ, এখানে মানুষ তার ভোট দিয়ে সরকার নির্বাচন করে কিন্তু ফ্যাসিবাদ এর পুরো বিপরীত। ফ্যাসিবাদে একজনই প্রধান থাকে এবং সমগ্র দেশের জনতা কোনও প্রশ্ন না করেই দেশের সরকারের আদেশ পালন করবে অর্থাৎ এক প্রকার স্বৈরতান্ত্রিক সরকার। ইতালির পাশের দেশ জার্মানির নেতা অ্যাডলফ হিটলার মুসোলিনীর উপর প্রভাবিত ছিল। এই জন্য ১৯৩৩ সালে সরকার গঠন করেই হিটলার মুসোলিনীর মতোই দেশে একনায়কতন্ত্র রাজনীতি শুরু করে। 

জার্মানি ও ইতালির মধ্যে সেসময় চুক্তি ছিল একে অপরকে আক্রমন করবেনা কখনও। কিন্তু অ্যাডলফ হিটলারের নেতৃত্বে জার্মানি যতটা সামরিক ভাবে শক্তিশালী হয়েছিল, ইতালি ততটা হয়নি। এই কারনে ১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর জার্মানির পোল্যান্ড আক্রমনের মধ্যে দিয়ে যখন ইউরোপে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয় তখন ইতালি প্রথমে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেয়নি। ১৯৪০ সালে নাজি জার্মান সেনা যখন ফ্রান্স আক্রমন করে তখন মুসোলিনীও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেয় এবং ফ্রান্সের কিছু অংশ দখল করে। ১৯৪৩ সালের প্রথমভাগ পর্যন্ত অক্ষশক্তির ব্যাপক প্রভাব ছিল ইউরোপে। কিন্তু ১৯৪৩ সালের জুলাই মাসে ইতালির সিসিলি দ্বীপ দখল করে নেয় মিত্রশক্তি এবং রোমে বোম্বিং শুরু করে। তখন ইতালির রাজা ভিক্টর এমানুয়েল তৃতীয় বুঝতে পারে মুসোলিনীকে ক্ষমতা থেকে না সরালে ইতালি পুরো ধ্বংস হয়ে যাবে। এজন্য এমানুয়েল তৃতীয় মুসোলিনীকে গ্রেফতার করে। এই খবর পাওয়া মাত্র হিটলার তার অফিসারদের নির্দেশ দেয় যেভাবেই হোক মুসোলিনীকে মুক্ত করতে হবে। অপারেশন আইখের মাধ্যমে ইতালির এক পাহাড়ি অঞ্চল থেকে মুসোলিনীকে মুক্ত করে জার্মানি নিয়ে যায় জার্মান প্যারাট্রুপাররা। 

হিটলার মুসোলিনীকে উত্তর ইতালির প্রধান নিযুক্ত করে। উত্তর ইতালি তখনও মিত্রশক্তির অধীনে ছিলনা। ১৯৪৫ সাল আসতে আসতে জার্মানির অবস্থা খারাপ হতে শুরু করে। হিটলার পর্যন্ত বুঝতে পেরে যায় হার নিশ্চিত। ১৯৪৫ সালের এপ্রিল মাসে মিলানে এক সম্মেলনে মুসোলিনী খবর পায় জার্মানি আত্মসমর্পন করার পরিকল্পনা করছে। এই খবর পাওয়া মাত্র ভয় পেয়ে ইতালি ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় মুসোলিনী। মুসোলিনী তার প্রেমিকা ক্লারা পেটাচির সাথে ইতালি ছাড়ার জন্য রওনা হয়। মুসোলিনীর সাথে তার প্রেমিকা ছাড়াও বেশ কয়েকজন ফ্যাসিস্ট নেতা ও জার্মান সেনা ছিল। মুসোলিনী সর্বমোট ২০০ জন লোক ইতালি ছেড়ে সুইজারল্যান্ডে পালাচ্ছিলো কারন সুইজারল্যান্ড দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জোট নিরপেক্ষ ছিল। মুসোলিনী জার্মান বায়ুসেনার পোষাক পড়ে ছিল যাতে তাকে কেউ চিনতে না পারে। কিন্ত কিছুদূর যাওয়ার পরেই মুসোলিনীর গাড়ির বহর লক্ষ্য করে সামনে রাস্তা গাছ ফেলে বন্ধ করে দেওয়া হয়। ইতালির সরকারের বহু লোক সেখানে উপস্থিত ছিল, সবার সামনেই মুসোলিনী ও তার প্রেমিকাকে গ্রেফতার করা হয়। জার্মান ও ফ্যাসিস্ট সেনাদের সংখ্যা কিন্তু ইতালির সরকার পক্ষের থেকে বেশী ছিল কিন্তু তারা ভেবেছিল ইতালির সরকার পক্ষে হয়ত তাদের থেকেও বেশী লোক রয়েছে। সেই জন্য তারা প্রতিবাদ করেনি এবং এই সুযোগে মুসোলিনীকে গ্রেফতার করা হয়। ইতালির লোকেরা জানতো হিটলার যদি জানতে পারে মুসোলিনীকে গ্রেফতার করা হয়েছে তাহলে আবারও জার্মান নাজি সেনা কোনওনা কোনও উপায়ে তাকে মুক্ত করে নিয়ে যাবে। এজন্য পরের দিন সকালেই বেনিতো মুসোলিনী ও তার প্রেমিকাকে মেশিনগান চালিয়ে হত্যা করা হয়। মুসোলিনীর সাথে তার অনেক ফ্যাসিস্ট সাথীদেরও হত্যা করা হয়। এরপর ইতালির সরকার পক্ষের লোকেরা সবার মৃতদেহ মিলানের একটি চত্বরে গিয়ে ফেলে দেয়। এই চত্বরেরই কিছু মাস আগে নাজি সেনা কয়েকজন ইতালীয় নাগরিককে হত্যা করেছিল সেজন্য এই চত্বরেই মুসোলিনী সহ তার সাথীদের মৃতদেহ ফেলে দেওয়া হয়েছিল। মহূর্তের মধ্যে অসংখ্য লোক এসে পুরো চত্বর ঘিরে ফেলে এবং সবাই মুসোলিনীর ও তরা সাথীদের মৃতদেহকে বিভিন্ন রকম ভাবে তাচ্ছিল্য করছিলো। একজন বয়স্ক মহিলা তার পিস্তল দিয়ে মুসোলিনীর মৃতদেহে পাঁচটি গুলি চালায় কারন ওই মহিলার পাঁচ ছেলের মৃত্যু হয়েছিল মুসোলিনীর জন্যই। এই ঘটনা প্রমান করে ইতালির সাধারন মানুষদের মনে মুসোলিনী ও তার সরকারের বিরুদ্ধে কতটা ঘৃনা ছিল। মুসোলিনী, তার প্রেমিকা ও তার সাথীদের মৃতদেহ ওই চত্বরে উল্টো করে ঝুলিয়ে দেয় জনগন। কীছুক্ষন পর মিত্রশক্তির সেনারা এসে মুসোলিনীর সমস্ত মৃতদেহ সেখান থেকে নিয়ে গিয়ে সমাধিস্থ করে। তবে জনগনের ক্ষোভের কারনে বেনিটো মুসোলিনীর সমাধির উপর তার নাম লেখা হয়নি। তবে জনগন ঠিকই খবর পেয়ে যায় কোথায় মুসোলিনীকে সমাধিস্থ করা হয়েছে এবং উন্মত্ত জনতা মুসোলিনীর সমাধিতেও তাচ্ছিল্য করে গিয়ে। একটা সময় মুসোলিনীর কীছু সমর্থক গোপনে মুসোলিনীর মৃতদেহ সমাধিক্ষেত্র থেকে তুলে নিয়ে যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার পর ১৯৪৬ সালের আগস্ট মাসে ইতালির সরকার মিলানের বাইরে থেকে মুসোলিনীর নতুন সমাধিক্ষেত্র খুঁজে পায়। পরবর্তী দশ বছর মুসোলিনীর মৃতদেহ কোথায় ছিল কেউ জানেনা। আমেরিকা মুসোলিনীর মৃতদেহ থেকে তার মাথার কিছু অংশ কেটে নিয়ে গিয়েছিল। ১৯৬৬ সালে মুসোলিনীর শরীর ইতালির সরকার তার পরিবারলে হস্তান্তর করে, আমেরিকাও মুসোলিনীর মাথার অংশ তার পরিবারকে ফিরিয়ে দেয়। এক সময় ইতালির দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতা বেনিতো মুসোলিনীর শেষ পরিনিতি এতটা করুন ছিল যে তার মৃতদেহকেও মানুষ ছাড়েনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *