অফবিট

ভগবান শ্রীহরি বিষ্ণুর দশম অবতার কল্কি কে? কল্কির মায়ের নাম কি হবে? জন্ম কোথায়?

হিন্দু ধর্ম বা সনাতন ধর্মের উত্থান কবে হয়েছিল তা আজও জানা যায়নি। সৃষ্টির আদি থেকে অনন্তকাল পর্যন্ত বহমান হিন্দু ধর্মের উপর বহু বিদেশী শক্তি দমন পীড়ন করবার চেষ্টা করেছিলো কিন্তু আজও স্বগর্বে নিজের অস্তিত্ব ধরে রেখেছে বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন ধর্ম হিন্দু ধর্ম। হিন্দু ধর্মে চার যুগের কথা বলা হয়েছে সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর ও কলি যুগ। বর্তমানে কলি যুগ চলছে বা অসুর কলির শাসনকাল চলছে। এই কলি যুগে চারদিকে হিংসা, অপকর্ম বহুগুন বৃদ্ধি পাবে এটাই বলা হয়েছে শাস্ত্রে। হিন্দু ধর্মগ্রন্থ অনুযায়ী কলি যুগের শেষ লগ্নে যখন অত্যাচার, অধর্ম সবচেয়ে চরম রূপ ধারন করবে তখন বিশ্বকে উদ্ধার করতে পুনরায় শ্রীহরি বিষ্ণু অবতার রূপে আসবেন। শাস্ত্রমতে ভগবান বিষ্ণুর প্রধান দশ অবতারের শেষ অবতার ভগবান কল্কি কলিযুগের শেষ আবির্ভূত হবে কলি অসুরকে সমাপ্ত করতে। 

সনাতন হিন্দু ধর্মে চার বেদ, উপনিষদ, আঠারো পুরান, রামায়ন, মহাভারতের (যার মধ্যে শ্রীমদ্ভাগবত গীতাও রয়েছে) মতো পবিত্র ধর্মগ্রন্থ রয়েছে। এই আঠারো পুরানের মধ্যে বিষ্ণু পুরান ও গড়ুর পুরানে ভগবান বিষ্ণুর দশ অবতারের কথা বলা হয়েছে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ গীতায় বলেছেন যখনই অধর্মের উত্থান হয় তখনই ধার্মিক মানুষদের পরিত্রানের জন্য যুগে যুগে তিনি আবির্ভূত হন। ভগবান বিষ্ণুর চার অবতারের মধ্যে চরটি অবতার সত্যযুগে, তিনটি অবতার ত্রেতাযুগে, দুটি অবতার দ্বাপরযুগে আবির্ভূত হয়েছেন এবং শেষ অবতার কলিযুগে আসবে। শাস্ত্রে চতুর্যুগ সম্পর্কে বলা হয়েছে সত্যযুগের স্থায়ীত্বকাল ১৭,২৮,০০০ বছর, ত্রেতাযুগের স্থায়ীত্বকাল ১২,৯৬,০০০ বছর, দ্বাপরযুগের স্থায়ীত্বকাল ৮,৬৪,০০০ বছর এবং কলিযুগের স্থায়ীত্বকাল ৪,৩২,০০০ বছর। কলিযুগের প্রথম ১০,০০০ বছরে মানুষের মধ্যে ধার্মিক ভাবনা থাকবে কিন্তু তারপরেই কলিযুগের প্রচন্ড রূপ শুরু হবে। বর্তমানে কলি যুগের পাঁচ হাজার বছরই হয়েছে। কলিযুগের এক লাখ বছর অতিক্রান্ত হলে তবেই ভগবান কাল্কির জন্ম হবে। মহাভারতের যুদ্ধের প্রায় ৩৬ বছর পর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তার মনুষ্যলীলা সমাপ্ত করে বৈকুন্ঠ চলে যান। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মর্ত্যলোক ত্যাগ করার সাথে সাথেই দ্বাপরযুগের সমাপ্তি হয় এবং কলিযুগের সূচনা ঘটে। ৫১২৩ বছর আগে ১৮ ফেব্রুয়ারী মধ্যরাতে কলিযুগের সূচনা হয়েছিল। 

হিন্দু ধর্ম অনুযায়ী ভগবান ব্রহ্মাকে সৃষ্টিকর্তা, ভগবান বিষ্ণুকে পালনকর্তা এবং ভগবান শিবকে ধ্বংসকর্তা বলা হয়েছে। ভগবান ব্রহ্মার বুক থেকে ধর্ম ও পিঠ থেকে অধর্মের সৃষ্টি হয়েছে। অধর্মের পূর্ন স্বরূপ কলির প্রথম লক্ষন দেখা দেয় মহারাজ পরীক্ষিৎ এর শাসনকালে। শ্রীকৃষ্ণ মর্ত্যলোক ত্যাগ করায় পান্ডবরা পরীক্ষিৎকে রাজা করে স্বর্গারোহনে চলে যান। পরীক্ষিৎই প্রথম কলিযুগের সূচনা বুঝতে পারেন কিন্তু তিনি সরাসরি কলিকে জানিয়েছিলেন তার সাম্রাজ্যে কলির প্রবেশাধিকার নেই, যেখানে মিথ্যা, হিংসা, লালসা, কাম, ক্রোধ, অহঙ্কার থাকতে পারে সেখানেই কলি থাকতে পারবে। মহাভারতেও কলিযুগের কথা বলা হয়েছে। মহাভারতে বর্নিত হয়েছে পান্ডবরা একবার ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কাছে জানতে চেয়েছিলেন আগত কলিযুগ কেমন হতে চলেছে। তখন শ্রীকৃষ্ণ পান্ডবদের বলেন বনে যেতে এবং যা কীছু অদ্ভুত দেখতে পাবে তাকে যেন এসে বলা হয়। শ্রীকৃষ্ণের কথায় পাঁচ ভাই বনে ভিন্ন ভিন্ন পথে যান। পাঁচ ভাই বনে কীছু অদ্ভুদ দৃশ্য দেখতে পান। যুধিষ্ঠির লক্ষ্য করেন একটি হাতির দুইটি শুঁড়, অর্জুন দেখতে পান একরি পাখির দুই ডানায় বেদের মন্ত্র লেখা রয়েছে কিন্তু সে একটি মৃত ব্যক্তির মাংস খাচ্ছে, ভীম লক্ষ্য করেন একটি গাভী তার সদ্য বাচ্ছাকে এতটাই চাটছে যে বাচ্ছাটির সারা শরীরজুড়ে রক্ত বেরোচ্ছে, সহদেব দেখেন একটি জায়গায় অনেক কয়টি কুয়ো রয়েছে মাঝের কুয়োটি সবচেয়ে গভীর কিন্তু তাতে কোনও জল নেই কিন্তু আশেপাশের সব কুয়েই জলে পরিপূর্ন, নকুল লক্ষ্য করেন একটি পাহাড় থেকে বিশাল প্রস্থরখন্ড নীচের দিকে আসছে গড়িয়ে, বড় বড় গাছও সেই পাথরকে প্রতিরোধ করতে পারেনি কিন্তু হঠাৎই একটি ছোট গাছে প্রস্থরখন্ডটি আটকে যায়। এই সমস্ত কথাই পান্ডবরা ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে গিয়ে জানান। শ্রীকৃষ্ণ তখন একে একে এসব ঘটনার ব্যাখা করেন। শ্রীকৃষ্ণ প্রথমে যুধিষ্ঠিরকে বলেন কলিযুগে এমন মানুষ আসবে যারা বলবে এক কিন্তু করবে আরেক, কলিযুগে এসব মানুষরাই রাজত্ব করবে। এরপর শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে জানান কলিযুগে এমন মানুষ আসবে যাদের দেখে প্রচন্ড জ্ঞানী, ধার্মিক মনে হবে কিন্তু আদতে তাদের স্বভাব রাক্ষসের মতোন হবে। ভিমকে শ্রীকৃষ্ণ জানান কলিযুগে মায়ের মমতা সন্তানের প্রতি এতটাই অধিক বৃদ্ধি পাবে যে সন্তানের পরমার্থিক উন্নতি, বিকাশই নষ্ট হয়ে যাবে, তাদের জীবন সংসার চক্রে আবদ্ধ হয়েই কেটে যাবে। এরপর শ্রীকৃষ্ণ সহদেবকে জানান কলিযুগে মানুষ বিবাহ, উৎসবে প্রচুর অর্থ খরচ করবে কিন্তু আশেপাশে থাকা অভুক্ত মানুষদের কষ্টের উপশমের কোনও চেষ্টাই করবেনা অর্থাৎ একশ্রেনীর মানুষের কাছে অর্থ, প্রাচুর্য থাকবে কিন্তু তাদের প্রকৃত জ্ঞান থাকবেনা। সর্বশেষে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নকুলকে জানান কলিযুগে মানুষের মন সর্বদা নিম্নগামী হবে কিন্তু হরিনাম পাপী মানুষকেও উদ্ধার করতে সক্ষম হবে। এভাবে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কলিযুগের প্রধান পাঁচ লক্ষন বলেছিলেন পান্ডবদের। 

কলিযুগকে সমাপ্ত করতেই ভগবান কল্কি আসবেন। কল্কিপুরানের ভগবান কল্কির বর্ননা করা হয়েছে। বলা হয়েছে কল্কি ভগনানের বাবার নাম হবে বিষ্ণুযশ এবং মাতা হবেন সুমতী। যখন ভগবান কল্কি আবির্ভূত হবে তখন সমস্ত নক্ষত্র এক সরলরেখায় চলে আসবে। হিন্দু ধর্মের আাট চিরঞ্জীবি পবনপুত্র হনুমান, বিভীষন, কৃপাচার্য, রাজা বলি, কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস, পরশুরাম, মার্কন্ডেয় ও অশ্বত্থামা কল্কি ভগবানের সংস্পর্শে আসবেন। উত্তরপ্রদেশের শম্ভল নামক গ্রামে কল্কি ভগবানের জন্ম হবে। তবে এটা নিয়ে বিতর্ক আছে, বৌদ্ধ ধর্ম অনুযায়ী তিব্বতে রহস্যময় শম্ভলা প্রদেশে আবির্ভাব হবে কল্কি ভগবানের। পুরানে বলা হয়েছে ভগবান কল্কি কলিযুগের বিনাশ করে পুনরায় সত্যযুগের স্থাপনা করবেন। কল্কি অবতারের কথা বৌদ্ধ ও শিখ ধর্মেও পাওয়া যায়। ভগবান পরশুরাম স্বয়ং কল্কি ভগবানকে শিক্ষা দেবেন। পরশুরামের কাছে শিক্ষা সম্পূর্ন করে ভগবান শিবের উদ্দেশ্যে তপস্যায় বসবেন কল্কি। দেবাদিদেব মহাদেব কল্কিকে তিনটি জিনিস দেবেন, দেবদত্ত নামে দুই পাখা যুক্ত একটি সাদা ঘোড়া, একটি বিশেষ তরোয়াল, শুক নামক একটি তোতা যে ভূত, ভবিষ্যৎ, বর্তমান বলতে পারবে। ভগবান কল্কি মহালক্ষীর অবতার শ্রীলঙ্কার রাজা ব্রহদ্রথের কন্যা রাজকুমারী পদ্মাবতীকে বিবাহ করবেন এবং তাদের জয় ও বিজয় নামে দুই পুত্রও হবে। কল্কি ভগবানের বিবাহ প্রসঙ্গে একটি কথা আছে বলা হয়েছে রাজকুমারী পদ্মাবতীর উপরে ভগবান শিবের আশীর্বাদ রয়েছে যে পুরুষ তার দিকে খারাপ দৃষ্টিতে তাকাবে সে স্ত্রী হয়ে যাবে। রাজা ব্রহদ্রথ একবার স্বয়ংবর সভার আয়োজন করেছিলেন সেখানে অনেক রাজা রাজকুমারী পদ্মাবতীর অপরূপ সৌন্দর্য দেখে মোহিত হয়ে গিয়েছিলেন তারা সকলেই স্ত্রী হয়ে যান। তখন ভগবান কল্কি তার তোতা শুককে পাঠান শ্রীলঙ্কায় রাজা ব্রহদ্রথের কাছে যে তিনি আসবেন রাজকুমারী পদ্মাবতীকে বিবাহ করতে। শাস্ত্রে বলা হয়েছে অন্যান্য যুগে অসুররা যেমন সরাসরি এসে অত্যাচার করতো কলি কিন্তু এমন করবেনা। কলি প্রথম বহুবছর কোনও রূপ ধারন করবেনা চেতনার মাধ্যমে মানুষের বুদ্ধি নষ্ট করবে। কলিযুগের শেষের দিকে যখন ধর্মের কোনও চিহ্ন থাকবেনা, তখন কলি তার রূপ ধারন করবে। সেসময় অধর্ম তার শিখরে থাকবে। সেময়ই ভগবান কল্কির সাথে কলির ভয়ানক যুদ্ধ হবে এবং প্রতিযুগের মতোন শেষে ভগবান বিষ্ণুই জয়ী হবেন এবং নতুন যুগের সূচনা করবেন। কল্কিপুরানে ভগবান কল্কির সম্পর্কে পূর্নভাবে বর্নিত রয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *