চেঙ্গিস খানের অসাধারন যুদ্ধনীতি। হিটলারের নাজি সেনা পর্যন্ত অনুসরণ করেছিল
সময়টা তখন ১২১৮ সাল, সেসময় মধ্য এশিয়ার খোয়ারাজামান সাম্রাজ্যের রাজা ছিল মহম্মদ দ্বিতীয়। সেসময় মধ্য এশিয়াতে খোয়ারাজামান সাম্রাজ্য ছাড়াও আরও একটি শক্তিশালী সাম্রাজ্য ছিল তা হল মোঙ্গল সাম্রাজ্য। খোয়ারাজামান সাম্রাজ্যের পূর্বদিকে অবস্থিত মোঙ্গল সাম্রাজ্য আয়তনে বিশাল হলেও খোয়ারাজামানের মতো ধনী ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যপূর্ন ছিলনা। ১২১৮ সালের আগে দুই সাম্রাজ্যের মধ্যেই বন্ধুত্বপূর্ন সম্পর্ক ছিল কারন তাদের একজনই শত্রু ছিল চীন। ১২১৮ সালে মোঙ্গল সম্রাট চেঙ্গিস খান তার তিনজন প্রতিনিধিকে মহম্মদ দ্বিতীয়র কাছে পাঠায় রেশমপথ পুনরায় খুলে দেবার জন্য। চেঙ্গিস খান চাইছিলো রেশমপথের মাধ্যমে খোয়ারাজামান সাম্রাজ্যের ধনী শহরগুলো যেমন বুখারা, সমরকন্দের সাথে বানিজ্য করতে, তাছাড়া রেশমপথ চীন হয়ে ইউরোপকেও সংযুক্ত করেছিল। চেঙ্গিস খান মহম্মদ দ্বিতীয়র জন্য প্রচুর উপহারও পাঠিয়েছিল। এই ঘটনার কিছুমাস পর মঙ্গোলিয়া থেকে একটি বড় ব্যবসায়ী দল খোয়ারাজামান সাম্রাজ্যের উত্তর পূর্বের একটি শহর ওটরারে এসে উপস্থিত হয় বানিজ্যের জন্য কিন্তু ওটাররের গভর্নর গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে সমস্ত মোঙ্গল ব্যাবসায়ীদের আটক করে তাদের হত্যা করে এবং তাদের সমস্ত জিনিসও নিয়ে নেওয়া হয়। বাস্তবে এই ব্যবসায়ীরা মোঙ্গল সাম্রাজ্যের গুপ্তচরই ছিল। এই ঘটনায় ক্ষিপ্ত হয়ে চেঙ্গিস খান তার এক রাজদূতকে ও দুই সেনাকে মহম্মদ দ্বিতীয়র সভায় পাঠায় এবং মহম্মদ দ্বিতীয়কে নির্দেশ দেয় এমন নৃশংস কর্মকাণ্ডের যেন ওটরার গভর্নরকে শাস্তি দেওয়া হয় এবং মহম্মদ দ্বিতীয় যেন মোঙ্গল সাম্রাজ্যের কাছে ক্ষমা চায়। মহম্মদ দ্বিতীয় ক্ষমা তো চায়নি উল্টে চেঙ্গিস খানের রাজদূতের গলা কেটে তা চেঙ্গিস খানের কাছে পাঠিয়ে দেয়। মহম্মদ দ্বিতীয় মোঙ্গল সাম্রাজ্যের অপমানও করে অনেক। এই খবর যখম চেঙ্গিস খানের কাছে পৌঁছায় তখন চেঙ্গিস খানের মাথায় একটা চিন্তাই আসে যেভাবেই হোক প্রতিশোধ নিতেই হবে।
মহম্মদ দ্বিতীয় জানতো চেঙ্গিস খান প্রতিশোধ নেবে কিন্তু তিনি নিশ্চিত ছিলেন তার চার লাখ সেনা বিশিষ্ট বিশাল শক্তিশালী সেনাবাহিনী রয়েছে। তাছাড়া খোয়ারাজামান সাম্রাজ্য প্রাকৃতিক ভাবেও নিরাপদ ছিল। কারন সমরকন্দের উত্তরে রয়েছে মরুভূমি, পূর্বে রয়েছে সিয়ার দারিয়া নামে প্রায় ৫০০ মাইল বিশাল নদী, পশ্চিমে রয়েছে আমু দরিয়া নামক নদী। সুতরাং তিনদিক দিয়ে সমরকন্দে প্রাকৃতিক ঢাল রয়েছে, তাছাড়া দক্ষিন দিক দিয়ে আক্রমন করতে হলে মোঙ্গল সেনাবাহিনী অনেক পথ ঘুরে আসতে হত। মহম্মদ দ্বিতীয় বা মহম্মদ শাহ জানতো একমাত্র মোঙ্গলরা একমাত্র পূর্বদিক দিয়েই আক্রমন করতে পারে কারন খোয়ারাজামানের পূর্ব দিক থেকেই মোঙ্গল সাম্রাজ্য সবচেয়ে কাছে। সেজন্য পূর্বদিকে পূর্ন নিরাপত্তা ব্যবস্থা করেছিল মহম্মদ শাহ। সিয়ার দরিয়া নদীর আশেপাশেও বেশ কিছু সেনা মোতায়েন করা হয়েছিল। ১২১৯ সালে মহম্মদ শাহ খবর পায় সিয়ার দরিয়া নদীর দক্ষিনে কিছু মোঙ্গল সেনা রয়েছে। সাথে সাথে মহম্মদ শাহ তার ছেলে জালালউদ্দিনকে পাঠায় মোঙ্গলদের প্রতিরোধে। এই যুদ্ধে জালালউদ্দিন জিতে যায়। মোঙ্গলরা তাদের যুদ্ধনীতি ও নৃশংস স্বভাবের জন্য পরিচিত ছিল, সেই মোঙ্গলদের এত সহজে হারিয়ে দেওয়ায় আরও আত্মবিশ্বাসী হয়ে পড়ে মহম্মদ শাহ। তিনি আরও সেনা পাঠায় সিয়ার দরিয়া নদীর কাছে। কিন্তু মোঙ্গলা এবার এদিকে আক্রমন করেনি। মোঙ্গল সেনাবাহিনী মরুভূমি পেরিয়ে খোয়ারাজামান সাম্রাজ্যের উত্তরের শহর ওটরারে আক্রমন করে। মোঙ্গল সেনাবাহিনী এতটা দ্রুত আক্রমন করেছিল যে মহম্মদ শাহর সেনাবাহিনী প্রতিরোধ করার সময়ও পায়নি। ওটরার দখল করেই ওটরারের গভর্নরের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য তার দুই চোখে ও কান গরম রূপো ঢেলে দেওয়া হয়, এছাড়া ওটরার শহর জুড়ে রীতিমতো গনহত্যা চালায় মোঙ্গল সেনাবাহিনী। মহম্মদ শাহ উত্তরে ওটরারে তার সেনাবাহিনী পাঠায় মোঙ্গলদের পরাস্ত করতে কিন্তু মোঙ্গলদের পরিকল্পনা ছিল অন্যরকম। ওটারারে মোঙ্গল সেনাবাহিনী দুইভাগে বিভক্ত হয়ে যায় একটি ভাগের নেতৃত্বে থাকে জেনারেল জোচি এবং অন্যভাগের দায়িত্বে তাকে জেনারেল জেব। এই জেনারেল জেবই জালালউদ্দিনের সাথে যুদ্ধে পরাজিত হয়েছিল। জেনারেল জোচির নেতৃত্বে মোঙ্গল সেনা সিয়ার দরিয়া নদীর দিকে চলে যায়। অন্যদিকে জেনারেল জেবের সেনা যেন হঠাৎ উধাও হয়ে যায় তার কোনও খবরই জানা যায়নি। জেনারেল জোচির সাথে ২০,০০০ অশ্বারোহী সেনা ছিল। জেনারেল জোচি সিয়ার দরিয়া নদী বরাবর খোয়ারাজামানের এলাকা গুলোতে দ্রুত আক্রমন করে, লুটপাট, হত্যা করে পাহাড় বা জঙ্গলে পালিয়ে যেত যার জন্য তাদের ধরা যেতনা। মোঙ্গলরা যুদ্ধের জন্য ঘোড়া ব্যবহার করতো প্রচুর পরিমানে। মঙ্গোলিয়ার ঘোড়াগুলো ছিল খুব উন্নত জাতের এবং ক্ষিপ্র। মঙ্গোল সেনারা যখন যুদ্ধে যেত তখন একজন অশ্বারোহী সেনা পীছু অন্তত চারটি ঘোড়া থাকতো। কারন দৌড়াতে দৌড়াতে কোনও ঘোড়া ক্লান্ত হলে বা মরে গেলে নতুন ঘোড়ার ব্যবহার করা হত। তাছাড়া দীর্ঘদিন ধরে যুদ্ধে মোঙ্গলরা খাদ্যের জন্য ঘোড়ার মাংস খেত। যার জন্য যুদ্ধের জন্য তাদের বিশাল রসদ বহন করতে হতনা, এই জন্য মোঙ্গল সেনাবাহিনীর গতিও বেশী ছিল।
মোঙ্গল সেনাবাহিনী সংখ্যায় খোয়ারাজামানের সেনার থেকে অনেক কম ছিল কিন্তু যুদ্ধনীতির কারনে তারা খোয়ারাজামান সাম্রাজ্যের সেনবাহিনীর থেকে অনেক এগিয়ে ছিল। ইতিহাসে এরকম উদাহারন অনেক রয়েছে যেখানে শক্তিশালী দেশের সেনাবাহিনী অপেক্ষাকৃত ছোট সেনাবাহিনী যুক্ত দেশের কাছে পরাজিত হয়েছে। তৎকালীন সময়ে মোঙ্গলদের এই দ্রুত আক্রমনের সাথে ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মান নাজি সেনাবাহিনীর তুলনা চলে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে হিটলারের নাজি সেনাও দ্রুত গতিতে শত্রুর ভূমি আক্রমন করতো একে ব্লিজক্রিগ নীতি বলা হত। কিন্তু তেরো শতকে কোনও আধুনিক সুবিধা না থাকা সত্বেও চেঙ্গিস খানের এই যুদ্ধনীতি সত্যিই প্রশংসনীয় ছিল। জেনারেল জোচির প্রতি ব্যস্ত থাকার সময়েই হঠাৎ মহম্মদ শাহ খবর পান উত্তর পশ্চিম দিক দিকে জেনারেল জেবের সেনা আক্রমনের পরিকল্পনা করছে। যার জন্য মহম্মদ শাহ পঞ্চাশ হাজার সেনা পাঠায় উত্তর পশ্চিম সীমান্তে। এভাবে মোঙ্গল সেনাবাহিনীর দ্বিমুখী আক্রমনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে মহম্মদ শাহ। বলা হয় জেনারেল জেব জালালউদ্দিনের সাথে লড়াইয়ে ইচ্ছে করেই হেরে যায় যাতে খোয়ারাজামান সাম্রাজ্য ভাবে মোঙ্গল সেনাবাহিনী দুর্বল। তবে এবার জেনারেল জেব পূর্ন প্রস্তত ছিল। মোঙ্গল সেনাবাহিনীর সেনা সদস্যদের বিশেষ পোষাক ছিল যা ভেদ করে তীর লাগার সম্ভবনা কম ছিল। কিন্তু সেই তুলনায় খোয়ারাজামান সেনাবাহিনীর এমন কোনও পোষাক ছিলন। যার জন্য যুদ্ধে খুব সহজেই মোঙ্গলরা জিতে যায়। মোঙ্গলদের একটি বিশেষ দক্ষতা ছিল তাহল ঘোড়ায় দৌড়াতে দৌড়াতেই তারা শত্রুকে তীর দিয়ে আঘাত করতে পারতো। মহম্মদ শাহ এই পরাজয়ের খবর শুনেই সাম্রাজ্য থেকে পশ্চিম দিকে পালিয়ে গিয়ে মিত্র শক্তিগুলোর সাথে সেনাবাহিনী গঠন করে পুনরায় মোঙ্গলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের পরিকল্পনা করে। কিন্তু হঠাৎই মহম্মদ শাহ খবর পায় বুখারার বাইরে আরও একটি মোঙ্গল সেনাবাহিনী এসে উপস্থিত হয়েছে যার নেতৃত্বে রয়েছে চেঙ্গিস খান স্বয়ং। চেঙ্গিস খানও মরুভূমি অতিক্রম করে বুখারা এসেছিল। খুব অল্প সময়েই চেঙ্গিস খান বুখারা দখল করে নেয়, তারপর সমরকন্দও দখল করে নেয় চেঙ্গিস খান। মহম্মদ শাহ সাম্রাজ্য ছেড়ে পালিয়ে যায়। চেঙ্গিস খান তার দুই দক্ষ জেনারেলকে মহম্মদ শাহের পেছনে পাঠিয়েছিল। কাস্পিয়ান সাগরের তীরে এক নির্জন দ্বীপে একাকী অবস্থায় মৃত্যু হয়েছিল মহম্মদ শাহের। চেঙ্গিস খানকে ইতিহাসের সবচেয়ে নিষ্ঠুর শাসক বলা হয়। চেঙ্গিস খান যে অঞ্চল দখল করতো সেখানকার যুদ্ধবন্দীদের নিষ্ঠুর ভাবে হত্যা করতো।
মোঙ্গলরা খোয়ারাজামান সাম্রাজ্য দখল করার পর সেখানকার কয়েক লাখ বাসিন্দাকে নৃশংস ভাবে হত্যা করেছিল। বলা হয় এত লোককে মোঙ্গলরা হত্যা করেছিল যে পুরো নরমুণ্ডর পিরামিড তৈরি হয়ে গিয়েছিল। তবে নিষ্ঠুর হলেও চেঙ্গিস খান একজন দক্ষ সামরিক নায়ক ছিল। আজও চেঙ্গিস খানের যুদ্ধনীতি বিশ্বের বিভিন্ন মিলিটারি স্কুলে পড়ানো হয়। ১২১৯ সালে চেঙ্গিস খান মরুভূমিতে কোথায় কোথায় মরুদ্যান আছে তার খোঁজ নিয়ে সেসব জায়গার মাধ্যমে মরুভূমি অতিক্রম করে খোয়ারাজামান সাম্রাজ্যে আক্রমন করেছিলো।