১৩ বছরে জেল খাটার পরে রাষ্ট্রপতি। কোন দেশে এমন হয়েছিল জানেন?
নিউজ ডেস্ক – কমবেশি প্রত্যেকটা দেশে নজর দিলে দেখা যায় সেখানকার সরকার যথেষ্ট ধনশালী হয়। কিন্তু এমন একটি দেশ রয়েছে যেখানকার রাষ্ট্রপতির কাছে বৃহৎ সম্পদ থাকলেও তিনি একজন মধ্যবিত্ত অর্থাৎ সাধারণ মানুষের মতো জীবন যাপন করতে পছন্দ করেন। পাশাপাশি তার নামে এটাও প্রচলিত যে তিনি একসময় ডাকাত রাজ ছিলেন। অর্থাৎ ডাকাত থেকে দেশের রাষ্ট্রপতি হওয়ার পথ কোনদিনই সহজ ছিল না পেপে মুজিকার কাছে। বহু কাটা ও দুর্গম পথ অতিক্রম করে বর্তমানে সকল মানুষের হৃদয়ে জায়গা বানিয়ে উরুগুয়ের রাষ্ট্রপতি পদে মনোনীত হয়েছেন পেপে মুজিকা। একটি গল্পের মাধ্যমে পেপে মুজিকার জীবনী তুলে ধরা হয়েছে এই প্রতিবেদনে।
ইতিহাসের পাতা উল্টালে দেখা যায় ১৯৬০-১৯৭০-য়ের শুরুর সময় উরুগুয়ের শহরভিত্তিক একটি বিদ্রোহ শুরু হয়েছিল। যার নাম ছিল ‘টুপামারোস জাতীয় মুক্তি আন্দোলন’। এই বিদ্রোহের মূল দল নেতা ছিলেন মুজিকা, রাউল সেনডিক, জর্জ জাবালজার। প্রায় ১০০ জনেরও কম সদস্য নিয়ে ডাকাত দল গঠন করেছিলেন পেপে মুজিকা। তারা মূলত ব্যাঙ্ক ডাকাতি করে সেই সকল লুট করা অর্থ বিলিয়ে দিতেন গরিবদের মধ্যে, পাশাপাশি খাদ্যভান্ডার লুট করেও অনাহারীদের মধ্যে বিলিয়ে দিতেন দাপুটে গুন্ডারাজরা। তবে কোনো রকম অস্ত্র বা রক্তপাতে সঙ্গে জড়িত ছিলেন না তারা। ১০০ জনেরও কম এই দল যেখানে লুট চালাত সেই শহর রীতিমতো কেঁপে উঠতো তাদের ভয়ে। যার কারণে ১৯৬৯ সালে একটি ম্যাগাজিনে তাদের আখ্যায়িত করা হয়েছিল ‘রবিন হুড গেরিলা’ নামে। তবে মুজিকার আর নিজেদের এই কর্মপন্থা নাম দিয়েছিলেন সশস্ত্র প্রচারণা।
একসময় শোনা যায় জনপ্রিয় ফুটবল খেলা চলার সময় রেডিও স্টেশন দখল করে তারা চালাতেন তাদের প্রচারণা কার্য। তবে সরকার বহুদিন তাদের বিরুদ্ধে একাধিক তথ্য প্রমাণ করতে চাইলেও ব্যর্থ হয়েছেন। যার কারণে তারা রবিন হুড গেরিলাদের উপর পাল্টা গেরিলা আক্রমণ শুরু করেন। তবে সরকারের নজর থেকে বহুদিন বাঁচতে পারলেও ১৯৭০ সালের মার্চ মাসে নিজের এক পরিস্থিতির সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে সম্মুখিন হয় পুলিশের। আর সেখানেই ঘটে বিপত্তি। পুলিশের মুখোমুখি হওয়ায় তৎক্ষণাৎ মুজিকার উপর ছয়টি গুলি চালায় প্রশাসন। তবেই কথায় রয়েছে রাখে হরি মারে কে। অর্থাৎ ৬টি গুলি খাওয়ার পরেও মৃত্যু হয়নি মুজিকার। দীর্ঘ এক বছর ধরে চিকিৎসা করার পর সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন তিনি। তবে এখনো কিছু সাংঘাতিক ঘটা বাকি ছিল মুজিকার সঙ্গে। সুস্থ হওয়া মাত্রই তাকে জেলবন্দি করা হয় অন্যান্য কমরেডদের সঙ্গে। যার কারণে রবিনহুড গেরিলা দলের প্রধান মাথা কারাগারে বন্দি হওয়ায় সেই সময়টুকুর জন্য দিকভ্রষ্ট হয়ে পড়ে শহরের আন্দোলন। তবে শুধুমাত্র কারাগারে বন্দি করেই ক্ষান্ত হয়নি সরকার।
১৯৭০ সালে আগস্ট মাসে অবশিষ্ট গেরিলা বাহিনী দল বেশ কয়েকজন বিদেশিকে গ্রেফতার করে তাদের মুক্তিপণের দাবিতে সরকারের কাছে গিয়েছিল কারাবন্দি সদস্যদের মুক্তি। তবে সরকার তাদের সঙ্গে কোনো রকম আপোষ না করায় এবং তাদের কথাও না শোনায় রক্তপাত অপছন্দকারী গেরিলা দল শুরু করে অপহরণ ও বোমাবাজির মতো রক্তলীলার খেলা। রীতিমতো নিজেদের সদস্যদের জেল থেকে মুক্তি করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল অবশিষ্ট গেরিলা দলের সদস্যরা। তরুণ ও প্রগতিশীল এবং অতি সহিংস নেতারা উরুগুয়ের সাধারণ মানুষের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার চেয়েও বেশি মনোযোগ দিয়েছিল শ্রেনী শত্রুর খতমের দিকে। তবে শহরে চলা এই সকল উপদ্রব বন্ধ করতে সরকার রাস্তায় নামার অস্ত্রসহ সেনাবাহিনী।
সেনাবাহিনীদের ক্ষুব্ধ মনোভাবে ও ব্যাপক ধরপাকড় এবং নির্যাতন চালানোর পর ১৯৭২ সালে ঝাড়ে মূলে শেষ হয়ে যায় রবিন হুড গেরিলারা। পরবর্তীতে ১৯৭৩ সালের জুন মাসে সেনাবাহিনী ক্ষমতা গ্রহণ করে একটি ক্যুয়ের মাধ্যমে। এই ক্ষমতা গ্রহণ করার পরেই মুজিকাদের জীবনে নেমে আসে কালের অন্ধকার। পেপে মুজিকা সহ মোট ৯ জন টুপামারোসকে বন্দী করা হয় সলিটারি সেলে। অর্থাৎ যেখানে আলো বাতাসের বিন্দুমাত্র প্রবেশ নিষিদ্ধ। এমন অন্ধকারাচ্ছন্ন দমবন্ধকর স্যাঁতস্যাঁতে পরিস্থিতিতে দীর্ঘ ১৩ বছর বন্দী ছিলেন সকলে। তবে কারাবন্দীদের মধ্যে অনেকে বাইরের জগত থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার কারণে উন্মাদে পরিণত হয়। দীর্ঘ কয়েক বছর পর ১৯৮৫ সালের মার্চ মাসে গণতান্ত্রিক সরকার ফিরে আসার পর তাদের মুক্তি দেওয়া হয়। তবেই জেলবন্দি জীবন পরিত্যাগ করার পর খুব একটা কষ্ট করতে হয়নি মুজিকাকে।
জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর খুব দ্রুত রাজনীতি শিখে গিয়েছিলেন তিনি। যার কারণে প্রথমে সিনেটের মন্ত্রীর দায়িত্ব পালনের পর রাষ্ট্রপতি পদে মনোনীত হন। যদিও রবিন হুড মনোভাবের জন্য শহরবাসীর কাছে এক আলাদা আকর্ষণ গ্রহণ করেছিলেন তিনি। তবে ডাকাতি করার সময় কোন সম্পদ লুট করে যেমন নিজে ধনী হওয়ার কোন ইচ্ছা ছিল না মুজিকার ঠিক সেই রকমই রাষ্ট্রপতি হওয়ার পরেও নিজের প্রাপ্য বেতন দিয়ে কখনোই বিলাসবহুল বাড়ি তৈরি করেননি তিনি। নিজের প্রাপ্য বেতনের মধ্যে ৯০ শতাংশ সম্পদ বিলিয়ে দিতেন বিভিন্ন দাতব্য প্রতিষ্ঠানে। পুরো বিশ্বে এমন রাষ্ট্রপতিকে গরিব বলে আখ্যায়িত করলেন তিনি কখনো নিজেকে গরিব বলে মনে করেননি। তিনি বলেন,’আমার কাছে গরীব হচ্ছে তারাই যারা খুব বেশি বেশি চায়। কারণ যাদের চাওয়া অনেক বেশি তারা কখনোই তৃপ্ত হয় না’।