এয়ার ইন্ডিয়ার বিমান ১৮২কে কিভাবে বিস্ফোরনের মাধ্যমে উড়িয়ে দিয়েছিল খালিস্তানি জঙ্গীরা?
২৩ জুন, ১৯৮৫, কানাডার মন্ট্রিল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বোম্বের উদ্দেশ্যে উড়ান শুরু করে এয়ার ইন্ডিয়ার বিমান ১৮২। বিমানে থাকা ৩২৯ জন যাত্রী তখন স্বপ্নেও ভাবেনি এটাই তাদের শেষ যাত্রা হতে চলেছে। কানাডা থেকে বোম্বের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়া এই বিমানের মাঝে লন্ডন ও দিল্লিতে বিরতি ছিল। বিমানটি লন্ডনে অবতরনের জন্য আয়ারল্যান্ডের আকাশসীমায় প্রবেশ করে কিন্তু আয়ারল্যান্ডের উপকূলের ২০০ মাইল আগেই বিমানে দুর্ঘটনা ঘটে। ৩১,০০০ ফুট উচ্চতায় বিমানে বিস্ফোরন ঘটে। এয়ার ইন্ডিয়ার বিমান ১৮২ এর ধ্বংসাবশেষ ও ৩২৯ জন হতভাগ্য যাত্রীর মৃতদেহ নীচের আটলান্টিক মহাসাগরে পড়ে। ১৯৮৫ সালে এয়ার ইন্ডিয়া বিমানে এই বোম্ব বিস্ফোরনের জন্য দায়ী খালিস্তানি জঙ্গীরা।
২২ জুন মনজিৎ সিং নামের একটি ব্যক্তি দুপুর ৩:৩০ নাগাদ কানাডার ভ্যাঙ্কুভার শহরের বিমানবন্দরে আসে টরেন্টো যাওয়ার জন্য। কিন্তু তার বিমানের টিকিট কনফার্ম না থাকায় সে বিমানবন্দরের কর্মীদের অনুরোধ করে অন্তত তার ব্যাগ টরেন্টো থেকে এয়ার ইন্ডিয়ার বিমান ১৮২ সম্রাট কনিষ্কে ভারত পাঠানো হোক। মনজিৎ এর নাম টিকিটে এম সিং থাকায় তার টিকিট কনফার্ম হয়নি। বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দেয় ওয়েটিং টিকিটে ব্যাগ চেকইন হয় না। মনজিৎ বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের সাথে বচসা শুরু করে কারন তার টিকিট ছিল বিসনেজ ক্লাসের। অবশেষে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ মনজিৎ এর ব্যাগ চেকইন করতে রাজি হয়ে যায়। মনজিৎ তার উদ্দেশ্যে সফল হয়ে যায়। ভ্যাঙ্কুভার থেকে তার ব্যাগ রাত ৮:২২ মিনিট নাগাদ টরেন্টো বিমানবন্দরে পৌঁছায়। এরপর মনজিৎ এর ব্যাগ এয়ার ইন্ডিয়ার বিমান ১৮২তে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। দুর্ভাগ্যবশত সেদিন টরেন্টো বিমানবন্দরের এক্সরে মেশিনও খারাপ হয়ে গিয়েছিল। রাত ১২:১৫ নাগাদ টেরেন্টো থেকে বিমান ১৮২ মন্ট্রিলের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। সেখান থেকে বিমানটি লন্ডনের হিথরো বিমানবন্দরের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। বিমানটিতে মোট ৩০৭ জন যাত্রী ও ২২ জন বিমান পরিচালক ছিল। যাদের মধ্যে ২৬৮ জনই কানাডার নাগরিক ছিল, বিমানটিতে ৮৪ জন শিশুও ছিল। সব কিছু ঠিকই চলছিলো কিন্তু হিথরো বিমানবন্দর থেকে মাত্র ৪৫ মিনিট দূরে রেডার থেকে সকাল আটটার দিকে বিমানটি হঠাৎ উধাও হয়ে যায়। অনেক চেষ্টা করেও বিমানটির খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিলনা। কিছুক্ষন পর একটি কার্গো বিমানের পাইলট হিথরো বিমানবন্দরে জানায় আয়ারল্যান্ডের উপকূলের কাছে আটলান্টিক মহাসাগরে একটি বিমানের ধ্বংসাবশেষ পড়ে রয়েছে। অনুসন্ধানের পর দেখা যায় ওটাই এয়ার ইন্ডিয়ার ১৮২ নং বিমান যেটি সম্পূর্ন ধ্বংস হয়ে গেছে এবং ৩২৯ জন যাত্রীর মৃতদেহ আটলান্টিক মহাসাগরে পড়ে আছে। উদ্ধারকারী দল গিয়ে সমুদ্র থেকে মাত্র ১৪১ জন যাত্রীর মৃতদেহই উদ্ধার করতে পেরেছিল, বাকী সমস্ত মৃতদেহ বিশাল আটলান্টিক মহাসাগরে খুঁজে পাওয়া যায়নি। ময়নাতদন্তে জানা যায় কারও মৃত্যু হয়েছে অক্সিজেনের অভাবে, আবার কারও মৃত্যু হয়েছে জলে ডুবে। সেসময় বিমান পরিবহন বিভাগে সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনা ছিল এই এয়ার ইন্ডিয়া ১৮২ এর ধ্বংস হয়ে যাওয়া। কানাডায় থাকা খালিস্তানি জঙ্গীরা যুক্ত ছিল এই দুর্ঘটনার জন্য।
এয়ার ইন্ডিয়ার ফ্লাইট ১৮২ ছাড়াও আরও একটি এয়ার ইন্ডিয়ার বিমানেও বিস্ফোরনের পরিকল্পনা করা হয়েছিল ২২ জুন। ২২ জুন এল সিং নামে এক ব্যক্তিও তার ব্যাগ ভ্যাঙ্কুভার থেকে থেকে টোকিও পাঠায়, টোকিও থেকে এই ব্যাগ এয়ার ইন্ডিয়ার ৩০১ নং বিমানে ওঠানোর কথা ছিল। কিন্ত এখানে এল সিং এর দ্বারা একটি ভুল হয়ে গিয়েছিল। ব্যাগে বোম্বের টাইমিং এর সময়ে ডেলাইট সেভিং এর কথা তার মনে ছিলনা। আমেরিকা ও কানাডাতে গরমের সময় ঘড়িতে সময় একঘন্টা বাড়িয়ে দেওয়া হয় এবং শীতকালে সময় এক ঘন্টা কমিয়ে দেওয়া হয়, একেই ডেলাইট সেভিং বলা হয়। কিন্তু জাপানে এরকম কিছু হয়না। যার জন্য বোম্ব টোকিও বিমানবন্দরেই বিস্ফোরন হয়ে যায় এবং এই ঘটনায় দুজনের মৃত্যু হয়। তবে এয়ার ইন্ডিয়ার ৩০১ নং বিমানের সমস্ত যাত্রীরা বেঁচে যায়। এয়ার ইন্ডিয়ার বিমান ১৮২ এর বিস্ফোরনের আগেই টোকিও বিমানবন্দরে এই দুর্ঘটনা ঘটেছিল।
এই দুটি বিস্ফোরনের ঘটনার তদন্তে উঠে আসে বহুদিন ধরেই বিমান বিস্ফোরনের পরিকল্পনা চলছিলো। ১৯৮৫ সালের জুন মাসে তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী আমেরিকা সফরে যান। ১৯৮৪ সালে হওয়া অপারেশন ব্লুস্টারের প্রথম বর্ষও ছিল এইসময়। যার জন্য আমেরিকা ও কানাডাতে রাজীব গান্ধীর কড়া নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়। কানাডাতে বাব্বার খালসা নামক একটি সন্ত্রাসী সংগঠনের উপর স্থানীয় প্রশাসনের নজর ছিল। বাব্বার খালসার নেতা ছিল তালউইন্দার সিং পারমার। ১৯৭০ সালে তালউইন্দার ভারত থেকে কানাডা যায় এবং সেখানকার নাগরিকত্ব নেয়। ১৯৭৮ সালে তালউইন্দার বাব্বার খালসা ইন্টারন্যাশনাল নামে একটি চরমপন্থী শিখ সংগঠন তৈরি করে। এই সংগঠনের দাবী ছিল ভারত থেকে পাঞ্জাব আলাদা করে খালিস্তান নামে একটি আলাদা দেশ গঠন করা। ১৯৮১ সালে পাঞ্জাব পুলিশের দুই কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করে তালউইন্ডার, এই জন্য ১৯৮৩ সালে জার্মানিতে তাকে গ্রেফতার করা হয়। ১৯৮৪ সালে জেল থেকে ছাড়া পেয়েই তালউইন্দার কানাডা চলে যায়। ভারত সরকার তাকে দেশে ফেরানোর চেষ্টা করেছিল কিন্তু কানাডা সরকার রাজি হয়নি। রাজীব গান্ধীর আমেরিকা সফরের আগেই কানাডার গোপন পুলিশ তালউইন্দারের উপর নজর রাখা শুরু করে। পুলিশ খবর পায় তালউইন্দারের ইন্দ্রজিৎ সিং রেয়াত নামে এক ব্যক্তির সঙ্গে অতিরিক্ত ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। রাজীব গান্ধীর আমেরিকা সফরের পরই কানাডার পুলিশ তালউইন্দারের উপর নজর রাখা বন্ধ করে দেয়, এটাই ছিল কানাডা পুলিশের সবচেয়ে বড় ভুল। কানাডায় প্রকাশ্যে বাব্বার খালসার খালিস্তানের সমর্থনে মিছিল হত, এমনকী তালউইন্দারের প্রকাশ্যে এয়ার ইন্ডিয়ার বিমানে ভ্রমন না করার হুমকী দিত, মাঝ আকাশে এয়ার ইন্ডিয়ার বিমান ধ্বংস করে দেওয়ারও হুমকী দিত তাসত্ত্বেও কানাডা পুলিশ এসব ঘটনাকে গুরুত্ব দেয়নি। এয়ার ইন্ডিয়ার বিমান বিস্ফোরনের কয়েক সপ্তাহ আগে র কানাডার ইনটেলিজেন্স বিভাগকে সম্ভাব্য বিমান হামলা সম্পর্কে জানিয়েছিলো তাও কানাডা সরকার কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। এয়ার ইন্ডিয়া ১৮২ এর বিস্ফোরনের জন্য বোম্ব তৈরির দায়িত্ব ছিল ইন্দ্রজিৎ সিং রেয়াতের উপর। অপারেশন ব্লুস্টারের পর থেকে প্রকাশ্যে ভারতের বিরুদ্ধে বদলা নেওয়ার কথা বলতো ইন্দ্রজিৎ। এই ঘটনার পর কানাডা পুলিশ ৮ নভেম্বর তালউইন্দার ও ইন্দ্রজিৎ এর বাড়িতে অভিযান করে এবং দুজনকেই গ্রেফতার করা হয়। কিন্তু কিছু দিনের মধ্যেই উপযুক্ত প্রমানের অভাবে দুজনকেই ছেড়ে দেওয়া হয়। এরপর ইন্দ্রজিৎ সিং রেয়াত ইংল্যান্ড চলে যায়। তবে টোকিও বিস্ফোরন কান্ডে ইন্দ্রজিৎকে ১৯৮৮ সালে ইংল্যান্ডে গ্রেফতার করে কানাডা নিয়ে আসা হয়। এবার বিচারে তাকে দশ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ২০০১ সালে তার বিরুদ্ধে পুনরায় এয়ার ইন্ডিয়া বোম্বিং এর বিচার শুরু হয়। ২০০৩ সালে তাকে দোষী সাব্যস্ত করে আরও পাঁচ বছরের জেলের সাজা দেওয়া হয়। ১৯৮৫ সালের ২৩ জুন এয়ার ইন্ডিয়া বিমানে বিস্ফোরনের আগে থেকেই তালউইন্দার ও ইন্দ্রজিৎ সিং এর উপর নজর ছিল কানাডার ইনটেলিজেন্স বিভাগের। বিস্ফোরনের পর কানাডার ইনটেলিজেন্স বিভাগ জানায় ৪ জুন তারা ভ্যাঙ্কুভারের একটি নির্জন দ্বীপে গিয়ে বোম্ব পরীক্ষা করেছিল। যদিও সেসময় কানডার ইনটেলিজেন্স বিভাগ মনে করেছিল তারা গুলি চালানোর প্রশিক্ষন শিখছে।
তালউইন্দার সিং পারমার কানাডা পুলিশের থেকে ছাড়া পাওয়ার পর পাকিস্তান চলে যায়। সেখান থেকে ১৯৯২ সালে ভারতে আসে পারমার। তবে মুম্বাই পুলিশের এনকাউন্টারে কিছুদিনের মধ্যেই মৃত্যু হয় তার। তালউইন্দার সিং পারমার কয়েকবার রাজীব গান্ধীকেও হত্যার পরিকল্পনা তৈরি করেছিল। ২০০০ সালে কানাডা পুলিশ দুজন খালিস্তানিকে গ্রেফতার করে ১৯৮৫ সালের এয়ার ইন্ডিয়া বিস্ফোরন কান্ডে। ২০০৬ সালে কানাডা সরকার এই বিস্ফোরন কান্ডের জন্য একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে যার প্রধান ছিল কানাডার সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারক জন সি মেজর। ২০১০ সালে এই কমিটি ৩২০০ পাতার একটি রিপোর্টে এয়ার ইন্ডিয়া বিস্ফোরন কান্ডে তৎকালীন কানাডার সরকার ও ইনটেলিজেন্স বিভাগের অবহেলাকে দায়ী করা হয়। এরপরেই কানডার উচ্চ আদালত তালউইন্দার সিং পারমারকে এয়ার ইন্ডিয়া বিস্ফোরন কান্ডের মাস্টার মাইন্ড ঘোষনা করে। ২০১০ সালে কানাডা সরকার বিমান বিস্ফোরন কান্ডে মৃত্যু হওয়া মানুষদের জন্য তাদের পরিবারের কাছে ক্ষমা চায়। আগ পর্যন্ত এই ঘটনার পূর্ন তদন্ত হয়নি। সিবিআই এই ঘটনার তদন্ত করতে চেয়েছিল কিন্তু কানাডা সরকার বাধা দেয়। এই ঘটনার পর থেকেই ভারত ও কানডার কুটনৈতিক সম্পর্ক খারাপ হতে শুরু করে।