অফবিট

জার্মানির একটি অঞ্চল আজও রাশিয়ার দখলে রয়েছে

বিশ্বের সবচেয়ে বড় দেশ রাশিয়া যার পশ্চিমে রয়েছে বাল্টিক সাগর এবং পূর্বে রয়েছে প্রশান্ত মহাসাগর। রাশিয়া এমন একটি দেশ যেটি এশিয়া এবং ইউরোপ উভয় মহাদেশেই অবস্থিত। রাশিয়া এতটাই বড় দেশ যে রাশিয়াতে এগারোটি টাইমজোন রয়েছে। তবে রাশিয়ার এমন একটি অঞ্চল আছে যেটা নিয়ে আজও বিতর্ক আছে জার্মানির সাথে। জায়গাটির নাম কালিনিনগ্রাদ ওবলাস্ট। রাশিয়ার মূল ভূখন্ড থেকে ৮৩৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত লিথুনিয়া ও পোল্যান্ডের মাঝে অবস্থিত। বাল্টিক সাগরের তীরে অবস্থিত ১৫,১২৫ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে অবস্থিত এই ছোট জায়গাটি রাশিয়ার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন। কোনও দেশের মূল ভূখন্ড থেকে প্রায় আটশো কিলোমিটার দূরে অবস্থিত হওয়া কোনও একটি অঞ্চল সেই দেশটির অংশ হওয়াটা যথেষ্টই অবাক করার মতোন ব্যাপার। 

কালিনিনগ্রাদ রাশিয়ার অংশ হওয়ার আগে এই অঞ্চলটি জার্মানির অংশ ছিল, সেসময় জায়গাটির নাম ছিল কনিংসবার্গ। একটা সময় ২.৬ মিলিয়ন জার্মান এখানে থাকতো। আজ থেকে প্রায় ৭০০ বছর আগে ১২৫৫ সালে টিওটোনিক নাইটরা এই অঞ্চল জয় করে এবং কনিংসবার্গ শহর তৈরি করে। ১৬০০ সাল অবধি এই শহর প্রুশিয়ার রাজধানী ছিল কিন্তু তারপর রাজধানী শহর বার্লিন করা হয় কিন্তু তারপরেও কনিংসবার্গ প্রুশিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন শহরগুলোর মধ্যে একটি ছিল। ১৭৫৮ সালে সাত বছরের যুদ্ধে রাশিয়া এই শহর দখল করে নেয়। কিন্তু চারবছর পরেই ১৭৬২ সালে রাশিয়া এই শহর পুনরায় প্রুশিয়াকে ফিরিয়ে দেয়। ১৮৭১ সালে প্রুশিয়া জার্মানির সাথে সংযুক্ত হয়ে যায় এবং তারপর থেকে ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়া পর্যন্ত কনিংসবার্গ জার্মানিরই অংশ ছিল। ১৯৪১ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাজি জার্মানি সোভিয়েত ইউনিয়নের রাজধানী মস্কোর উপর বোম্বিং করেছিল। এই ঘটনার বদলা নিতে ব্রিটেন ও সোভিয়েত ইউনিয়ন যৌথভাবে কনিংসবার্গে বোম্বিং করে যাতে শহরটির ৪০ শতাংশ বাড়ি ও ২০ শতাংশ শিল্প প্রতিষ্ঠান নষ্ট হয়ে যায়। এই কারনে সেসময় কনিংসবার্গে বসবাস করা ২.৬ মিলিয়ন মানুষের মধ্যে ২ মিলিয়ন লোক জার্মানি চলে গিয়েছিল। ৯ এপ্রিল, ১৯৪৫ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন সম্পূর্ন কনিংসবার্গ শহর দখল করে নেয় কিন্তু ততদিনে যুদ্ধের কারনে ৯০ শতাংশ শহর ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। ৭ মে, ১৯৪৫ সালে জার্মানি আত্মসমর্পন করে এবং ইউরোপে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়ে যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর ফ্রান্স, ব্রিটেন, আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়ন জর্মানিকে দুই ভাগে বিভক্ত করে। পূর্ব জার্মানি চলে যায় সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে এবং পশ্চিম জার্মানি যায় ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও আমেরিকার অধীনে। এই পূর্ব জার্মানিতেই অবস্থিত কনিংসবার্গ শহর। ১৯৪৬ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন কনিংসবার্গ শহরের নাম বদলে কালিনিনগ্রাদ রাখে। বলশেভিক বিপ্লবের নেতা মিখাইল কালিনিনের নামেই এই শহরের নাম কালিনিনগ্রাদ রাখা হয়। এই শহরে বসবাস করা অবশিষ্ট জার্মানরাও ধীরে ধীরে জার্মানি চলে যায় এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদের নাগরিকদের এখানে বসবাসের জন্য পাঠায়। বর্তমানে এই শহরের জনসংখ্যা এক মিলিয়ন বা দশ লাখ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার কয়েক বছরের মধ্যেই এক সময়ের জোট সাথী আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে শীতল যুদ্ধ শুরু হয়। তখন সোভিয়েত ইউনিয়ন তার সেনাবাহিনী ও নৌবাহিনী মোতায়েন রেখেছিল এখানে। ১৯৯০ সালে পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানি এক হয়ে যায়। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নও ভেঙে পনেরোটি দেশ তৈরি হয় কিন্তু কালিনিনগ্রাদ রাশিয়ার অধীনে চলে যায়। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর থেকে এখানে রাশিয়া তার সামরিক উপস্থিতি বৃদ্ধি করে। ২০০৮ সালে রাশিয়া কালিনিনগ্রাদে ৩০টি যুদ্ধজাহাজ, তিনটি ডিজেল সাবমেরিন, ট্যাঙ্ক, যুদ্ধবিমান, এয়ারডিফেন্স সিস্টেম মোতায়েন করেছিল। ২০১০ সালে এখানে রাশিয়ান সেনাবাহিনীর ৮১১ ট্যাঙ্ক, ১,২৩৯ সাঁজোয়া গাড়ি, ৩৪৫ আর্টিলারি ও রকেট সিস্টেম এবং ১১৬০০ সেনা ছিল। ২০১৫ সালে ন্যাটো ও ইউক্রেন সংকটের কারনে এখানে সামরিক উপস্থিতি আরও মজবুত করে রাশিয়া। রাশিয়ান নৌবাহিনীর বাল্টিক ফ্লীটের মুখ্যা কার্যালয়ও এই কালিনিনগ্রাদেই অবস্থিত। পূর্ব সোভিয়েত ভুক্ত অনেকদেশই পরবর্তীকালে ন্যাটো জোটে যোগ দেয়। ন্যাটোতে আমেরিকা ও কানাডা সহ ৩২টি দেশ রয়েছে। ন্যাটোতে একটি নিয়ম রয়েছে যাতে বলা হয়েছে কোনও একটি ন্যাটো দেশে আক্রমন হলে বাকী সমস্ত দেশ সেই দেশে আক্রমন করবে। লিথুনিয়া এবং পোল্যান্ডও ন্যাটো সদস্য দেশ যার জন্য রাশিয়া কালিনিনগ্রাদের নিরাপত্তা বাড়িয়ে দেয়। কালিনিনগ্রাদ ন্যাটো সদস্য দেশগুলোর মাঝে রাশিয়ার একটি সামরিক ঘাঁটি। কালিনিনগ্রাদের পূর্বে রয়েছে বেলারুশ যা রাশিয়ার মিত্রদেশ। রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের সময় থেকেই বেলারুশ রাশিয়াকে সহায়তা করছে। বেলারুশের মাধ্যমেই রাশিয়া কালিনিনগ্রাদের সাথে ভূমিতে সংযোগ রাখতে পেরেছে। বেলারুশ ও কালিনিনগ্রাদের মধ্যে ৬৫ কিলোমিটার লম্বা সংকীর্ন একটি পথ রয়েছে যাকে সোয়ালকি গ্যাপ বলা হয়। এই সোয়ালকি গ্যাপের পাশেই রয়েছে লিথুয়ানিয়া, লাটাভিয়া এবং এস্তেনিয়া, এই তিনটি দেশই ন্যাটো দেশ। 

ভবিষ্যতে রাশিয়া ও ন্যাটোর মধ্যে যুদ্ধ হলে রাশিয়া খুব সহজেই সোয়ালকি গ্যাপের মাধ্যমে এই তিনটি দেশকে ইউরোপের মূল ভূখন্ড থেকে আলাদা করে দিতে পারবে। যার ফলে বাকী ন্যাটো দেশগুলো এই তিনটি দেশকে সহায়তা করতে হলে সরাসরি আকাশ পথেই আসতে হবে কারন বাল্টিক সাগরে রাশিয়ান নৌবাহিনী রয়েছে। কালিনিনগ্রাদ রাশিয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ন তার অন্যতম একটি কারন হল এখানের বন্দর। রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গ সহ বেশ কিছু বন্দর শীতকালে কয়েকমাসের জন্য পুরো বরফাচ্ছাদিত হয়ে যায় যার জন্য রাশিয়ার বানিজ্যের জন্য এমন বন্দর দরকার যে বন্দর সারাবছর সচল থাকে। এই জন্য রাশিয়া ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দখল করে নেয়। বাল্টিক সাগরে অবস্থিত কালিনিনগ্রাদের বন্দরও সারাবছর সচল থাকে যা রাশিয়ার যুদ্ধজাহাজ ও বানিজ্যিক জাহাজগুলোর জন্য গুরুত্বপূর্ন। কালিনিনগ্রাদ রাশিয়ার গুরুত্বপূর্ন শিল্পাঞ্চল। রাশিয়ার মোট টেলিভিশনের ৩০ শতাংশই এখানে তৈরি হয়। সোভিয়েত ইউনিয়ন কালিনিনগ্রাদকে হংকং এর মতো অর্থনৈতিক কেন্দ্র তৈরি করতে চেয়েছিল একসময়। এজন্য বিদেশী বিনিয়োগকারীদের এখানে কর ছাড় দেওয়া হয়েছিল কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের এই উদ্দেশ্য সফল হয়নি। বলা হয় এই জন্য ১৯৯০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন কালিনিনগ্রাদকে জার্মানিকে দিয়ে দেওয়ারও পরিকল্পনা করেছিল, তবে রাশিয়া এই কথা কখনও স্বীকার করেনা। কিন্তু ২০১০ সালে এক জার্মান সংবাদপত্র একটি আর্টিকেলে জানায় ১৯৯০ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন পশ্চিম জার্মানিকে কালিনিনগ্রাদ দিয়ে দেওয়ার জন্য চিঠি লিখেছিল। যদিও এই ঘটনার সত্যতার কোনও প্রমান পাওয়া যায়নি। যদি সোভিয়েত ইউনিয়ন সেসময় পশ্চিম জার্মানিকে কালিনিনগ্রাদ দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েও থাকতো তাহলেও পশ্চিম জার্মানি এই প্রস্তাব গ্রহন করতে পারতোনা সেসময় কারন সেসময় দুই জার্মানির সরকারই একক জার্মানি গঠনের কাজ করছিলো। ব্রিটেন ও ফ্রান্স দুই জার্মানির এক হয়ে যাওয়ার বিরোধী ছিল। এই জন্য জার্মানি সেসময় একটি চুক্তি করে। চুক্তি অনুযায়ী জার্মানি বিদেশী কোনও ভূমিতে অধিকার দাবী করতে পারবেনা এবং বিদেশী ভূমি নিতেও পারবেনা। এই জন্য সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রস্তাব গ্রহন করলে দুই জার্মানি এক হতে পারতোনা। ২০০১ সালে জার্মানি ও ইউরোপীয়ান ইউনিয়নের উপর কালিনিনগ্রাদকে রাশিয়া থেকে আলাদা করার বিষয়ে অভিযোগ উঠেছিল। বলা হয়েছিল সেসময় জার্মানির দেওয়া ২২ মিলিয়ন পাউন্ড ঋন শোধ করতে পারছিলোনা রাশিয়া সেজন্য জার্মানি এর বদলে কালিনিনগ্রাদ নিতে আগ্রহী ছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে জার্মানি ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন এই অভিযোগ অস্বীকার করে। বাল্টিক রিপাবলিকান দলও রাশিয়া থেকে কালিনিনগ্রাদকে আলাদা কারার চেষ্টা করেছিল। ১ ডিসেম্বর, ১৯৯৩ সালে কালিনিনগ্রাদে এই দল তৈরি হয়েছিল রাশিয়া থেকে কালিনিনগ্রাদকে আলাদা করে একটি স্বাধীন দেশ গঠনের উদ্দেশ্যে এবং ঐই দল কালিনিনগ্রাদ নাম পরিবর্তন করে পুরোনো কনিংসবার্গ নাম রাখারই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু ২০০৩ সালের ২৬ মার্চ রাশিয়া একটি নতুন আইন তৈরি করে যাতে বলা হয় কোনও রাজনৈতিক দলকে সরকারি স্বীকৃতি পেতে কমপক্ষে দশ হাজার সদস্য লাগবে দলটিতে। এরপরেই সেই বছরই ৩ ডিসেম্বর বাল্টিক রিপাবলিকান দল ভেঙ্গে যায়। স্ট্রাটেজিক ভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন এই কালিনিনগ্রাদকে রাশিয়া কখনওই হাতছাড়া করবেন। কিছু ভূরাজনৈতিক বিশেষজ্ঞগন এটাও দাবী করেছে যে কালিনিনগ্রাদে রাশিয়া পরমানু মিসাইল মোতায়েন রেখেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *