অফবিট

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে জাপান ফিলিপিন্স দখল করতে কি ছক করেছিল?

দক্ষিন এশিয়ায়, পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরে ৭,৬৪১ দ্বীপ নিয়ে গঠিত একটি দেশ ফিলিপিন্স যার সর্বমোট এলাকা তিন লাখ বর্গকিলোমিটার। স্পেন প্রথম কোনও ইউরোপীয়ান দেশ যারা ফিলিপিন্স দখল করে কিন্তু ১৮৯৮ সালে আমেরিকার সাথে স্পেনের যুদ্ধ হয় যাতে স্পেন পরাজিত হয়। ফিলিপিন্সের মানুষ ভাবে তারা হয়ত স্বাধীনতা পাবে এবার কিন্তু আমেরিকা ফিলিপিন্সে তাদের উপনিবেশ স্থাপন করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় ইউরোপের দেশগুলো যেমন ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি এদের গোটা বিশ্বজুড়েই উপনিবেশ ছিল, একসময় আমেরিকাও ব্রিটেনের উপনিবেশ ছিল। ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত হওয়ার পর আমেরিকাতে গনতন্ত্র শুরু হয়। কিন্তু সেই আমেরিকারও উপনিবেশ তৈরি করে ফিলিপিন্সে। আসলে আমেরিকা প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের জন্য ফিলিপিন্সে তাদের উপনিবেশ স্থাপন করেছিল। আমেরিকার ধারনা ছিল প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ফিলিপিন্সে তাদের উপনিবেশ না থাকলে এই বিস্তীর্ন অঞ্চলে তাদের প্রভাব থাকবেনা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ঠিক এটাই চাইছিল জাপান। জাপান মনে করতো পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল তাদের এবং এখানে বাইরের কোনও দেশ থাকবেনা। তাছাড়া জাপানের কাছেই ফিলিপিন্স যার কারনে স্ট্রাটেজিক ভাবে ফিলিপিন্স অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন ছিল জাপানের কাছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আমেরিকা ছিল জাপানের বিরুদ্ধে তাই জাপানের লক্ষ্য ছিল ফিলিপিন্স দখল করা যাতে দক্ষিন পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরে আমেরিকার কোন ঘাঁটি না থাকে এবং তাদের লজিস্টিকে কোনও সমস্যা না হয়। ঠিক এই জন্যই জাপান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ফিলিপিন্স আক্রমন করে।

দিনটা ৮ ডিসেম্বর, ১৯৪১, ফিলিপিন্সে থাকা আমেরিকান সেনারা খবর পায় জাপান পার্ল হারবার বন্দরে আক্রমন করেছে। ফিলিপিন্সে আমেরিকার সেনাবাহিনীর দায়িত্বে ছিল জেনারেল ডাগলাস ম্যাকার্থার। জাপানকে প্রতিহত করবার জন্য ডাগলাস ম্যাকার্থার ঠিক করে বি ১৭ বোম্বার বিমানকে পাঠাবে। ফিলিপিন্সে আমেরিকান বায়ুসেনার দায়িত্বে থাকা ক্যাপ্টেন লুইস এইচ ব্রেরেটনও চাইছিলো পার্ল হারবারে জাপানের উপর আক্রমন করতে। ফিলিপিন্সে আমেরিকান সেনা রাত তিনটের সময় পার্ল হারবারে আক্রমনের খবর পায়। ম্যাকর্থার সেকারনে রাতে আক্রমন করার আদেশ দেয়নি ব্রেরেটনকে বরং পরের দিন সকালে আক্রমন করার নির্দেশ দেয়। কিন্ত ফরমোসা দ্বীপ থেকে জাপানি বায়ুসেনা ফিলিপিন্সের রাজধানী ম্যানিলার উপর দিয়ে ওড়ার সময় লক্ষ্য করে ফিলিপিন্সের সমস্ত এয়ারফিল্ডে আমেরিকান বিমান রয়েছে প্রচুর। আমেরিকান বিমানে তখন জ্বালানি ভর্তি করা হচ্ছিল এবং যুদ্ধের জন্য প্রস্তত করা হচ্ছিল। সাথে সাথে জাপানি বায়ুসেনা ফিলিপিন্সে আমেরিকান বিমানের উপর বোম্বিং শুরু করে। জাপানি আক্রমনে ফিলিপিন্সে আমেরিকার অর্ধেক বিমান ধ্বংস হয়ে যায়। এভাবে পার্ল হারবার ও ফিলিপিন্স উভয় জায়গাতেই আমেরিকা অতর্কিত জাপানি আক্রমনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই আক্রমনের দুই দিন পর ১০ ডিসেম্বর, ১৯৪১ সালে জাপান ফিলিপিন্সের উত্তরে তাদের সেনাবাহিনী পাঠায়। ১২ ডিসেম্বর ফিলিপিন্সের আরও এক দিকে জাপান তাদের সেনাবাহিনী পাঠায় দ্বিমুখী আক্রমনের জন্য। এটা জেনেও জাপানি সেনাবাহিনীকে প্রতিরোধের জন্য কোনও সেনা পাঠায়নি ডাগলাস ম্যাকার্থার কারন তার ধারনা ছিল জাপান আমেরিকাকে বিভ্রান্ত করবার জন্য এসব ছোট ছোট আক্রমন করছে, জাপানের আসল আক্রমন অন্যদিক দিয়ে হবে, সিঙ্গাপুরেও জাপান এভাবেই আক্রমন করেছিল। ম্যাকার্থারের অনুমান একদম সঠিক ছিল, ২২ ডিসেম্বর প্রায় ৪৩,০০০ জাপানি সেনার বিশাল বহর ফিলিপিন্সের রাজধানী ম্যানিলা থেকে দুইশো কিলোমিটার দূরে ল্যান্ড করে। এর আগেই দুটো জাপানি সেনাবাহিনী আগে থেকেই এসে পৌঁছেছিল ফিলিপিন্সে সুতরাং ম্যাকার্থার বুঝে যায় দ্বিমুখী আক্রমন হবে তাদের উপর। 

ফিলিপিন্সে সেসময় প্রায় দেড় লাখ আমেরিকান ও ফিলিপিন্সের সেনা ছিল কিন্তু সমস্যা ছিল তাদের অধিকাংশ রিজার্ভ সেনা ছিল এবং ততটা প্রশিক্ষিত ছিলনা, মাত্র ৩০,০০০ থেকে ৩২,০০০ সেনাই প্রশিক্ষিত সেনা ছিল। সেই তুলনায় জাপান সমস্ত প্রশিক্ষিত সেনা পাঠিয়েছিল উপরন্ত জাপান ম্যেকানাইজড ইনফ্রেন্টি পাঠিয়েছিল অর্থাৎ জাপানি সেনাবাহিনীর সাথে ট্যাঙ্ক, সাঁজোয়া গাড়ি ছিল যার কারনে তাদের প্রতিরোধ করাও সমস্যার ছিল আমেরিকার সেনাবাহিনীর পক্ষে। ম্যাকার্থার আগে থেকেই এরকম পরিস্থিতির জন্য তৈরি ছিল। এর জন্য ম্যাকার্থার অরেঞ্জ নামে একটি পরিকল্পনা তৈরি করেছিল। এই পরিকল্পনা অনুযায়ী ফিলিপিন্সের রাজধানী ম্যানিলা থেকে সমস্ত প্রশাসনিক ব্যক্তি শহর ছেড়ে দিয়ে আমেরিকান সেনাবাহিনীর নিরাপত্তায় অন্য একটি দ্বীপে চলে যায়। এই দ্বীপের নাম বাটান দ্বীপ। এই সুযোগে ১৯৪২ সালের ২ জানুয়ারী জাপানি সেনা ম্যানিলা দখল করে নেয়। যুদ্ধে অনেক সময় যে পক্ষ পরজিত হওয়ার কাছাকাছি চলে যায় সেই পক্ষ নিজের রাজধানী ছেড়ে অন্যত্র চলে যায় যাতে রাজধানী শত্রুপক্ষের হাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানি যখন ফ্রান্স আক্রমন করেছিল তখন ফ্রান্সের বহু মানুষ প্যারিস ছেড়ে চলে গিয়েছিল। ম্যাকার্থার নেতৃত্বে ম্যানিলা ছেড়ে আশি হাজার সেনা ও পঁচিশ হাজার সাধারন মানুষ এই বাটান দ্বীপে চলে যায়। কিন্তু এই দ্বীপে এত মানুষের জন্য খাদ্যের সমস্যা দেখা যায়, তার উপর ম্যালেরিয়ার মতোন রোগের কারনে সেনাবাহিনীও দুর্বল হয়ে পড়তে থাকে। তবুও জাপানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে এই বাটান দ্বীপে আমেরিকান সেনাবাহিনীর প্রবল যু্দ্ধ হয়। বাধ্য হয়ে ফিলিপিন্সে জাপানি সেনাবাহিনীর প্রধান মাসাহারু হোমা জাপানি সেনাবাহিনীকে কিছুটা পিছিয়ে আসতে বলে কারন দুপক্ষই তীব্র লড়াই করছিল। যেখানে জাপানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করছিলো আমেরিকার ও ফিলিপিন্সের সেনাবাহিনী সেখানে ডাগলাস ম্যাকার্থার নিজেই ছিলনা। বাটান দ্বীপ থেকে কিছুটা দূরে ছোট একটি দ্বীপ দ্য রক থেকে নির্দেশ দিত ম্যাকার্থার। সেনাবাহিনী যখন খাদ্য সংকটে ভুগছিল, ম্যালেরিয়ার মতোন রোগে কাহিল ছিল তখন ম্যাকার্থার সেখানে না থাকায় আমেরিকান সেনাবাহিনীর ভিতরেই অনেকেই তার উপর ক্ষুব্ধ ছিল এবং সেনাবাহিনীতে তাকে ব্যাঙ্গ করে দি ডাগআউট ডাগ বলা হতে থাকে। ম্যাকার্থার ফিলিপিন্সে শেষ পর্যন্ত থাকতে চাইছিলো কিন্ত আমেরিকার রাষ্ট্রপতি রুজভেল্ট তাকে ফিলিপিন্স ছেড়ে চলে আসার নির্দেশ দেয় অবশেষে ১২ মার্চ, ১৯৪২ সালে ম্যাকার্থার পেট্রোল বোটে করে অস্ট্রেলিয়া চলে আসে পরিবার সমেত। তখন ফিলিপিন্সে থাকা বাকী আমেরিকান সেনাবাহিনীর দায়িত্ব যায় মেজর জোনাথান এম ওয়েনরাইটের হাতে। কিন্ত মার্চ মাস আসতে আসতে খাদ্য সংকটে ও অসুস্থতায়  আমেরিকান সেনাদের অবস্থা এতটা কাহিল হয়ে যায় যে মোট সেনার মাত্র এক চতুর্থাংশই যুদ্ধে সক্ষম ছিল, অন্যদিকে নতুন করে একুশ হাজার জাপানি সেনা ফিলিপিন্স অভিযানে এসে পড়ে এবং জাপানি আক্রমন পুনরায় শুরু হয় ৩ এপ্রিল। এবার শক্তিশালী জাপানি সেনাবাহিনীর সামনে প্রতিরোধ ভেঙে পড়ে আমেরিকার এবং জোনাথান ওয়েনরাইট তার সেনা সহ দ্য রকে পালিয়ে আসে। পরবর্তী কয়েক সপ্তাহের জন্য রক মিত্রশক্তির অধীনে ছিল কিন্তু ৫ মে জাপানি সেনা দ্য রক আক্রমন করে এবং ৬ মে জোনাথান ওয়েনরাইট তার সম্পূর্ন সেনাবাহিনী সহ আত্মসমর্পন করে। এভাবে পুরো ফিলিপিন্স জাপানের দখলে চলে যায়। 

জাপান এই ফিলিপিন্স অভিযানে ১,২৯,৪৩৫ সেনা, ৯০ ট্যাঙ্ক, ৫৪১ যুদ্ধবিমান পাঠিয়েছিল, বিপরীতে আমেরিকা ও ফিলিপিন্সের প্রায় দেড় লাখ সেনা, ১০৮ ট্যাঙ্ক, ২৭৭ যুদ্ধবিমান ছিল। এই পুরো অভিযানে জাপানের ৭,০০০ সেনা মারা যায় বা আহত হয়, দশ থেকে বারো হাজার সেনা রোগে মারা যায় কিন্ত সেই তুলনায় আমেরিকা ও ফিলিপিন্সের প্রায় ২৫,০০০ সেনা মারা যায়, ২১,০০০ সেনা আহত হয় এবং এক লাখ সেনাকে গ্রেফতার করেছিল জাপানি সেনাবাহিনী। জাপানের ফিলিপিন্স দখলের পর আসল অত্যাচার শুরু করে জাপান। জাপান এই এক লাখ বন্দী সেনাকে রাখার জন্য লুজোন দ্বীপে ক্যাম্প ওডোনেল নামে একটি কেন্দ্র তৈরি করে যা বাটান দ্বীপ থেকে ১০৫ কিলোমিটার দূরে ছিল। যুদ্ধে, খাদ্য সংকটে ও রোগে কাহিল দুর্বল আমেরিকা ও ফিলিপিন্সের সেনাকে মে মাসের তীব্র গরমে হাঁটিয়ে ওই ক্যাম্পে নিয়ে যায় জাপানি সেনাবাহিনী। আটদিন ব্যাপী এই কষ্টকর যাত্রা ইতিহাসে বাটান ডেথ মার্চ নামে কুখ্যাত। এই দীর্ঘ যাত্রায় ব্যাপক শারীরিক অত্যাচার করা হয় বন্দী সেনাদের উপর। যদি কোনও সেনা দুর্বল হয়ে পড়ে যেত তাকে গুলি করে হত্যা করা হত। এই দীর্ঘ যাত্রায় ৫,০০০ থেকে ১৮,০০০ ফিলিপন্সের সেনার মৃত্যু হয় এবং ৫০০ থেকে ৬০০ আমেরিকান সেনার মৃত্যু হয়। ক্যাম্পে পৌঁছেও বন্দীদের উপর ব্যাপক অত্যাচার করে জাপানি সেনা। তবে কয়েক বছরের মধ্যে ফিলিপিন্সে ডাগলাস ম্যাকার্থার আবারও এসেছিল ফিলিপিন্সে জাপানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করতে। জন কস্টেলোর লেখা প্যাসিফিক ওয়ার ১৯৪১- ১৯৪৫ বইতে জাপানের এই ফিলিপিন্স অভিযান সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য রয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *