অফবিট

বইয়ের মধ্যে বোমা ব্যবহার। ইসরায়েলে আত্মঘাতী হামলা

১৯৪৮ সালে ইসরায়েল গঠন হওয়ার পরেই আরব দেশগুলো একযোগে ইসরায়েল আক্রমন করে যদিও ইসরায়েলের কাছে তারা পরাজিত হয়। এরপর জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় আরব দেশগুলো ও ইসরায়েলের মধ্যে একটি শান্তিচুক্তি হয়। চুক্তি অনুযায়ী আরব দেশগুলোকে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কোনওরকম বিরোধীতা করতে বারন করা হয়। কিন্তু চুক্তি সত্বেও মিশর ও জর্ডান ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করে। মিশর ও জর্ডান ইসরায়েলে গোপনে আত্মঘাতী হামলার পরিকল্পনা করে। ইসরায়েল অধ্যুষিত প্যালেস্টাইন এলাকায় থাকা আরবদের মধ্যে থেকে কিছু ব্যক্তিকে ইসরায়েলের মধ্যে আত্মঘাতি হামলার প্রশিক্ষন দেওয়া শুরু করে এই দুটি দেশ। মিশরের দুজন গুরুত্বপূর্ন সামরিক ব্যক্তি ইসরায়েলে এই পুরো অপারেশনের দায়িত্বে ছিল, প্রথমজন হল মিশরের সামরিক ইনটেলিজেন্স অফিসার মোস্তাফা হাফেজ এবং দ্বিতীয়জন হল মিশরের সামরিক অফিসার সালাহ মোস্তাফা মহম্মদ যে জর্ডানে নিযুক্ত ছিল। এই দুজন ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গোপনে গোরিলা আক্রমনের জন্য একটি বাহিনী তৈরি করে। এই বাহিনী মাঝেমধ্যে ইসরায়েলে গোরিলা আক্রমন করতো, এই বাহিনীর সদস্যরা ইসরায়েলে ঢুকে জলের পাইপলাইন নষ্ট করে দিত, রেলওয়ে লাইন ক্ষতিগ্রস্ত করতো, কৃষকদের গুলি করতো, তাদের মাঠ জ্বালিয়ে দিত। বারবার এরকম ঘটনা ঘটায় ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড বেন গ্যুরোন ইসরায়েলের সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দেয় প্রতিরোধ করার। ইসরায়েল ডিফেন্স ফোর্স বা আইডিএফের মধ্যে একটি গোপন বিভাগ ইউনিট ৫০৪ তৈরি করা হয়। ইউনিট ৫০৪কে দায়িত্ব দেওয়া হয় ইসরায়েলে আক্রমনের ব্যাপারে তদন্ত করার। ইউনিট ৫০৪ তদন্ত করে দেখতে পায় জর্ডান ও মিশর সীমান্ত হয়ে গোরিলা আক্রমনকারীরা ইসরায়েলে প্রবেশ করে। ইউনিট ৫০৪ তদন্তের পর গোরিলা আক্রমনকারীদের নাম সহ মোস্তফা হাফেজ ও মোস্তফা মহম্মদের ব্যাপারে পুরো তথ্য আইডিএফকে দেয়।

ইউনিট ৫০৪ এর দেওয়া তথ্য পাওয়ার পরই প্রধানমন্ত্রী বেন গ্যুরোন ও আইডিএফের প্রধান মোসেডাইনের মধ্যে একটি বৈঠক হয়। বেন গ্যুরোন মোসেডাইনকে নির্দেশ দেয় আরও একটি গোপন বিভাগ তৈরি করতে যার খবর সে নিজে ও আইডিএফ প্রধান মোসেডাইন ছাড়া কেউ জানবেনা। নতুন ইউনিটের নাম রাখা হয় ইউনিট ১৮৮ যার প্রধান নিযুক্ত হয় নাতান রডবার্গ। আইডিএফের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন সদস্য নাতান রডবার্গ একজন রাসায়নিক বিজ্ঞানী ছিল যে বিভিন্ন রাসায়নিকের সংমিশ্রনে আধুনিক বোম্ব তৈরি করতে সক্ষম ছিল। ইউনিট ৫০৪ সমস্ত নামের তালিকা ইউনিট ১৮৮কে দেয়, ইউনিট ১৮৮ এর দায়িত্ব ছিল এসব আক্রমনকারীদের হত্যা করা। নাতান রডবার্গ পেন্টাএরিথ্রাটল টেট্রানাইট্রেট নামে একটি রাসায়নিক ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেয়। এই রাসয়নিকের বৈশিষ্ট্য হল, এই রাসায়নিক দ্বারা নির্মিত বোম্বের বিস্ফোরনের মাত্রা একদম কম হয় যাতে শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট মানুষই মারা যেতে পারতো। কিন্ত ইউনিট ৫০৪ ও ১৮৮ এর তৈরি হওয়ার পরেও ইসরায়েলে আত্মঘাতী হামলা একেবারে বন্ধ হয়ে যায়নি। 

১৯৫৩ সালেই মোস্তফা সাম্বেলি নামে এক প্যালেস্টাইনি সন্ত্রাসী জেরুজালেমে ঢুকে দুজন ইসরায়েলি সেনাকে গুলি করে হত্যা করে। এই ঘটনার পর বেন গ্যুরোন মোসেডাইনের সাথে আলোচনা করে মোস্তফা সাম্বেলিকে হত্যা করার জন্য। তবে বেন গ্যুরোন এবার ইউনিট ৫০৪ ও ইউনিট ১৮৮কে এই মিশনের দায়িত্ব দিতে চাইছিলোনা বরং বেন গ্যুরোন অন্য কোনও বিভাগকে এই মিশনের দায়িত্ব দিতে চাইছিলো। মোসেডাইন বেন গ্যুরোনকে আইডিএফের এক অসাধারন প্রতিভাবান, দক্ষ ২৫ বছর বয়সী যুবকের কথা জানায় যে এই মিশনের জন্য একদম উপযুক্ত। এই যুবকটির নাম এরিয়াল শ্যারন বা এরিক। এরিয়াল শ্যারনই পরবর্তী কালে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিল। এরিয়াল শ্যারনকে মোস্তাফা সাম্বেলিকে হত্যার দায়িত্ব দেওয়া হয়। এরিয়াল শ্যারন তার একটি ছোট দল তৈরি করে মোস্তাফা সাম্বেলির ব্যাপারে অনুসন্ধান শুরু করে। মোস্তাফা সাম্বেলির ব্যাপারে তথ্য পেয়ে এরিয়াল শ্যারন মোসেডাইনকে এক অদ্ভুত পরিকল্পনার কথা বলে যা এর আগে ইসরায়েল কোনওদিন ভাবেওনি। এরিয়াল শ্যারন মোস্তাফা সাম্বেলির পুরো গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় যাতে ভবিষ্যতে কেউ ইসরায়েলে আক্রমনের আগে বহুবার চিন্তা করে এবং ঠিক এটাই করে এরিয়াল শ্যারন। মোস্তফা সাম্বেলির গ্রামের অনেক মানুষের মৃত্যু হয় কিন্তু সেদিন মোস্তাফা সাম্বেলি গ্রামে না থাকার কারনে বেঁচে যায়। এরপর এরিয়াল শ্যারন প্রধানমন্ত্রী বেন গ্যুরোনকে জানায় তাকে একটি বিশেষ দল দেওয়ার যাতে মোস্তাফা সাম্বেলিকে খুঁজে বের করা যায়। সেইমতো আইডিএফে ইউনিট ১০১ তৈরি হয় যার দায়িত্ব এরিয়াল শ্যারনের হাতে যায়। এরিয়াল শ্যারন জেরুজালেমের পাহাড়ে একটি ঘাঁটি তৈরি করে। এরিয়াল শ্যারন নিজে ইউনিট ১০১ এর সদস্যদের প্রশিক্ষন দেয় এবং নির্দেশ দেয় ইসরায়েল ইনটেলিজেন্স সংস্থা আমানের সাথে তারা কোনও সংযোগ রাখবেনা, তারা তাদের নিজস্ব নেটওয়ার্ক তৈরি করবে। 

১৯৫৩ সালে কিছু সন্ত্রাসী ইসরায়েলের কিবিয়া গ্রামে ঢুকে সেখানে এক মহিলা ও তার দুই বাচ্চাকে হত্যা করে। ইউনিট ১০১কে ওই সন্ত্রাসীদের হত্যার দায়িত্ব দেওয়া হয়। এই ঘটনার পূর্ন তদন্ত করে সন্ত্রাসীদের গ্রামে ঢুকে হত্যা করে ইউনিট ১০১. আমেরিকা সহ জাতিসংঘ ইসরায়েলের এই অভিযানের সমালোচনা করে, জাতিসংঘ ইসরায়েল সেনাবাহিনীকে অভিযুক্ত করে কিন্তু ইসরায়েল জানায় আইডিএফ এই ঘটনায় যুক্ত নয়। জাতিসংঘ অনুসন্ধান করে দেখতে পায় বাস্তবে কিবিয়া গ্রামের আশেপাশেও আইডিএফের কোনও বিভাগ ছিলনা। আসলে ইউনিট ১০১ এই অভিযান করেছিল, আইডিএফেরও কেউ জানতোও না শুধু সেনাপ্রধান মোসেডাইন ও প্রধানমন্ত্রী বেন গ্যুরোন জানতো। কোনও প্রমান না পাওয়া যাওয়ায় জাতিসংঘ আইডিএফকে অভিযুক্ত করতে পারেনি। এই অপারেশনের পর ইউনিট ১০১ সরকারি ভাবে আইডিএফের অংশ হয় এবং প্যারাট্রুপারদের প্রশিক্ষন দেওয়া শুরু করে। কিন্ত এখনও ইসরায়েলে বারংবার আত্মঘাতী হামলার মূলচক্রী মোস্তাফা হাফেজ ও মোস্তাফা মহম্মদকে ধরা বাকী ছিল। ১৯৫৬ সালে দক্ষিন ইসরায়েলের নাহাল ওজেড নামক সীমান্তবর্তী এলাকায় মোস্তফা হাফেজের নেতৃত্বে কয়েকজন সন্ত্রাসী কিছু ইসরায়েলি নাগরিকদের হত্যা করে এবং আইডিএফের একজন লেফটেন্যান্ট জেনারেল রয় রডবার্গকেও হত্যা করে। নাহাল ওজেড গাজা সীমান্তের পাশেই, যার কারনে গাজা স্ট্রিপ থেকে সন্ত্রাসীরা এখানে এসেছিল। এই ঘটনায় প্রচন্ত ক্ষুব্ধ হয় আইডিএফ প্রধান মোসেডাইন কারন মৃত্যুর একদিন আগেই রয় রডবার্গের সাথে কথা হয়েছিল মোসেডাইনের। সন্ত্রাসীরা মোসেডাইনকে নিষ্ঠুর ভাবে হত্যা করেছিল, হত্যার পর রয় রডবার্গের চোখ উপড়ে ফেলে গোটা শরীর টুকরো টুকরো করে ফেলেছিল সন্ত্রাসীরা। এই ঘটনার প্রতিশোধ নিতে এরিয়াল শ্যারনকে ডেকে পাঠায় মোসেডাইন। এরিয়াল শ্যারনের কাছে একজন এজেন্ট ছিল যে তার হয়েও কাজ করতো আবার মিশরের হয়েও কাজ করতো অর্থাৎ ওই ব্যক্তি ডবল এজেন্ট ছিল। ওই ব্যক্তির সাথে মোস্তফা হাফেজের যোগাযোগ ছিল। ততদিনে মোস্তফা হাফেজ মিশরের ইনটেলিজেন্স বিভাগের প্রধান হয়ে গিয়েছিল, তাই মোসেডাইন সবার প্রথমে মোস্তফা হাফেজকেই হত্যার সিদ্ধান্ত নেয়। এরিয়াল শ্যারন নাতান রডবার্গকে ডেকে পাঠায়। এরিয়াল শ্যারন জানতো ইউনিট ১০১ এর ব্যাপারে খবর ছিল মোস্তফা হাফেজের কাছে। তাই এরিয়াল শ্যারন এমন একটি বই তৈরি করায় যে বইয়ে ইউনিট ১০১ এর ব্যাপারে নকল তথ্য ছিল। বইয়ের উপরে এরিয়াল শ্যারনের স্বাক্ষর ছিল। এরিয়াল শ্যারন নাতান রডবার্গকে এমন একটি বিস্ফোরক তৈরির নির্দেশ দেয় যা বইয়ের মধ্যে থাকবে এবং বই খোলার সাথে সাথে বিস্ফোরন হবে। নাতান রডবার্গ এরকমই বিস্ফোরক তৈরি করে। এরপর এরিয়াল শ্যারন ওই বই তার এজেন্টের মাধ্যমে মোস্তফা হাফেজের কাছে পাঠায়। বই খোলার সাথে সাথে প্রচন্ড বিস্ফোরনে মৃত্যু হয় মোস্তফা হাফেজের। মিশর সব বুঝতে পেরেও কিছু করতে পারেনি কারন মিশর জনসমক্ষে কখনওই স্বীকার করবেনা যে তাদের ইনটেলিজেন্স বিভাগের প্রধানের মৃত্যু হয়েছে ইসরায়েলের কারনে। তাই পরেরদিন মিশর জানায় গাড়ি দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে মোস্তফা হাফেজের। একইরকম ভাবে বইয়ের মাধ্যমে মোস্তফা মহম্মদকেও হত্যা করে ইসরায়েল। মোস্তফা হাফেজ ও মোস্তফা মহম্মদের মৃত্যুর পর ইসরায়েলে আত্মঘাতী হামলা বন্ধ হয়ে যায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *