নকল পা নিয়ে গোয়েন্দাগিরি। এক মেয়ের নকল পা নিয়ে গোয়েন্দাগিরিতে অবাক হয়েছিল গোটা ইনটেলিজেন্স বিভাগ
১৯৩৩ সালে আমেরিকার একটি মেয়ে একদিন পাখি শিকার করতে বিয়ে অসাবধান বশত একটি তারে আটকে যায় এবং নিজের বাম পায়ে গুলি করে ফেলে ভুল করে। হসপিটালে ডাক্তার তাকে বলে তার পায়ে গ্যাংরিন ধরে গেছে যা থেকে বাঁচতে হলে পুরো বাম পা বাদ দিতে হবে। ডাক্তারের কথা মতো মেয়েটি নিজের বাম পা কেটে বাদ দিয়ে দেয় এবং নকল কাঠের পা লাগিয়ে নেয়। ওই মেয়টির স্বপ্ন ছিল আমেরিকার কূটনীতিক হওয়া কিন্তু আমেরিকার বিদেশনীতিতে স্পষ্ট ছিল যে কোনও প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে কূটনীতিক হিসাবে নিয়োগ করা হবেনা। কিন্তু ওই মেয়েটির জেদ ও ইচ্ছে এতটাই প্রবল ছিল যে আমেরিকা ও ব্রিটেনের ইনটেলিজেন্স বিভাগ তাকে তাদের এজেন্ট হিসাবে নিয়োগ করতে বাধ্য হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ওই মেয়েটি ফ্রান্সে অ্যাক্সিস পাওয়ার বিশেষ করে নাজি জার্মানির বিরুদ্ধে এমন সব মিশন করেছিল যে ইনটেলিজেন্সের দুনিয়ায় আজও তার উদাহারন দেওয়া হয়। নিজের সাথীদের অত্যন্ত সুরক্ষিত জেল থেকে ভাগানো হোক কিংবা শত্রুর গড়ে গিয়ে সেখানে ইনটেলিজেন্স নেটওয়ার্ক তৈরি করা হোক, ভার্জিনিয়া হল নামে ওই মেয়েটি একটি পা কাঠের হওয়া সত্বেও ইনটেলিজেন্সের দুনিয়ায় এক অসাধারন দৃষ্টান্ত তৈরি করেছিল যাতে আমেরিকা ও ব্রিটিশ ইনটেলিজেন্স বিভাগ পর্যন্ত অবাক হয়ে গিয়েছিল সেসময়।
১৯০৬ সালের ৬ এপ্রিল আমেরিকার মেরিল্যান্ডে জন্ম হয় ভার্জিনিয়া হলের। স্কুলের পড়া শেষ করে ভার্জিনিয়া হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে রেডক্লিফ কলেজ ও কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বার্নার্ড কলেজ থেকে ফরাসি, জার্মান ও ইতালিয়ান ভাষা শেখে। এরপর জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও ফরাসি ও অর্থনীতি শেখে ভার্জিনিয়া হল। এরপর ১৯৩১ সালে পোল্যান্ডে আমেরিকার দূতাবাসে ক্লার্ক হিসাবে নিয়োগ পায় ভার্জিনিয়া। ১৯৩৩ সালে তাকে তুরস্কে পাঠানো হয়। এখানেই তার সাথে দুর্ঘটনা ঘটে যাতে তার একটা পা কাঠের লাগাতে হয়। ভার্জিনিয়া তার এই কাঠের পায়ের নাম দিয়েছিল কাঠবার্ট। এরপর তিনি ভেনিস ও এস্তোনিয়াতেও ক্লার্ক হিসাবে কাজ করেন। ভার্জিনিয়া আমেরিকার কুটনীতিক হিসাবে কাজ করার অনেক চেষ্টা করেছিলেন কিন্ত প্রতিবন্ধী হওয়ার কারনে তার আবেদন বারবার ব্যর্থ হয়ে যায়। এমনকী তিনি আমেরিকার রাষ্ট্রপতি ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্টের কাছেও আবেদন করেছিলেন কিন্তু সেখানেও ব্যার্থ হন। বাধ্য হয়ে ১৯৩৯ সালের মার্চ মাসে তিনি চাকরি ছেড়ে দেন।
১৯৪০ সালের ফেব্রুয়ারীতে তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফ্রান্সের সেনাবাহিনীর অ্যাম্বুলেন্স চালক হিসাবেও কাজ করেন কিন্তু জুন মাসে জার্মানীর কাছে ফ্রান্সের পরাজয়ের পর তিনি স্পেন চলে আসেন। এখানে তার সাথে সাক্ষাৎ হয় ব্রিটিশ ইনটেলিজেন্স অফিসার জর্জ বিলোসের, এখান থেকেই তার জীবন সম্পূর্ন পরিবর্তিত হয়। জর্জ বিলোস ভার্জিনিয়া হলকে তার বন্ধু নিকোলাস বোডিংটনের কাছে ইংল্যান্ডে পাঠায়, এখান থেকেই ইনটেলিজেন্স দুনিয়ায় পা রাখে ভার্জিনিয়া হল। নিকোলাস বোডিংটন সেসময় ইংল্যান্ডে নতুন গঠিত স্পেশাল অপারেশন এক্সিকিউটিভ বা এসওইতে কর্মরত ছিল। এখানেই এপ্রিল মাস থেকে প্রশিক্ষন হয় ভার্জিনিয়া হলের এবং তাকে ফ্রান্সের ভিশিতে জার্মান নাজি বাহিনীর উপর নজর রাখার জন্য পাঠানো হয়। এখানে নিউইয়র্ক পোস্টের সাংবাদিকের ছদ্মবেশে নিয়োগ করা হয়েছিল তাকে।
লিওন শহরে ভার্জিনিয়া তার নিজস্ব একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করে কাজের জন্য যার নাম ছিল হেকলার, এখানে বিভিন্ন পেশার মানুষ যুক্ত ছিল। হেকলারের মাধ্যমে জার্মানদের তথ্য ব্রিটেন পাঠাতে শুরু করে ভার্জিনিয়া। লিওনে জার্মান ইনটেলিজেন্স বিভাগও সক্রিয় ছিল কিন্ত তাও ভার্জিনিয়া হলকে তারা খুঁজে বার করতে পারেনি।
অক্টোবর, ১৯৪১ সালে মার্শেলইলে হওয়া এসওই এর একটি বৈঠকে উপস্থিত থাকবার কথা থাকলেও শেষ মুহুর্তে সেখানে যায়নি ভার্জিনিয়া হল। ভার্জিনিয়ার ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল কারন সেদিন ওই গোপন বৈঠকের স্থানে ফ্রান্সের পুলিশ অভিযান করে অনেককে গ্রেফতার করে। এরপর আরও দ্বিগুণ গতিতে কাজ শুরু করে ভার্জিনিয়া। তার তৈরি হেকলার নেটওয়ার্ক এতটাই গুপ্ত ছিল যে এসওই পর্যন্ত এব্যাপারে কোনও তথ্য জানতে পারেনি। একবার এসওই জর্জকে পাঠায় ভার্জিনিয়ার কাছে কিন্তু জর্জকেও কোনও তথ্য দেয়নি ভার্জিনিয়া।
১৯৪২ সালে ভার্জিনিয়াকে দায়িত্ব দেওয়া হয় ফ্রান্সে আকাশ যুদ্ধে ইংল্যান্ডের যেসব পাইলটের বিমান জার্মান অধুষ্যিত এলাকায় ধ্বংস হয়েছে তাদের খুঁজে বের করে ইংল্যান্ডে ফেরত পাঠানোর। ভার্জিনিয়া হল তার নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে এসব পাইলটদের স্পেন হয়ে ইংল্যান্ডে ফেরত পাঠায়। এই মিশনের সময়েই জার্মানদের চোখ পড়ে ভার্জিনিয়া হলের উপর। জার্মানরা ভার্জিনিয়া হলের নাম দিয়েছিল দি লিমপিং লেডি।
অক্টোবর, ১৯৪১ সালে ফ্রান্সের পুলিশ বারোজন ব্রিটিশ এজেন্টকে গ্রেফতার করে বারগেরাকের মৌজ্যাক জেলে বন্দী করে রেখেছিল। জেল বন্দীদের চিঠি জর্জ বেগুই গোপনে ভার্জিনিয়া হলের কাছে পৌঁছে দিয়েছিল, তখন থেকেই এসব এজেন্টদের জেল থেকে বের করার পরিকল্পনা শুরু করে হল। হল জেল বন্দী এক এজেন্ট জিয়েন ব্লোচের স্ত্রী গ্যাবি ব্লোচকে নিয়োগ করে তার পরিকল্পনায়। গ্যাবি তার স্বামীর জন্য প্রায়ই খাদ্য, জল নিয়ে যেত জেলে তার সাথে লুকিয়ে এমন কিছু জিনিস নিয়ে যেত যার সাহায্যে জেলের চাবি তৈরি করা যেত। হল নিজেও লুকিয়ে জেলে যেত মাঝে মধ্যে এবং এসব এজেন্টদের জেল থেকে পালানোর সমস্ত ব্যবস্থা করে। ১৫ জুলাই, ১৯৪২ সালে এই বারোজন এজেন্ট জেল থেকে পালায়। ১১ আগস্ট পর্যন্ত তারা জঙ্গলে লুকিয়ে থাকার পর লিওনে হলের সাথে দেখা করে। সেখান থেকে তাদের স্পেন পাঠায় হল এবং স্পেন থেকে ইংল্যান্ডে যায় তারা।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে স্পেন নিরপেক্ষ থাকায় স্পেনের মাধ্যমে ইংল্যান্ডে তথ্য বা এজেন্ট পাঠাতো ভার্জিনিয়া হল। এই মিশনে এসওই তাজ্জব হয়ে যায়। এই ঘটনায় জার্মান ইনটেলিজেন্স বিভাগ গেস্টাপো এতটা ক্রুদ্ধ হয় যে ভার্জিনিয়া হলকে গ্রেফতার করতে পাঁচশো এজেন্ট পাঠায় ভিশিতে। ভার্জিনিয়া হল বুঝে যায় তাকে ফ্রান্স ছেড়ে চলে যেতে হবে নাহলে যেকোনও মহূর্তে গেস্টাপো তাকে ধরে ফেলবে। ৭ নভেম্বর, ১৯৪২ সালে লিওন থেকে ট্রেনে পেরপিগ্যানান যায় হল এবং প্রচন্ড কষ্ট করে মাত্র দুইদিনে পাইরিনেস থেকে পঞ্চাশ মাইল রাস্তা হেঁটে অতিক্রম করে স্পেন পৌঁছায়। স্পেনের পুলিশ অবৈধ ভাবে প্রবেশের কারনে হলকে গ্রেফতার করেছিল কিন্তু আমেরিকার দূতাবাস তাকে ছাড়িয়ে আনে। মাদ্রিদে কিছুসময় এসওই এর হয়ে কাজ করার পর জুলাই, ১৯৪৩ সালে ইংল্যান্ড ফিরে যায়। ভার্জিনিয়া হলকে তার কাজের জন্য সম্মান জানিয়ে দি অর্ডার অফ দি ব্রিটিশ এম্পায়ারের সদস্য করা হয়।
লন্ডনে কিছুসময় থাকবার পর পুনরায় ফ্রান্স যাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করে ভার্জিনিয়া হল। কিন্তু এসওই তাকে ফ্রান্স যাবার অনুমতি দেয়নি কারন এসওই এর ধারনা ছিল গেস্টাপো জেনে গিয়েছিল হলের পরিচয়। বাধ্য হয়ে ভার্জিনিয়া হল আমেরিকার সাথে যোগাযোগ করে এবং আমেরিকার অফিস অফ স্ট্রাটেজিক সার্ভিসে বা ওএসএসে কাজ পায় হল।
২১ মার্চ, ১৯৪৪ হলকে পুনরায় ফ্রান্স পাঠানো হয়। ওএসএস ভার্জিনিয়াকে একজন বৃদ্ধ ফ্রান্স নারী মার্সেল মন্টাগনের ছদ্মবেশে ফ্রান্স পাঠিয়েছিল। এখানে হলের সাংকেতিক নাম ছিল দিয়ানে। ফ্রান্সে হলকে কাজ দেওয়া হয়েছিল জার্মান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে গোরিলা আক্রমনের জন্য স্থানীয় প্রতিবাদী সংগঠন ম্যাকুইসকে প্রশিক্ষন দেওয়া যাতে ১৯৪৪ সালের ৬ জুন মিত্রশক্তির নরম্যান্ডি আক্রমনের সময় এই সংগঠন তাদের সাহায্য করে। ভার্জিনিয়া হল ফ্রান্সে নাজি সেনাবহিনীর বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদী সংগঠন তৈরি করতে সক্ষম হয় এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বাকী সময় ফ্রান্সে একাধিক মিশনে সফল ভাবে কাজ করে হল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ওএসএস থেকে ইস্তফা দিয়ে দেয় ভার্জিনিয়া হল। ১৯৪৭ সালে আমেরিকার ইনটেলিজেন্স সংস্থা সিআইএতে যোগ দেয় হল। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে তথ্য সংগ্রহের জন্য একাধিক ইউরোপীয়ান দেশে তাকে পাঠায় সিআইএ। ১৯৪৮ সালে হল সিআইএর কাজ ছেড়ে দেয় তবে ১৯৫০ সালে আবারও সিআইএ তাকে নিযুক্ত করে। এবার ভার্জিনিয়া হলকে দায়িত্ব দেওয়া হয় ফ্রান্স সহ একাধিক ইউরোপীয়ান দেশে সোভিয়েত ইউনিয়নের সম্ভাব্য আক্রমনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী সংগঠন তৈরি করার।
১৯৬৬ সালে ৬০ বছর বয়সে অবশেষে নিয়মমাফিক অবসর নেয় ভার্জিনিয়া হল। ১৯৫৭ সালে ওএসএস লেফটেন্যান্ট পল গইলটের সাথে তার বিবাহ হয়। মেরিল্যান্ডেই একটি ফার্মে তারা উভয়ে থাকতেন। ১৯৮২ সালের ৮ জুলাই সেখানেই মৃত্যু হয় ভার্জিনিয়া হলের। ১৯৮৮ সালে মিলিটারি ইনটেলিজেন্স ক্রপসের হল অফ ফেমে তার নাম যুক্ত করা হয়। ২০১৬ সালে সিআইএর প্রশিক্ষন কেন্দ্রের নাম রাখা হয় ভার্জিনিয়া হল এক্সপিডিশনারি সেন্টার। গুপ্তচরবৃত্তির দুনিয়ায় ভার্জিনিয়া হল একটি চিরস্মরনীয় নাম।