অফবিট

সৌদি আরবের দুই ট্রিলিয়ন ডলারের স্বপ্নের শহর তৈরির প্রজেক্ট ব্যর্থ!

মিশরের পিরামিডকে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ স্থাপত্যশিল্পের নিদর্শন বলা হয়। কারন আজ থেকে প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে কোনও আধুনিক যন্ত্রাংশ, প্রযুক্তি ছাড়াই পিরামিডের মতোন বিশালাকৃতির স্থাপত্য নির্মান রীতিমতো অবাক করে দেওয়ার মতোন ব্যাপার। বিভিন্ন কাল ধরে বিজ্ঞানীরা পিরামিড নির্মানের ব্যাপারে বিভিন্ন তথ্য দিয়ে এসেছে কিন্তু এখনও তৎকালীন মিশরে নির্মিত পিরামিড রহস্যময়। এই জন্য মিশরের পিরামিড বিশ্বের সাত আশ্চর্যের মধ্যে একটি। মিশরের পিরামিডগুলোর মধ্যে সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ বলা হয় গিজায় অবস্থিত তিনটি পিরামিডকে। ফারাও কুফুর নেতৃত্বে এই তিনিটি পিরামিড নির্মান করা হয়েছিল যার জন্য ফারাও কুফু ইতিহাসে অমর হয়ে গেছে। এমনই এক স্বপ্ন দেখেছিল সৌদি আরবের যুবরাজ মহম্মদ বিন সালমান। তিনি সৌদি আরবে এমন এক আধুনিক শহর নির্মানের পরিকল্পনা করেছিলেন যা একশো শতাংশ দূষনমুক্ত হবে। এই শহরকে এমন ভাবে তৈরি করার কথা হয়েছিল যেখানে কোনওরকম কার্বন নির্গমন ছাড়াই মানুষের জরুরী চাহিদা পূরন হবে, যেখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে এমন এক অসাধারন স্থাপত্যকার্য থাকবে যা গিজার পিরামিডকেও হার মানাবে। এই আধুনিক শহর নির্মান প্রকল্পের নাম দেওয়া হয়েছিল প্রজেক্ট নিওম। 

২৪ অক্টোবর, ২০১৭ সালে রিয়াদে অনুষ্ঠিত হওয়া এক সম্মেলনে প্রজেক্ট নিওমের ঘোষনা করেন মহম্মদ বিন সালমান। এই সম্মেলনে তিনি বলেছিলেন সৌদি আরব খুব শীঘ্রই তার উত্তর পশ্চিমে অবস্থিত তাবুক প্রদেশে এমন একটি শহর নির্মান করবে যেখানে ২০৪০ সালের মধ্যে নয় মিলিয়ন লোক বসবাস করবে এবং এই শহরে প্রত্যেক মানুষের জরুরী জিনিস মাত্র পাঁচ মিনিট দূরত্বের মধ্যে পাওয়া যাবে। সৌদি আরব দাবী করেছিল এই শহর এতটাই আধুনিক হবে যে এখানে খাদ্য সরবরাহ থেকে শুরু করে, রসদ সরবরাহ এবং পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার কাজ পর্যন্ত রোবটে করবে। এই শহরে হাইপারলুপ ট্রেন থেকে শুরু করে উড়ন্ত গাড়ির মতোন পরবর্তী প্রজন্মের পরিবহন ব্যবস্থা থাকবে বলেও জানানো হয়েছিল। পুরো নিওম শহর দশটি প্রধানভাগে বিভক্ত থাকার কথা বলা হয়েছিল যার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন ভাগ দ্য লাইন। দ্য লাইন মূলত কয়েকশো কিলোমিটার বিস্তৃত একটি সুউচ্চ অট্টালিকার সারি। দ্য লাইনের আওতায়  ১৭০ কিলোমিটার লম্বা বিস্তীর্ন অঞ্চল জুড়ে ৫০০ কিলোমিটার লম্বা এবং ২০০ কিলোমিটার চওড়া অসংখ্য বিল্ডিং তৈরি করার কথা বলা হয়েছিল। দিল্লি থেকে মথুরা পর্যন্ত দূরত্বের সমতুল্য এলাকা জুড়ে এই শহর নির্মানের কথা ছিল। সেসময় প্রজেক্ট নিওমের খবর রাতারাতি ভাইরাল হয়ে গিয়েছিল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। সৌদি আরব প্রজেক্ট নিওমের জন্য কাজ শুরু করে ২০২১ সালে। প্রতিদিন হাজার হাজার টন বালি সরিয়ে শহর তৈরির কাজ চলছিলো। কিন্তু যত সময় এগোচ্ছিল ততই প্রজেক্ট নিওমের বিভিন্ন অংশের কাজ তার নির্ধারিত সময়সীমা অতিক্রম করে যাচ্ছিল। কিন্তু বর্তমানে এই প্রজেক্ট নিওম সৌদি যুবরাজের ২ ট্রিলিয়ন ডলারের ভুল বলা হচ্ছে, সম্ভবত খুব শীঘ্রই অর্থায়ন ও অন্যান্য সমস্যার কারনে এই প্রজেক্ট বন্ধ হয়ে যাবে। 

গ্রীক শব্দ নিও এবং আরবি শব্দ মুস্তাকবাল থেকে নিওম নামটা এসেছে। নিও এর অর্থ নতুন এবং মুস্তাকবালের অর্থ ভবিষ্যৎ। অর্থাৎ নিওমের অর্থ নতুন ভবিষ্যৎ, ২০২১ সালের ২১ জানুয়ারি এই প্রজেক্টের সূচনা হয়। এই প্রজেক্টের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে এর খরচ। ২০২১ সালে যখন প্রজেক্ট নিওম শুরু করা হয় তখন এর বাজেট ধরা হয়েছিল ২০০ বিলিয়ন ডলার, মাত্র তিন বছরে এই প্রজেক্টের খরচ দশগুন বেড়ে হয়ে যায় দুই ট্রিলিয়ন ডলার। সৌদি আরবের জিডিপি ১.১১ ট্রিলিয়ন ডলার, তার থেকেও দ্বিগুন হয়ে গিয়েছে এই প্রজেক্টের খরচ। তবে বিভিন্ন বেসরকারী সংস্থার তথ্য অনুযায়ী প্রজেক্ট নিওমের খরচ দুই ট্রিলিয়ন ডলারেরও অনেক বেশী। এই প্রজেক্টের জন্য সৌদি আরব দীর্ঘমেয়াদি ঋনে পড়তে চলেছে। সৌদি আরব প্রজেক্ট নিওমের জন্য আগেই একটি নির্দিষ্ট অর্থ সঞ্চয় রেখেছিল কিন্তু প্রজেক্টের খরচ এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছে যে সৌদি আরবের সেই অর্থও প্রায় শেষের দিকে। বাধ্য হয়ে অনেক আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে সৌদি আরব ঋন নিচ্ছে। বর্তমানে এই বিশাল প্রজেক্ট চালাতে সৌদি আরবকে প্রতিবছর ৪০-৫০ বিলিয়ন ডলার খরচ করতে হচ্ছে। ২০২৫ সালের পর মুদ্রাস্ফীতির কারনে এই খরচ বেড়ে ৭০ বিলিয়ন ডলার হয়ে যাবার আশঙ্কা রয়েছে। ইতিমধ্যেই প্রয়োজনীয় অর্থের অভাবে প্রজেক্ট নিওমের অনেক অংশেই কাজ বন্ধ হয়ে গেছে যা প্রমান করে সৌদি আরবের মতো ধনী দেশের পক্ষেও এই প্রজেক্টের ব্যায়ভার বহন করা সম্ভব হচ্ছেনা। যার জন্যই মনে করা হচ্ছে হয়ত খুব শীঘ্রই প্রজেক্ট নিওম বন্ধ হয়ে যেতে পারে। প্রজেক্ট নিওমের আরও একটি বড় সমস্যা এর ডেডলাইন। ২০২১ সালে নিওম প্রজেক্ট শুরু করবার সময় সৌদি আরব সরকার জানিয়েছিল ২০২৪ সালের প্রথমদিকে দ্য লাইনের ১৭০ কিলোমিটারের মধ্যে ১৬ কিলোমিটারের কাজ সম্পূর্ন হয়ে যাবে এবং ২০৩০ এর মধ্যে ১.৫ মিলিয়ন লোক নিওম শহরে বসবাসের জন্য চলে আসবে। কিন্তু যে ধীর গতিতে কাজ চলছে তাতে বলা হচ্ছে ২০৩০ এর মধ্যে দ্য লাইনের মাত্র ২.৪ কিলোমিটারের কাজই সম্পূর্ন হবে যাতে মাত্র তিন লাখ লোকই বসবাস করতে পারবে। এখনও পর্যন্ত সৌদি আরব প্রজেক্ট নিওমে তার লক্ষ্যের মাত্র পনেরো শতাংশ কাজই করতে পেরেছে। ২০২১ সালে নিওম প্রজেক্ট শুরু করবার সময় থেকে প্রজেক্ট ঘিরে একাধিক বিতর্ক সামনে এসেছে। কখনও নির্মান শ্রমিকদের মধ্যে সমস্যা আবার কখনও জোরপূর্বক উচ্ছেদের খবরও শোনা গেছে। নিওমের জন্য সৌদি সরকার তাবুক প্রদেশের বিভিন্ন জায়গায় জোরপূর্বক বহু স্থানীয় উপজাতিদের উচ্ছেদ করেছে যারা সেখানে কয়েক প্রজন্ম ধরে বসবাস করছিলো। ২০২০ সালের ১৩ এপ্রিল আব্দুল রহিম নামে এক ব্যক্তি ইন্টারনেটে জানায় তাকে তাবুকে তার ঘর থেকে সৌদি সরকার জোরপূর্বক উচ্ছেদ করেছে। এছাড়া আরও স্থানীয় মানুষজন জানিয়েছে সৌদি সরকার এসব জায়গা থেকে তাদের চলে যাবার জন্য তাদের যে ক্ষতিপূরন দিচ্ছে তা খুবই কম। সৌদি আরব একটি রাজতন্ত্র হওয়ায় এখানে সরকার বিরোধী কোনওরকম বিদ্রোহ হয়না। কিন্তু এসব খবর ইন্টারনেটে আসার ফলে যেসব আন্তর্জাতিক সংস্থা সৌদি আরবকে ঋন দিচ্ছে তারাও ঋন দেওয়ার পরিমান কমিয়ে দিচ্ছে ধীরে ধীরে। প্রজেক্ট নিওমের আরও একটি সমস্যা হচ্ছে প্রযুক্তি। মহম্মদ বিন সালমান জানিয়েছে প্রজেক্ট নিওমে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি থাকবে। কিন্তু বিশেষজ্ঞের দাবী সৌদি আরব যেসব প্রযুক্তির কথা বলেছে সেগুলোর অধিকাংশ এখনও তৈরি হয়নি। যেমন সৌদি দাবী করেছে প্রজেক্ট নিওম ১০০ শতাংশ কার্বন মুক্ত হবে। কিন্তু নয় মিলিয়ন বা নব্বই লাখ মানুষের শহর পুরো কার্বন মুক্ত রাখার পদ্ধতি এখনও তৈরি হয়নি, এতে আরও কিছু বছর সময় লাগবে। তাছাড়া মহম্মদ বিন সালমানের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাতেও খুশী নয় অনেক সংস্থাই। যেমন ২০১৫ সালে সৌদি আরবের প্রতিরক্ষামন্ত্রী থাকাকালীন মহম্মদ বিন সালমান সৌদি আরবের বিরোধী ইয়ামেনের হুথীদের সম্পূর্ন নির্মূল করতে বিশাল সামরিক অভিযানের নির্দেশ দেয়। তার পরামর্শদাতারা তাকে নিষেধ করেছিলো কিন্তু বিন সালমান তার সিদ্ধান্তে অটল থাকে। যার ফলস্বরূপ এই যুদ্ধে প্রচুর সৌদি সেনা ও সাধারন ইয়ামেনবাসীর মৃত্যু হয়। এই ঘটনা একবিংশ শতকের অন্যতম ব্যার্থ সামরিক অভিযান ছিল। ২০১৫ সালে সৌদি আরব বিন সালমানের নির্দেশে কাতারকে চারদিক দিয়ে অবরুদ্ধ করে দিয়েছিল কিন্তু ২০১৭ সালের মতো এটাও ব্যার্থ হয়। যার জন্য বিশেষজ্ঞের ধারনা প্রজেক্ট নিওমও বিন সালমানের একটি ব্যর্থ প্রজেক্ট হতে চলেছে। সৌদি আরব যে গতিতে কাজ করছে তাতে প্রজেক্ট নিওম সম্পূর্ন হতে অন্তত একশো বছর সময় লাগবে। সৌদি আরবের অর্থনীতির মূল ভিত্তিই খনিজ তেল, ততদিনে বিশ্বে জীবাশ্ম জ্বালানির কোনও প্রয়োজনীয়তা থাকবেনা সুতরাং সৌদি আরব প্রজেক্ট নিওম চালাতেও পারবেনা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *