ভারতের প্রথম গভীর সমুদ্র বন্দর হওয়ার পথে এই রাজ্যে
পৃথিবীর সবচেয়ে বড় উপদ্বীপ হিসাবে ভারতের তিনদিকে সমুদ্র রয়েছে। ভারতের পূর্বে রয়েছে বঙ্গোপসাগর, পশ্চিমে আরব সাগর ও দক্ষিনে রয়েছে ভারত মহাসাগর। স্বাভাবিক ভাবেই ভারতের ৭,৫১৭ কিলোমিটার লম্বা বিশাল উপকূল ভাগ রয়েছে। পশ্চিম উপকূল থেকে পূর্ব উপকূল পর্যন্ত ভারতের প্রচুর বন্দর রয়েছে। যার মধ্যে তেরোটি বন্দর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন, যেমন গুজরাটের কান্ডলা বন্দর, মুম্বাইয়ের জওহরলাল নেহেরু পোর্ট ট্রাস্ট, বিশাখাপত্তনম বন্দর, চেন্নাই বন্দর, পশ্চিমবঙ্গের হলদিয়া বন্দর ইত্যাদি। বিগত কয়েক দশক ধরে ভারতের এসব কোনও বন্দরেরই তেমন সক্ষমতা ছিলনা বড় পন্যবাহী জাহাজ ধারনের যার কারনে লাভ হত ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলো যেমন শ্রীলঙ্কা, সিঙ্গাপুরের। বিশ্বের অধিকাংশ বানিজ্য সমুদ্রনির্ভর। প্রাচীনকাল থেকেই ভারতীয় ব্যবসায়ীরা সমুদ্রের মাধ্যমে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বানিজ্য করে আসছে। ভারতের তিনদিকে সমুদ্র থাকলেও কোনও গভীর সমুদ্র বন্দর না থাকার কারনে ভারতের আমদানি ও রপ্তানির ক্ষেত্রে অতিরিক্ত খরচ হত। তবে এবার সেই সমস্যার সমাধান হতে চলেছে। কেরালায় ভিঝিনজাম বন্দর তৈরি করা হচ্ছে যা ভারতের প্রথম গভীর সমুদ্র বন্দর হবে। এই ভিঝিনজাম বন্দর ভারতের সমুদ্র বানিজ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন হবে।
কেরালার একদম দক্ষিন প্রান্তে কন্যাকুমারীর কাছে অবস্থিত এই ভিঝিনজাম বন্দর। সম্প্রতি হংকং এর জেন হুয়া ১৫ জাহাজ দক্ষিন চীন সাগর হয়ে ভিঝিনজাম বন্দরে এসেছে। জেন হুয়া ১৫ আকারে দুটি ফুটবল মাঠের সমান, এতবড় জাহাজ এর আগে কখনও ভারতের কোনও বন্দরে আসেনি। যার জন্য এটি ভারতের একটি গুরুত্বপূর্ন অর্জন বলা হচ্ছে। হংকং থেকে কেরালা আসতে জাহাজটির ৪২ দিন সময় লেগেছে। কেরালার তিরুবনন্তপুরমে অবস্থিত এই ভিঝিনজামে সামুদ্রিক বানিজ্যের ইতিহাস দ্বিতীয় শতাব্দী বিসিই থেকে পাওয়া যায়।
অষ্টম শতক এডিতে পাণ্ড্য রাজবংশ আয় রাজবংশকে পরাজিত করে। বাধ্য হয়ে আয় রাজবংশের নিবাসীরা এই ভিঝিনজামে চলে আসে সেসময়। ভিঝিনজামে একটি আধুনিক বন্দর তৈরির প্রস্তাব প্রথম দেয় ট্রাভাঙ্কোর রাজ্যের দেওয়ান সি পি রামাস্বামী আইয়ার ১৯২০ সালের দিকে। ১৯৪০ সালে এখানে বন্দর তৈরির জরিপ শুরু হয় কিন্তু বন্দর তৈরির প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নিতেই পঞ্চাশ বছর সময় লেগে যায়। অবশেষে ২০১৫ সালে এখানে বন্দর তৈরির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ভিঝিনজাম আন্তর্জাতিক সমুদ্র বন্দর তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয় আদানি ও সেজ প্রাইভেট লিমিটেডকে। ২০১৫ সালে এই বন্দর তৈরির কাজ শুরু হয়েছে, বলা হচ্ছে এবছর মে মাস নাগাদ ভিঝিনজাম বন্দরের প্রথম ধাপ সম্পন্ন হবে। তবে কেরালায় এই বন্দর তৈরির জন্য প্রথমে স্থানীয় মানুষদের দ্বারা প্রচুর বিরোধীতা হয়েছিল। এই বন্দর কেরালা সরকার করলেও ভারত সরকারও এই বন্দর তৈরিতে অর্থায়ন করেছে। এই বন্দর নির্মানে আদানি সংস্থা ২,৪৫৪ কোটি টাকা এবং রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকার ১,৬৩৫ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। কেরালা সরকারও ৫০০ একর জমি দিয়েছে বন্দর তৈরির জন্য। আদানি সংস্থার সাথে এই বন্দরের জন্য ৪০ বছরের চুক্তি হয়েছে এবং এই চুক্তি আরও ২০ বছর বৃদ্ধি করার সুযোগ রয়েছে। ৭,৬০০ কোটি টাকার এই বন্দর নির্মান প্রজেক্ট ভারতের গভীর সমুদ্র বন্দরের চাহিদা পূরন করবে। যখন মে মাসে এই বন্দরের প্রথম ধাপ সম্পন্ন হয়ে যাবে তখন ভারতের মোট কন্টেইনার পরিবহনের ৭৫ শতাংশ একা এই বন্দর দিয়েই পরিবহন হবে। ভিঝিনজাম বন্দরের এতটা সক্ষমতা আছে যে এটি ২৪,০০০ টিইইউ বা ২০ ফুট ইকুইভেলেন্ট ইউনিট সক্ষমতার জাহাজকে নিয়ন্ত্রন করতে সক্ষম। যেকোনও গভীর সমুদ্র বন্দরের প্রধান বৈশিষ্ট্য তার প্রাকৃতিক গভীরতা, ভিঝিনজাম ভারতের প্রথম কোনও আন্তর্জাতিক সমুদ্র বন্দর যার প্রাকৃতিক গভীরতাই ১৮ মিটার যা বাড়িয়ে ২৪ মিটার পর্যন্ত করা হচ্ছে, যার ফলে অনেক বড় বড় পন্যবাহী জাহাজ এই বন্দরে প্রবেশ করতে সক্ষম।
পন্য পরিবহন ছাড়াও বহুমুখী ব্যবহারের জন্য এই বন্দর তৈরি করা হচ্ছে। এই বন্দর আন্তর্জাতিক সমুদ্র বানিজ্য পথ থেকে মাত্র দশ নটিক্যাল মাইল বা ১৮.৫২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। ভারতে দিল্লি থেকে মুম্বাই যাওয়ার জন্য কিংবা এক প্রদেশ থেকে অন্য প্রদেশে যাওয়ার জন্য যেমন নির্দিষ্ট জাতীয় সড়ক রয়েছে ঠিক তেমনি আন্তর্জাতিক সমুদ্র বানিজ্যের জন্য এক মহাদেশ থেকে অন্য মহাদেশে বানিজ্যের জন্যেও জাহাজগুলোও এক একটি নির্দিষ্ট পথ ব্যবহার করে। সুয়েজ খাল হয়ে মধ্যপ্রাচ্যে যাওয়ার গুরুত্বপূর্ন বানিজ্য পথ থেকে মাত্র দশ নটিক্যাল মাইল দূরে এই ভিঝিনজাম বন্দর অবস্থিত। এতদিন পর্যন্ত ভারতে আমদানি ও রপ্তানির জন্য কোনও বড় বানিজ্যিক জাহাজ ভারতের কোনও বন্দরে আসতে পারতনা, জাহাজগুলো ভারতের কাছে শ্রীলঙ্কার কলম্বো বন্দর কিংবা সিঙ্গাপুর বা মালয়েশিয়ার বন্দরে দাঁড়াতো। সেখান থেকে অন্য তুলনামূলক ছোট জাহাজে করে পন্য ভারতে আসতো কিংবা ভারত থেকে পন্য সেসব জাহজে যেত, এতে পরিবহন খরচ অনেক বেড়ে যেত।
ভিঝিনজাম গভীর সমুদ্র বন্দর তৈরি হওয়ার ফলে এবার সেসব জাহাজ সরাসরি এখানে পৌঁছে যাবে যাতে পরিবহন খরচ অনেক কমে যাবে ভারতের। সমুদ্রের জল যখন উপকূলের দিকে আসে তখন সেই জলে প্রচুর মাটি মিশে থাকে যা কোনও বন্দরের গভীরতা কমিয়ে দিতে পারে কিন্তু আরব সাগরের উপকূলে ভিঝিনজাম বন্দরকে এমনভাবে তৈরি করা হচ্ছে যাতে সমুদ্রের জল থেকে অতিরিক্ত মাটি এখানে আসতে না পারে ফলে বারবার ড্রেজিং করারও প্রয়োজন হবেনা, এতেও অনেক খরচ বেঁচে যাবে। এই প্রজেক্টে পাঁচ হাজার মানুষ প্রত্যক্ষ ভাবে কাজ পেয়েছে এবং পরোক্ষভাবেও অনেক কর্মসংস্থান হয়েছে। ক্রুজ পর্যটনশিল্পও গড়ে উঠবে ভবিষ্যতে এই বন্দরকে কেন্দ্র করে।
সম্পূর্ন আধুনিক ভাবে এই বন্দর তৈরি করা হচ্ছে যাতে অধিকাংশ ব্যবস্থা স্বয়ংক্রিয় হবে যার জন্য জাহাজের বন্দর থেকে ফিরে যাওয়ার সময় অনেক কমে যাবে। একটি জাহাজ বন্দরে প্রবেশের পর তার থেকে পন্য নামিয়ে, নতুন পন্য ভরা হয়। এরপর জাহাজটি বন্দর থেকে তার গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওনা হয়, একেই জাহাজটির বন্দর থেকে ফিরে যাবার সময় বলা হয়। আগে ভারতের বন্দরগুলোতে জাহাজ প্রতি গড়ে তিন থেকে চারদিনের বেশী সময় লাগতো কিন্তু স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থার কারনে ভিঝিনজাম বন্দরে এইসময় দুই দিনেরও কম লাগবে যাতে ভারতের আমদানি ও রপ্তানিতে গতি আসবে।
২০২১- ২২ সালে ভারতে ৪.৬ মিলিয়ন টিইইউ ট্রান্সশিপমেন্ট কার্গো এসেছিল। কোন বড় জাহাজ অন্য কোনও দেশে যাওয়ার পথে মাঝপথে অন্য কোনও দেশে পন্য নামানোর প্রয়োজন হলে সেই ধরনের পন্যকে ট্রান্সশিপমেন্ট কার্গো বলা হয়। ভারতে ট্রান্সশিপমেন্ট কার্গো নামানোর জন্য আগে জাহাজগুলো শ্রীলঙ্কার কলম্বো বন্দর, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ার ক্ল্যাঙ্গ বন্দরে ভারতের পন্য নামিয়ে দিত। ৪.৬ মিলিয়ন কার্গোর মধ্যে ৪.২ মিলিয়নই বাইরের দেশ থেকে ভারতকে অন্য জাহাজে করে আনতে হয়েছিল যাতে প্রচুর পরিবহন খরচ হয় কিন্তু আগামী মে মাস থেকে আর সেটা হবেনা। ভিঝিনজাম বন্দর নির্মানের ফলে ভারতের বৈদেশিক সঞ্চয় বাড়বে, বিদেশী বিনিয়োগ আসবে, ভারতের বানিজ্যে গতি আসবে, অর্থনৈতিল লাভ হবে, কর্মসংস্থান হবে, সাথে এই বন্দরকে কেন্দ্র করে আশেপাশে শিল্পাঞ্চলও গড়ে উঠবে যাতে উৎপাদন কেন্দ্র থেকে পন্য দ্রুত কম খরচে বন্দরে পাঠানো যায়।